fbpx

নৈরাত্রি (শেষ পর্ব)

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

রাকিবের ফোনে কল আসে। রাকিব তখন ঘুম থেকে উঠল সবে মাত্র। সকাল ৭টা বাজে। ঘুম ঘুম চোখেই সে ফোন রিসিভ করে।

হ্যালো।

ইন্সপেক্টর রাকিব? তাড়াতাড়ি চলে আসুন গাড়ি করে কিশোরগঞ্জের দিকে। এখানে নয়াখাল গ্রামের পরিত্যক্ত বাড়িতে আগুন লেগেছে গত রাতে। আমরা দুটি লাশ পেয়েছি। লাশ দুটির খুবই খারাপ অবস্থা। আগুনে পুড়ে শরীরের কোন অংশ চেনার মত নেই। বিশেষ করে একটি লাশের চেহারা তো এতটা পুড়েছে যে প্রায় কয়লার মত হয়ে গেছে। শীঘ্রই আসুন।

জি, এক্ষুনি আসছি।

রাকিব ধরফরিয়ে বিছানা থেকে উঠে। তার হাতে একেবারেই সময় নেই। সে এখনো বুঝতে পারছে না কেসটা কোন দিকে এগোচ্ছে। নিতিস সেন কি আসলেই সুইসাইড করল গায়ে আগুন দিয়ে? না, না যেহেতু দুটি লাশ পাওয়া গেছে তাহলে অবশ্যই সুইসাইড হবে না। অবশ্য লাশগুলির চেহারাও তো বুঝে যাচ্ছে না। হয়ত ঐ গ্রামেরই দুইজন বাসিন্দা। এমনও তো হতে পারে। রাকিব হাতে ফোন নেয়।

মিস ইলা?

জি, এত সকালে? কিছু হয়েছে? ইলা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে। 

মানে কিশোরগঞ্জে আপনার স্বামী কাজ করতো না? সেখানেই লাশ পাওয়া গেছে দুটি। আমরা এখনো নিশ্চিত না লাশ গুলি কার। আপনি একটু থানায় আসবেন আজকে দুপুরের মাঝে।

ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

রাকিব ফোন রেখে দেয়।

*****

সময় দুপুর ১টা। ইলার চোখ স্তব্ধ হয়ে আছে। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টেবিলের উপর। একসময় সে শীতল কণ্ঠে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে।

আপনারা তাহলে ধরে নিচ্ছেন দুটি লাশের একটি আমার স্বামীর?

মিস দেখুন আমি জানি বিষয়টি আপনাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে, মানতে পারছেন না। কিন্তু আমাদের হাতে আর কোন উপায় নেই। আগুন কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল আপনার ধারণাও নেই।

জাস্ট শাট আপ। আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। ইলা রাগের মাথায় চিৎকার করে উঠে।

দেখুন শান্ত হন মিস ইলা। আমার কথাগুলি শুনুন একটু। আমাদের ফরেনসিক ল্যাব পরীক্ষা করে জানিয়েছে আগুনের তাপমাত্রা প্রায় ১২০০ থেকে ১৩০০ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এতে করে ঐ বাড়ির নিচতলা থেকে শুরু করে উপর পর্যন্ত সব পুড়ে একাকার তো হয়েছেই। ইভেন বাড়ির আশেপাশেও অনেকখানি জায়গা পুড়ে যায়। 

এদেশে কি আগুনে পোড়া দেহ শনাক্ত করা হয় নি নাকি আগে? আমাকে এসব বলে কী বুঝ দিচ্ছেন? ইলা রাগে গরগর করতে থাকে।

অবশ্যই হয়েছে। আমি স্বীকার করছি। তবে সেগুলি ছিল নরমাল কোন চুলার গ্যাস থেকে লেগে যাওয়া আগুন কিংবা Incandescent Light। সেসব ক্ষেত্রে তাপমাত্রা থাকে ৫০০ ডিগ্রির আশেপাশে কিংবা তার নিচে। দেখুন দেহ দুটির অবস্থা এতোটাই খারাপ যে আমরা ডেন্টাল আইডেনটিফিকেসন, চেস্ট কিংবা অর্থোপেডিক এক্স রে, ইভেন ডি এন এ টেস্ট করার মত কোন স্কোপ খুঁজে পাচ্ছি না। আর এসব ক্ষেত্রে স্কাল মানে মাথার খুলিটার কিছু অংশ হলেও বেঁচে যাওয়া জরুরি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে খুলিটাই যেন বেশি পুড়েছে যা সচরাচর কখনো দেখা যায় না। আমরা নিজেরাও ধাঁধার মাঝেই আছি।

তাই বলে লাশ আমার স্বামীর হয়ে যাবে? গ্রামের অন্য কোন একজন মানুষ এর যে না তার ই বা প্রমাণ কি?

দেখুন গ্রামের অন্য কোন মানুষ এর লাশ হলে অবশ্যই জানা যেত। আমরা গ্রামের কেউ নিখোঁজ এমন কোন প্রস্তাব পাইনি। আর… রাকিব ফজলুর  সাহেবের দিকে তাকায়।

আর? আর কী? বলুন। ইলা উত্তেজিত হয়ে উঠে।

দেখুন তো এই জামাগুলি আপনার স্বামীর কিনা। আমরা জামাগুলির ডিএনএ টেস্ট করিয়েছি। রেজাল্ট হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাই ধরে নিচ্ছি লাশ দুটির একটি আপনার স্বামীর। রাকিব ইলার দিকে জামাগুলি এগিয়ে দেয়।

ইলা চিৎকার করে কেঁদে উঠে। তার চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পরতে থাকে। রাকিবের কিছু বুঝার বাকি থাকে না।

আরেকটি সংবাদ আছে মিস ইলা। বুঝতে পারছি না কীভাবে নিবেন।

ইলা কোন ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তাকায় রাকিবের দিকে।

ঐ যে অফিসারটা, যে আপনার স্বামীকে ঘুষের দায়ে ফাঁসায়। তার নাম যেন কী বলেছিলেন? তার নাম বরুণ সরকার কি?

জি, এমনই কিছু শুনেছিলাম বোধ হয়। ইলার মাথায় এখন এসব কিছু ঢুকছে না।

দ্বিতীয় যে লাশটা পাওয়া গেছে সেটা ঐ অফিসার এর। মিস ইলা। আপনার স্বামীর জামাগুলি বাড়িটির থেকে কিছু দূরেই যে নদী, তার পাশে এক গাছে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। সে সাথে সেখানেই পরে থাকতে দেখা যায় অফিসারটির ঘড়ি। মানে শুরুতে তো বুঝিনি কার ঘড়ি। রাকিব একবার গলা খাঁকারি দেয়।   

তবে? ইলা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।

খোঁজ নিয়ে জানলাম অফিসারটি ঢাকায় ছিল এতদিন। গত পরশু মানে ঠিক যে রাতে আপনার স্বামী নিখোঁজ হন সে রাতেই বোধ হয় ঢাকা থেকে তার কিশোরগঞ্জে কোন এক কাজে ফিরবার কথা। তবে উনি ফেরেননি। উনার সাথে এরপর কোন রকম যোগাযোগও করা সম্ভব হয়নি। পরে উনার পরিবারকে ডেকে এই ঘড়ি দেখানোর পর তারা স্বীকার করে ঘড়িটি ঐ অফিসারেরই। অবশ্য আমরা এতটাও বোকা না যে শুধু ঘড়ি মিলে গেলেই ধরে নিব লাশ কার। উনার ঘড়িটা এদেশে খুব কম মানুষ ইউজ করে। বেশ দামি ঘড়ি এবং গ্রামের কেউ দূরের কথা, শহরের অনেক ভি আই পিও সে ঘড়ি পরবার মত সামর্থ্য রাখে না। তাই এক্ষেত্রে আমরা ধরে নিয়েছি উনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি।  

কী অদ্ভুত সব কথা শুনাচ্ছেন আপনি? আপনারা কি কিছুই করতে পারেন না নাকি?

দেখুন সব কাজেরই তো নির্দিষ্ট একটি সময় থাকে। ধাপে ধাপে এগোতে হয়। বরুণ সাহেবের পরিবার সেখানে থানায় জানানোর পর সেখানকার ইন্সপেক্টর কিছু সময় অপেক্ষা করে উনাকে খোঁজার চিন্তা করেছিল। বরুণ সাহেব এমনি খুব ব্যস্ত মানুষ। তাই উনার পরিবার এর ধারণা ছিল কাজের চাপে কিশোরগঞ্জে গিয়ে যোগাযোগ করবার সময় পাচ্ছেন না। তারা তাই পরদিন বিকাল পর্যন্ত খুব একটা কেয়ার করেনি। তবে যখন দেখল যে উনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টানা ফোন অফ করে রেখে দিয়েছেন তখনই তারা সেখানকার এক থানায় কল দিয়ে জিডি করে। কিন্তু লাভ কী হলো বলেন? কাজ শুরু করবার আগেই আগুন লেগে তিনি লাশ। রাকিব এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে।                

ইলা তখন চুপ করে আঁচলে মুখ ঢেকে রাখে।

নয়াখাল গ্রামের বেশ পুরনো বাড়ি ছিল সেটা। গ্রামের একদম সাইডে। গ্রামের মানুষজন কেউ সেদিকটায় তেমন যায় না। রাকিব এই কথা বলতে বলতে হাতে এক সিগারেট ধরায়।

আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আপনার স্বামীর জন্য কিছুই করতে পারলাম না। রাকিব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। শুধু একটাই খটকা এত বড় পরিসরে আগুনটা তৈরি হলো কিভাবে। রাকিব আবার নিঃশ্বাস ফেলে। কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়ত আমাদের অজানাই থাকবে। 

*****

“নিজেকে যতবার সাথে করে আনা আয়নায় দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। এই আমি যে সে আমি নয় সেজন্য না, বরং নিজের হাতের কাজের নিপুণতা যে এত জলদি এসে পড়বে সেটা ভেবে।” নিতিস সেন তার সামনে রাখা ডায়রিতে লিখে যাচ্ছে। ট্রেন কিশোরগঞ্জ থেকে চলতে আরম্ভ করেছে।

“নিজের পরিচয় নিয়ে এখনো কিছু ভাবিনি। তবে পরিচয় যে সব নয় তা টের পেয়ে গেছি জীবনে বেশ আগেই। নিজের বিদ্যা আর অভিজ্ঞতাগুলি যে এভাবে কাজে দিবে কখনো ভাবতে পারিনি। আফসোস শুধু একটাই নিজের পরিচয় এর সাথে সাথে হারাতে হচ্ছে সাজানো গুছানো সংসারটাকে। ইলা, অপু আর খেয়া। তাদের খুব মনে পড়বে। অবশ্য এমন পর্যায়ে জীবন নিয়ে গেছিল, যে পথে তাদের সঙ্গ আর পেতাম কিনা সেটাও নিশ্চিত না। তাই অনেক ভেবেই এই সব কিছু করে বসলাম।” নিতিস সেন লিখেই যাচ্ছে একটানা। 

“পরিচয়! পরিচয় কী? এই আমি, আমাকে ঘিরে আমার পরিবার, সমাজের মানুষের কাছে আমার নামের সাথে জুড়ে থাকা সম্মান। এই তো পরিচয়। যেদিন সে পরিচয়টাই নিজের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিতে লাগলো, যে কাজ জীবনে কক্ষনো করিনি সে কাজের দায়ে নিজের চাকরি, সম্মান সব কিছু হারিয়ে শেষমেশ পরিবারটাকেও হারাতে হলো, তারপর আর এই পরিচয় দিয়ে আমি করব টা কী?  সমাজে চলতে চলতে বার বার শুনতে হলো ঘুষখোর হিসেবে নিন্দা। নিজের পরিবার পর্যন্ত চাকরি না থাকায় খোঁটা দিতে দিতে এক সময় আমার পাশ ছেড়ে চলে গেল অন্য বাড়ি। এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে?” নিতিস সেন নিঃশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল একবার।

“নিজেকে শেষমেশ আর শক্ত রাখতে পারলাম না। জীবনে কিছু প্ল্যান হুটহাট করে চেঞ্জ করে ফেলতে হয়। সে রাতেও তেমন করেই প্ল্যান চেঞ্জ করে ফেললাম যখন শুনতে পেলাম বরুণ ঢাকায় এসেছে। বরুণ! খুব ইচ্ছা করছিল আমার নিজেকে যে কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাকেও সে রকম এক কষ্টের ভেতর দিয়ে নেই। যে আমার পরিচয় এভাবে কেড়েছে, দাগ লাগিয়ে ছুড়ে ফেলেছে সমাজের সামনে, তার জীবনকে এমন এক কলঙ্কময় পরিচয়ের সাথেই শেষ করি। প্ল্যান!” নিতিস সেন মুখে এক হাসি আনে।  

“Amygdala। কিছু বই পত্র পড়ে এই নামটির সঙ্গে বেশ আগেই পরিচিতি ঘটে। বই পড়বার বাতিক থাকায় জানতাম এই ড্রাগটির ক্ষমতা আছে মানুষের পূর্বের সকল স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়ার। শুধু ব্রেইনে জায়গা মত পুশ করা লাগবে। ঠিক করে রেখেছিলাম আগে থেকেই কখন এর ব্যবহার করব। কিশোরগঞ্জে কাজ করবার সুবাদে এক মর্গের কেয়ারটেকার এর সাথে বেশ খাতির হয়ে গেছিল।” নিতিস সেনের সামনে একই কামড়ায় এক পরিবার এসে ঢুকে। বেশ ফুটফুটে চেহারার এক বাচ্চা মেয়ে আছে তাদের। নিতিস কিছুক্ষণ লেখা থামিয়ে তাকিয়ে থাকে সে মেয়েটির দিকে। 

“জানো? আমি চাইলে তোমাকে খুব সহজ মৃত্যু দিতে পারতাম। কিছু লোক ভাড়া করে বলে দিতাম। গুলি করে তারাই সাফ করে দিত। কিন্তু না। কাজটা এভাবে করিনি। আমার ইচ্ছা ছিল নিজের হাতে তোমায় মারব এবং তুমি মারা যাবে আমার পরিচয় সাথে নিয়ে। খুব ধীরে ধীরে তুমি মরবে। চিৎকার করে। আমি তোমার সে চিৎকারগুলি শুনতে থাকব। যে চিৎকার এক সময় আমার অন্তরে বাজছিল সমাজের চোখে হেয় হয়ে।” বাচ্চা মেয়েটি নিতিস সেনের দিকে তাকিয়ে আছে।

“সিলিকন! শব্দটা যেদিন প্রথম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তে শুনেছিলাম ভাবছিলাম পর্যায় সারণির সিলিকন নাকি। বেশ কয়েকদিন যাবার পর একদিন মেকাপ আর্টিস্টদের মত একদল লোকদের দেখি মডেলদের মুখে কি একটা মেখে যাচ্ছে। দেখতে কাদার মত। পরে জানতে পারলাম তা এক ধরনের পলিসেকারাইড। এর সাথে সিলিকন নামক এক রাবার জুড়ে নিজের হাতের কারসাজিতে হুবহু তাদের চেহারার মত মাস্ক তৈরি করে ফেলছে। দেখেই তব্দা খেয়ে গেলাম। সেই সাথে জাগল প্রচণ্ড ইচ্ছা। শিখে ফেললাম এই কাজ। এত নিখুঁত হতে পারে কোন মাস্ক জানা ছিল না। তৈরির উপকরণ গুলি বেশ দামি কিনা, নিজের শখ মিটাতে কিছুটা জোর জবরদস্তি করেই ইন্ডাস্ট্রি থেকে উপকরণ গুলি এনে রেখেছিলাম নিজের বাসায়।” নিতিস সেন এক গ্লাস পানি খায় এ পর্যন্ত লিখে।    

“যেদিন ইলা তাদের নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে যায় সেদিনই ঠিক করি নিজের পরিচয়কে আর বাঁচতে দিব না। নিতিস সেনকে সত্যি বলতে সেদিনই হত্যার সিদ্ধান্ত নেই আমি। কিশোরগঞ্জে চলে যাই সে রাতেই। মর্গের কেয়ার টেকার এর সাথে কথা বলে এক লাশ নিয়ে কাজ শুরু করি নয়াখালের সে বাড়িতে। কাজ প্রথম প্রথম ভাল হচ্ছিল না। তাতে অবশ্য সমস্যা হয়নি। লাশ তো ফিল্ম এর মডেল নয়। এক দুইবার চেষ্টার পরেই সিলিকন মাস্কটা হয়ে গেল তৈরি! তারপর লাশটা রেখে এলাম আবার মর্গে।”

“বরুণকে নয়াখাল পর্যন্ত নেয়া ছিল সবচেয়ে কঠিন এবং রিস্কের কাজ। রাতে যখন জানতে পারলাম সে কিশোরগঞ্জ যাবে, ওর নিজের গাড়ি সাথে আনেনি এবং ঝড় বৃষ্টির কারণে শহরে রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম কাজ শুরু করতে হবে সে রাতেই। নিজের বানানো ঐ সিলিকন মাস্কটা পরে ফেলি। একদম আঁটসাঁট ভাবে লেগেছে মুখের সাথে। এতোটা পারফেক্ট হবে দেখতে ভাবতেও পারিনি। সত্যি এই মাস্কগুলিকে রিয়ালিসটিক মাস্ক বলার কারণ আছে বেশ। আমি নিজের গাড়ি নিয়ে ওকে পিক করতে চলে গেলাম অফিসের সামনে। যা ভেবেছিলাম তাই। সে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ির জন্য। তারপর ওর সামনে এসে দাড়াতে কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। কণ্ঠ শুনে বুঝে ফেলবে না তো? যতটুক সম্ভব নিজের গলা চড়া করে কথা বলে ওকে রাজি করিয়ে গাড়িতে উঠাই। বাইরের ঝড় বৃষ্টির প্রচণ্ড শব্দ থাকায় আমার সুবিধা হয় এক্ষেত্রে। গাড়িতে স্প্রে আগে থেকেই ছিল। রাস্তায় এক ফাঁকে স্প্রে করে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। তারপর ওকে সে বাড়ির নিচ তলার দিকে এক কক্ষে রেখে ওর ভেতরে স্মৃতি হরণকারী ড্রাগ প্রবেশ করিয়ে দেই। নিজের গাড়িটি ঐখানের মর্গটির পাশেই এক গেরেজে রেখে আসি। খুব ভয় করছিল। তবে কেয়ার টেকার থাকায় রক্ষা। সে সমস্ত ব্যবস্থা করে দেয়। পরের দিন আবহাওয়া ঠিক হলে গাড়ি নিজের বাড়ির গেরেজে রেখে আসি। রেখে আসার সময় দেখতে পাই পাশের বাড়ির ভদ্রলোক বের হচ্ছে কোথাও যাবেন বলে। ভাগ্যিস চোখে একটুর জন্য পড়িনি!” 

“আমার বড় ইচ্ছা ছিল নিজে একদিন কোন এক ফিল্ম শুট করব। সে রাতটায় ঐ ইচ্ছেটা পূরণ হয়। কে জানতো নিজের চরিত্রই আরেকজনকে দিয়ে দিতে হবে এই ফিল্মের ভেতর দিয়ে? তবে নিজের চরিত্র থেকে সরে এসে নিজেকে কলংকমুক্ত করবার মত আত্মতৃপ্তি আর কখনো কোন অভিনেতা পেয়েছে কিনা সন্দেহ! খুব বেশি কিছু করা লাগে নি। বরুণকে বেশ কড়া করে ঘুমের ওষুধ তো দিয়েই রেখেছিলাম। এমন কী তার মগজের ভেতর ড্রাগ ঢুকিয়ে সমস্ত স্মৃতিও কেড়ে নিয়েছিলাম। বাকি ছিল কেবল হিপনোসিস!” নিতিস সেন মুখ তুলে দেখে সামনে বসে থাকা মেয়েটা তার লেখা দেখছে মনোযোগ দিয়ে। কী মা? নাম কী তোমার? পড়তে জানো? মেয়েটা লজ্জা পেয়ে মায়ের কাছে চলে যায়। “ওর নাম রেখা। এখনো পড়তে শিখেনি, সবে মাত্র স্কুলে ভর্তি করিয়েছি।” মা উত্তর দেয়।

“হিপনোসিস করে সাধারণত মানুষের স্মৃতি ফিরিয়ে কোন এক তথ্য বের করে আনার চেষ্টা করা হয়। কখনো নতুন কোন পরিচয়ে কাউকে তৈরি করা যায় না। কারণ ঐ সত্তার স্মৃতি। তার স্মৃতিগুলি কখনই তার ব্রেইনে নতুন কোন সত্তাকে প্ল্যানড করতে দেয় না। তবে আমি যে বরুণের সমস্ত স্মৃতি হরণ করে নিয়েছি সে কখন! সেজন্য বরুণকে হিপনোসিস করে নিজের জায়গায় দাঁড় করানো খুব কঠিন হয় না। বার বার তাকে নিতিস সেন বলে ডাকতে থাকি। নিজের ভেতরে চলতে থাকা কষ্টগুলি তার ভেতরে প্ল্যান করতে থাকি। আমি আগে কখনো এত বড় রকম হিপনোসিস করিনি। এর আগে অফিসে মানুষদের ছোটখাটো রকম হিপনোসিস করে মজা দেখাতাম। পুরো বিষয়টাই আয়ত্ত করেছিলাম বই দেখে। তবে সে রাত্রে নিজের হিপনোটিস করবার ক্ষমতা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই।” নিতিস সেন এক কাপ চা হাতে নেয়। অনেক দিন সে চা খায় না। আজ বেশ আয়েস করে খাবে।

“ঠিক করি তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারব। তবে এক্ষেত্রে চেহারা পুরোপুরি ধ্বংস করতে না পারলে আবার ধরা পড়ে যেতে পারি। তবে আমার মাথায় ওকে পুরিয়ে মারবার চিন্তা বহু আগে থেকেই। সিলিকন মাস্কের একটি রিস্ক হচ্ছে এটিতে আগুন সহজে না লাগলেও যখন দুর্ঘটনাজনিত কারণে লেগে যায় (প্রায় ৩১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মত তাপ লাগে) তখন পুড়ে কয়লা হয়ে যায় এতোটা জরালো ভাবে আগুনের সাথে বিক্রিয়া ঘটায়। সেজন্য সময় নিয়ে সারারাত লাগিয়ে তার মুখের জন্য একটি সিলিকন মাস্ক বানাই। তার মুখটা যেন পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারি। উপকরণ সব এখানেই এনে রেখেছিলাম অনেক আগে। যেবার নিজের জন্য মাস্কটা বানাই। হুট করে ভয় লাগে লাশটি নিয়ে। কারণ লাশের চেহারা নিয়ে ঘুরছি আমি। যার লাশ তার কোন আত্মীয় দেখে ফেললে? পরেরদিন যে ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়ানো হবে সে ঘরে বরুণকে নেয়ার আগে সেখানে মর্গ থেকে লাশ নিয়ে আসি। লাশের মুখ নিয়েও চিন্তা হয়। তবে করার কিছুই ছিল না। আমার সব উপকরণ শেষ। লাশ নিয়ে রেখে আসার সময় দেখি ফ্লোর থেকে কিছু উপকরণ তার ঠোঁটে মুখে লেগে ঐ ঘরে এসে পরেছে তার সাথে। পরবর্তীতে এইটি দেখেই বরুণ চিৎকার করে উঠে কিনা!” নিতিস সেন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেয়।

“বরুণ, আমি তোমার সঙ্গে মোটেও খুব অবিচার করিনি। কী সুন্দর ভাবে কাফনের কাপড় পরিয়ে তোমাকে প্রস্তুত করে আগুনে সৎকার করেছি। তোমাকে একা একা মরতে দেইনি। তোমার সাথে একজন সঙ্গীও রেখে গিয়েছি। সে সঙ্গীর নিজেরও সৎকার এর প্রয়োজন ছিল। কতদিন আর এভাবে মর্গে পরে থাকতো বলো? আমি দুইজনকেই দিয়েছি পবিত্র মৃত্যু। দেয়ালে লিখে গিয়েছি তোমাদের মৃত্যু নিয়ে। সমস্ত ক্লু দেয়াই ছিল তোমাদের চোখের সামনে।”

“তারপর আর কী? রেখে আসতে গেলাম তোমার আর আমার জিনিসপাতি গাছের দিকটায়। আমি তোমার কাপড়গুলি পরে ফেললাম। ঘরে আগুন লাগিয়ে ফিরবার সময় ভয় করছিল এই ভেবে যে দেয়ালের লেখাগুলি যদি থেকে যায়? আমার হাতের লেখা দেখে আবার কিছু বুঝে ফেলবে না তো? অবশ্য চিনলেও করবার কিছু ছিল না। মাঝে মাঝে প্ল্যানের বাইরে কিছু ঘটলে মন্দ হয় না। বিধাতাও সে রাতে প্ল্যানের বাইরে গিয়ে মৃদু বৃষ্টির মাঝে এক বজ্রপাত ফেলে দেয়। আগুনে পুড়তে থাকা বাড়ির উপর সেই ইলেকট্রিক স্পার্ক এসে পরলে আগুন আরও বেড়ে যায়। আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। এত তীব্র আগুন আগে কখনও দেখিনি!”          

“আপনার নাম কী?” রেখা মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করে।

আমার নাম? উমমম… আমার নাম উৎপল। তুমি আমাকে উৎপলদা বলে ডাকতে পারো।” নিতিস জবাব দেয়।

*****

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (IUT)

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯

হাসিন ইশরাক

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯