fbpx

দ্য ডাবল নেগেটিভ

(১)

মাইনাসে মাইনাসে প্লাস।

কেন বললাম কথাটা? জানতে চাইলে আপনাকে পুরো ঘটনা শুনতে হবে।

আমার নাম হিমেল। বয়স তেত্রিশ। ভার্সিটিতে জুওলজিতে অনার্স পড়তাম। থার্ড ইয়ার শেষ করতে পারিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে মোহাম্মদপুরে একটা বড় মেডিক্যাল স্টোর পেয়েছি। স্টোরের কাছেই বাসা।

দেখতে ভালো বলে বন্ধুরা আমাকে বলে ‘হ্যানসাম হিমেল’।

ঘটনার মূলে রয়েছে রুবি। যেমন চেহারা, তেমন শরীরের গড়ন। লালমাটিয়া কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স পাশ করেছে। বছর খানেক আগে আমার বন্ধু ধ্রুবের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। ওদের বাসা ধানমন্ডি লেকের কাছে।

আমি, ধ্রুব আর শিবলি – আমরা তিন বন্ধুই রুবির প্রণয়-প্রার্থী ছিলাম। আমার পরিচয় তো দিয়েছি। ধ্রুব ম্যানেজমেন্টে অনার্স কমপ্লিট করে বাবার বিশাল ব্যবসা দেখাশোনা করছে। আলসেমির কারণে মাস্টার্স করেনি। ওর একটাই কষ্ট – দেখতে ভালো না।

শিবলি তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছিলো। জুওলজিতে মাস্টার্স করে একটা কলেজে শিক্ষকতা করছে। গড়পড়তা চেহারা। তবে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বলে টাকার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। বাসা কল্যাণপুর।

সব কিছু বিবেচনা করলে আমরা তিন বন্ধু সমতুল্য। চেহারার দিক দিয়ে আমি উত্তম, শিবলি মধ্যম আর ধ্রুব অধম। শিক্ষার দিক দিয়ে শিবলি উত্তম, ধ্রুব মধ্যম আর আমি অধম। টাকার দিক দিয়ে ধ্রুব উত্তম, আমি মধ্যম আর শিবলি অধম।

মনে রাখতে কষ্ট হচ্ছে? সহজ করে দিচ্ছি। ধ-তে ধনী, ধ-তে ধ্রুব। হ-তে হ্যানসাম, হ-তে হিমেল। শ-তে শিক্ষিত, শ-তে শিবলি।

রুবি ধ্রুবকে বিয়ে করেছে বলে মনে করবেন না মেয়েটার কাছে টাকার গুরুত্ব বেশি। টাকা, চেহারা আর শিক্ষা – তিনটা যোগ্যতাই রুবির কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে কি রুবি লটারি করেছিলো? তা-ও নয়।

আমাদের তিনজনকে নিয়ে মেয়েটা এক মানসিক জটিলতায় পড়েছিলো। ও নিজেই আমাদেরকে এ কথা বলেছিলো। ধ্রুবের সাথে আমার তুলনা করলে রুবি আমাকে পছন্দ করে। আমার সাথে শিবলির তুলনা করলে তার পছন্দ হয় শিবলিকে। কিন্তু, শিবলির সাথে ধ্রুবের তুলনা করলে মেয়েটার পছন্দ হয় ধ্রুবকে। কী অদ্ভুত ব্যাপার!

শিবলি রুবির এই মানসিক অবস্থার নাম দিয়েছে লিজার্ড কমপ্লেক্স (lizard complex) । ব্রিটেনে Lizard Complex নামে একটা এলাকা আছে – দয়া করে তার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। সাইকোলজির কোনও বইতে আপনি lizard complex পাবেন না। এক ধরনের টিকটিকির সাথে রুবির এই মানসিক অবস্থার মিল আছে বলে শিবলি এই নাম দিয়েছে।

টিকটিকির এই প্রজাতির নাম side-blotched lizard, কারণ এর শরীরের দু’পাশে দু’টো লম্বা রেখা। এই জাতের পুরুষ ‍টিকটিকির গলার রঙ হয় কমলা, হলুদ বা নীল। মেয়ে টিকটিকির অবস্থা রুবির মতো। কমলা-গলা ছেলে টিকটিকির চেয়ে তার হলুদ-গলা বেশি পছন্দ। হলুদ-গলার চেয়ে বেশি প্রিয় নীল-গলা ছেলে। নীল-গলার চেয়ে বেশি পছন্দ কমলা-গলা।

বাচ্চাদের rock-scissors-paper খেলার সাথেও ব্যাপারটার মিল আছে। পাথর কাঁচিকে ভেঙে ফেলে, কাঁচি কাগজ কেটে ফেলে, আর কাগজ পাথরকে ঢেকে ফেলে।

রুবির lizard complex-এর ব্যাখ্যা হতে পারে এমন: ধ্রুবের চেহারা ভালো না, তাই মেয়েটার পছন্দ আমাকে। আমার শিক্ষা নেই, তাই তার পছন্দ শিবলিকে। শিবলির টাকা নেই, তাই তার পছন্দ ধ্রুবকে।

আমার বাবার চিকিৎসা করাতে দু’মাস আমাকে সিঙ্গাপুরে থাকতে হয়েছিলো। বাবাকেও হারালাম, রুবিকেও হারালাম। আমি না থাকায় রুবি শিবলির সাথে ধ্রুবের তুলনা করে ধ্রুবকে বেছে নিলো। বিয়েটাও সেরে ফেললো।

(২)

রুবিকে ভুলে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম, যে কোনও মূল্যে ওকে পেতে হবে।

কুৎসিত চেহারার ধ্রুব সুন্দরী রুবিকে আদর করছে, এ কথা চিন্তা করে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। মনে হতে লাগলো, ধ্রুব চিটিং করেছে আমি ছিলাম না, সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।

ভাবলাম, ধ্রুবকে খুন করতে হবে। ও না থাকলে রুবি যেহেতু শিবলিকে পছন্দ করবে, তাই খুনের দায়ে শিবলিকে ফাঁসিয়ে দিতে হবে।

এক ঢিলে দুই টিকটিকি।

কী বললেন? এটা পাগলামি? রুবিকে দেখলে আপনি এ কথা বলতেন না। ওকে দেখলে আপনি কোনও কথাই বলতেন না। হা করে শুধু তাকিয়ে থাকতেন।

অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, খুনের কাজে ছুরি ব্যবহার করবো। শিবলির বাসা থেকে একটা ছুরি চুরি করতে হবে। নিশ্চয়ই ছুরিতে ওর হাতের ছাপ থাকবে।

একদিন রাতে অনেক খাবার, মিষ্টি আর ফল নিয়ে শিবলিদের বাসায় গেলাম। এত কিছু পেয়ে ওর মা তো মহাখুশি। বললেন, ‘দু’দিন আগেই তো ধ্রুব এলো ওর বউকে নিয়ে। তুমি কেন সেদিন এলে না?’

শিবলি একটু বিব্রত হলো। বুঝতে পারলাম, ধ্রুবের অনুরোধে সে আমাকে দাওয়াত দেয়নি। রুবির লিজার্ড কমপ্লেক্সই এর কারণ। ধ্রুবের জন্য আমি হুমকি, শিবলি হুমকি নয়।

‘ঢাকার বাইরে ছিলাম, আন্টি,’ বললাম আমি।

কিচেন থেকে আন্টি বেরই হলেন না। ছুরি-চুরির সুযোগ পেলাম না। তার বদলে শিবলির টেবিল থেকে পেপার-কাটার চুরি করলাম। ও যখন বাথরুমে গেল, আমার রুমাল দিয়ে পেপার কাটারটা মুড়ে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম।

খেয়াল রাখলাম যাতে পেপার-কাটারে আমার হাতের ছাপ না পড়ে।

বাসায় ফিরে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। ইন্টারনেটে হাতের ছাপ নিয়ে লেখা বেশ কিছু আর্টিকেল পড়ে ফেললাম। পরদিন একটা ম্যাগনিফায়িং গ্লাস কিনে আনলাম।

ভালো করে চেক করেও পেপার-কাটারে কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেলাম না।

শিবলি বা ওর মা হয়তো টেবিল পরিষ্কার করার সময় কাপড় দিয়ে অন্য জিনিসপত্রের সাথে পেপার-কাটারও মুছে রেখেছে। পরিষ্কার করার পর এটা কেউ ব্যবহার করেনি।

আবার নেট সার্ফিং শুরু করলাম। আঙুলের ছাপ সংগ্রহের জন্য বেশ কিছু জিনিসপত্র কিনে আনলাম। শিবলিকে ডিনারের দাওয়াত দিলাম। একটা সাদা গ্লাস ধুয়ে ভালো করে মুছে রাখলাম। আঙুলের ছাপ সংগ্রহের জন্য সাদা সারফেস ভালো।

কী ভাবছেন? পেপার-কাটারটা শিবলিকে ধরতে দিলেই হতো? মোটেই না। ওর অনেক বুদ্ধি। সাথে সাথে বুঝতে না পারলেও হত্যাকাণ্ডের পর ঠিকই বুঝতে পারতো কে কী করেছে।

নির্দিষ্ট দিনে শিবলি এলো, ডিনার খেলো এবং সাদা গ্লাসে বুড়ো আঙুলের ছাপ রেখে চলে গেল।

কাজে লেগে গেলাম। মেকানিক্যাল পেন্সিলের সিস গুড়ো করে রেখেছিলাম। সেই পাউডার ব্রাশে লাগিয়ে গ্লাসের গায়ে ডাস্টিং করলাম। শিবলির আঙুলের ছাপ দৃশ্যমান হতেই ভালো কোয়ালিটির (২৪০০ ডিপিআই) ছবি তুললাম।

ল্যাপটপে ছবিটা কপি করে ফটো-এডিটর ব্যবহার করে বাম থেকে ডানে ফ্লিপ করলাম, যাতে ছবিটার একটা মিরর ইমেজ তৈরি হয়। কালারটাও উল্টে দিলাম – ব্যাকগ্রাউন্ড সাদা থেকে কালো হয়ে গেল, ফিঙ্গারপ্রিন্ট হয়ে গেল কালো থেকে সাদা। ছবিটা এভাবে না উল্টালে পেপার-কাটারে উল্টো ছাপ আসবে।

ওভারহেড ট্রান্সপ্যারেন্সি শিটে ছবিটা প্রিন্ট করলাম। প্রিন্টের উপর সিসের গুড়োর প্রলেপ দিয়ে একটু সাদা গ্লু আর এক ফোঁটা গ্লিসারিন ব্যবহার করলাম।

শুকিয়ে যাবার পর একটা পাতলা আবরণের মতো হলো। সাবধানে তুলে একটা ছোট্ট খামে রেখে দিলাম শিবলির ফিঙ্গারপ্রিন্ট-এর ‘ছাঁচ’। ছাঁচ না বলে বলতে পারেন শিবলির বুড়ো আঙুলের চামড়ার কপি।

(৩)

আমার জানা ছিলো, প্রতিদিন রাত সাড়ে দশটায় ধ্রুব ধানমন্ডি লেকের পারে ঘুরতে যায়। যে কোনও একদিন কাজটা সারা যেতো। কিন্তু শিবলিকে ফাঁসাতে হবে তো।

প্রতিদিন রাত নয়টা-সাড়ে নয়টার দিকে আমি শিবলিকে কল দিতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য, ও কোথায় আছে তা জানা।

আমার মেডিক্যাল স্টোরে কর্মচারী তিনজন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত কায়েস। আমার জন্য সব করতে রাজি। রাত এগারোটায় দোকান বন্ধ করে সব চাবি ওকে বুঝিয়ে দেয় অন্য দুইজন।

আমি দোকানে খুব একটা থাকতাম না। কিন্তু, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে থাকতে শুরু করলাম। রাত দশটায় অন্য দু’জন কর্মচারীকে ছুটি দিয়ে শুধু কায়েসকে রাখি। ওর যাতে মন খারাপ না হয়, সেজন্য প্রতিদিন দোকান বন্ধ করে যাওয়ার সময় ওর হাতে একশ’ টাকা দেই।

একদিন সুযোগ এসে গেল। রাত সাড়ে নয়টায় শিবলিকে কল করে জানতে পারলাম, ও ধানমন্ডিতে ওর আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছে। আমার জানা ছিলো, বাসাটা ধানমন্ডি লেক থেকে বেশি দূরে নয়।

পৌনে দশটায় দু’জন কর্মচারীকে ছুটি দিলাম। কায়েসকে দুই কাপ চা আনতে পাঠিয়ে আমার ব্যক্তিগত ড্রয়ার থেকে রুমালে জড়ানো পেপার-কাটার বের করে প্যান্টের পকেটে নিলাম। ফিঙ্গারপ্রিন্টের খামটা নিলাম বুকপকেটে। মোবাইলটা সাইলেন্ট করে ড্রয়ারে রেখে দিলাম।

চা শেষ করে কায়েসকে বললাম, ‘আমি একটু হেঁটে আসি।’

দশটা বিশে ধানমন্ডি লেকের পারে পৌঁছালাম। ধ্রুবের পছন্দের স্পটে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইলাম। আমার জন্য ভালোই হয়েছে, জায়গাটা নির্জন।

দশটা চল্লিশে ধ্রুব এলো। একটা বেঞ্চে বসে লেকের দিকে তাকিয়ে রইলো।

পকেট থেকে পেপার-কাটার বের করে রুমালটা বাম হাতে নিলাম। হাতলে রুমাল জড়ানো থাকলে জোর পাবো না।

দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ধ্রুব কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হৃৎপিন্ডে পেপার-কাটারটা বিঁধিয়ে দিলাম। বেঞ্চ থেকে মাটিতে পড়ে ‍গেল ধ্রুব। রুমাল দিয়ে পেপার-কাটারের হাতলটা মুছে বুকপকেট থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ছাঁচ বের করে হাতলের গায়ে ছাপ দিলাম। রুমাল আর ছাঁচ পকেটে ভরে দ্রুত হেঁটে বের হয়ে সিএনজি নিলাম। 

আমার স্টোর থেকে বেশ কিছুটা দূরে সিএনজি থেকে নামলাম। ভাড়া মিটিয়ে হেঁটে গেলাম বাকি পথটা।

সোয়া এগারোটা বেজে গেছে। কায়েস জানালো, আমাকে কল করে পায়নি। আমার সাথে কথা না বলে দোকান বন্ধ করতে পারছিলো না।

‘মোবাইলটা ভুলে দোকানে রেখে গেছি,’ বললাম আমি। একটা পাঁচশ’ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা রাখ। তোর কষ্টের দাম। আর একটা কথা। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি আমি দোকানেই ছিলাম।’

‘কেন, স্যার?’

‘আদাবরে দুই গ্রুপে মারামারি হয়েছে। আমার ঘনিষ্ঠ দুই-একজন জড়িত। পুলিশ আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। ঝামেলা এড়াতে আমি বলবো, আমি দোকানেই ছিলাম। তুইও তাই বলিস, ও.কে.?’

‘ও.কে. স্যার।’

‘অন্য কারো সাথে কোনও আলাপ না। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে।’

‘যদি জিজ্ঞেস করে আমাকে কল দিয়েছিস কেন, বলবি “স্যার তার মোবাইল খুঁজে পাচ্ছিলো না। তাই আমারটা দিয়ে কল দিয়ে খুঁজে দিয়েছি। মোবাইলটা ডানদিকের শেলফে ছিলো।” ও.কে.?’

‘ও.কে. স্যার।’

ড্রয়ার থেকে মোবাইলটা নিয়ে বাসার পথ ধরলাম। ফিঙ্গারপ্রিন্টের ছাঁচটা ড্রেনে ফেলে দিলাম। বাসায় এই সংক্রান্ত কোনও কিছুর চিহ্ন রাখলাম না।

(৪)

রাখে আল্লাহ, মারে কে! শিবলি যে খুন করেনি, তার সাক্ষী পুলিশ নিজে!

সেদিন রাত দশটায় ধানমন্ডিতে ওর মোবাইল আর টাকা-পয়সা ছিনতাই হলো। জিডি করতে ধানমন্ডি থানায় গেল সে – সোয়া দশটা থেকে সোয়া এগারোটা পর্যন্ত সে এসআই দিদারের সাথে ছিলো।

রাত সাড়ে দশটায় ধ্রুব বাসা থেকে বের হয়েছিলো। এগারোটায় ওর লাশ পড়ে থাকতে দেখলেন একজন বৃদ্ধা। থানায় খবরটা তিনিই দিলেন।

তদন্তের দায়িত্ব পেলেন এসআই মতিন। তিনি ধ্রুবের মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করলেন সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা – যখন তাঁর পাশের ‍টেবিলে এসআই দিদারের সাথে কথা বলছিলো শিবলি।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, পেপার-কাটারে ধ্রুবের হাতের ছাপও পাওয়া গেল। আমি পরে Google করে দেখেছি, হৃৎপিন্ডে ছুরিবিদ্ধ হলে গড়ে দু’মিনিট পরে মৃত্যু হয়। আমি সর্বোচ্চ এক মিনিট ধ্রুবের সাথে ছিলাম। হয়তো তখন সে অজ্ঞান ছিলো। পরে কয়েক সেকেন্ডের জন্য জ্ঞান ফিরে পেয়ে হয়তো সে পেপার-কাটারটা শরীর থেকে বের করার চেষ্টা করেছে।

এসআই মতিন শিবলিকে জিজ্ঞাসা করলেন ওর কাছ থেকে ধ্রুব পেপার-কাটার নিয়েছিলো কিনা। ও জানালো, ধ্রুবের নিজেরই একাধিক পেপার-কাটার ছিলো। শিবলির পেপার-কাটার যে মিসিং, সে তা পুলিশকে বললো না। হয় সে নিজে টের পায়নি, অথবা চেপে গেছে।

এসআই মতিন সিদ্ধান্ত নিলেন, পেপার-কাটারটা ধ্রুবের। ওর সাথে দেখা করতে গিয়ে কোনও একদিন শিবলি এটা ধরেছে।

এসআই মতিনের যুক্তিগুলো সরলরেখায় চলে। তার ডিকশনারিতে বক্ররেখা নেই। হাতের ছাপ পাওয়া গেছে শিবলি আর ধ্রুবের। যেহেতু ‍শিবলি ওখানে ছিলো না, তাই ধ্রুবের মৃত্যুর জন্য ধ্রুবই দায়ী। অর্থাৎ, এটা হয় আত্মহত্যা, না হয় দুর্ঘটনা।

ধ্রুবের ব্যবসা ভালো চলছিলো। ঘরে সুন্দরী বউ। ধ্রুব বা তার বউ – কেউই পরকীয়ায় জড়িত নয়। অতএব, এটা আত্মহত্যা নয়।

এসআই মতিনের রিপোর্টে ধ্রুবের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হলো: ধ্রুব পেপার-কাটার হাতে নিয়ে কিছু একটা করছিলো। হঠাৎ পড়ে যাওয়ায় পেপার-কাটার তার শরীরে ঢুকে গেছে।

আমি মনে মনে হাসলাম। যতবার মনে পড়ে, ততবার হাসি।

কয়েকদিন পর আমার হাসি বন্ধ হয়ে গেল। লিজার্ড কমপ্লেক্সের সূত্র অনুযায়ী রুবি শিবলির দিকে ঝুঁকে পড়লো।

একদিন রুবির সাথে দেখা করলাম। বাংলা চলচ্চিত্র, হিন্দি চালচিত্‌র্‌ আর ইংলিশ মুভি থেকে বেছে নেয়া রোমান্টিক ডায়লগ ব্যবহার করলাম। কোনও কাজ তো হলোই না, উল্টো মেয়েটা আমার উপর ভীষণ রেগে গেল। বাসা থেকেই বের করে দিলো।   

ও কি আঁচ করতে পেরেছে আমি ধ্রুবের খুনি?

তবে, রুবি খুব অল্পতেই রেগে যায়। যখন তখন রেগে যায়। রাগ করার কিছু না পেলে ‘রাগ করার কিছু নেই কেন’ ভেবে রেগে যায়।

একদিন রুবি আর শিবলিকে পাশাপাশি হাঁটতে দেখে আমার মনে হলো, যা আছে কপালে, শিবলিকেও খুন করতে হবে। পরক্ষণেই মনে হলো, দু’বার ভাগ্যের সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাছাড়া, রুবি তখন পুরো ব্যাপারটা ধরে ফেলবে।

ভাবলাম, আরেকবার রুবিকে বোঝাতে চেষ্টা করবো। যদি কাজ না হয়, তখন দেখা যাবে।

(৫)

ভালো পোশাক পরে মেন’স পারলার হয়ে একদিন রুবির বাসায় গেলাম। 

দরজা খুলে আমাকে দেখেই মেয়েটা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। দৌড়ে কিচেনে গিয়ে একটা ছুরি হাতে নিয়ে আমাকে তাড়া করলো।

লিফটের অপেক্ষা করলে ‍নির্ঘাত আমাকে মরতে হবে। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। রুবিও পিছনে পিছনে আসছে।

হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেয়েটা। ছুরিটা বিঁধে গেল তার বুকে।

আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলাম। ছুরিটা টেনে বের করলাম। ক্ষতটা মারাত্মক বুঝতে পেরে অ্যাম্বুলেন্স কল করতে চাইলাম। কোনও নাম্বার মনে করতে পারলাম না।

অনেক চেষ্টা করেও রুবিকে বাঁচাতে পারলাম না।

এবারও তদন্তের দায়িত্ব পেলেন এসআই মতিন। কারণ, দু’টো মৃত্যুর ঘটনাই তার তদন্ত এলাকায় ঘটেছে।

মতিন শুরুতেই সন্দেহভাজন হিসেবে আমাকে গ্রেফতার করলেন। তারপর তাঁর সরলরৈখিক যুক্তি প্রয়োগ করলেন। ছুরিতে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে রুবি আর আমার। রুবির ছুরিতে ওর হাতের ছাপ থাকতেই পারে, আমার হাতের ছাপ থাকবে কেন? যেহেতু আমি ওখানে উপস্থিত ছিলাম, রুবির মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।

বেশ কয়েকজন সাক্ষ্য দিলো, আমি রুবিকে উত্যক্ত করতাম। খুনের মোটিভ পাওয়া গেল। এসআই মতিন তাঁর চার্জশিটে আমাকে খুনি সাব্যস্ত করলেন।

আমার ফাঁসিটা যদি হয়েই যায়, তাহলে বলতে পারবেন এক ঢিলে তিন টিকটিকি মরলো।

ধ্রুবের মৃত্যুটা ছিলো হত্যা, পুলিশ বললো দুর্ঘটনা – একটা ভুল হলো। রুবির মৃত্যুটা ছিলো দুর্ঘটনা, পুলিশ বললো হত্যা – আরেকটা ভুল হলো। ফলে কী হলো? আমি, একজন খুনি, ধরা পড়ে গেলাম – এসআই মতিনের দুই নেগেটিভ মিলে পজিটিভ হয়ে গেল।   

বিষে বিষ ক্ষয়ের মতো মাঝে মাঝে ভুলে ভুল ক্ষয় হয়।

এ জন্যই বলেছি, মাইনাসে মাইনাসে প্লাস।

(শেষ)

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪