যে সমাজে ক্ষমতার জয়জয়কার, সেখানে গড়পড়তা ‘মেধাবি’ থাকলেও সত্যিকারের সাধক থাকেন ক’জন? চিন্তার দুরদর্শিতা দেখানোর নৈতিক দুঃসাহসই বা ক’জন পায়? এইরকম এক সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির মানবিকায়ন ঘটানোর মতো কান্ডারির সন্ধান পাওয়া কি এতই সহজ?
উত্তর তো সবার জানা। কালেভদ্রে এমন বড় মাপের চরিত্রের দেখা মেলে। নোঙর আঁকড়ে রাখা ব্যক্তির সংখ্যা এ সমাজে নিতান্তই অল্প।
তেমনিই একজন ব্যক্তি আমার প্রিয় শিক্ষক ড. এম আতাহারুল ইসলাম। যাকে শনাক্ত করতে হয় তাঁর নিষ্ঠা, দায়িত্বপূর্ণ আচরণ ও সংবেদনশীল মনের নিরিখে। অমোচনীয় মানবিকতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন ‘পিতৃপ্রতিম ভালোবাসা’।
শ্রদ্ধেয় এই শিক্ষকের সান্নিধ্যে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। খুব কাছে গিয়ে দেখেছি, তিনি শুধু পাঠ্যবইয়ের শিক্ষক ছিলেন না; জীবনের নানা বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। চরম হতাশায় নুয়ে পড়া শিক্ষার্থীকেও ঘুরে দাঁড়ানোর উৎসাহ দিতেন।
পরিসংখ্যানে থিওরিটিক্যাল বিষয়ে জ্ঞান আহরণে ব্যর্থ হয়ে একসময় ভেবেছিলাম অনার্স শেষ করে অন্য বিভাগে পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়বো। পরিসংখ্যানে পড়া এদেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কর্মক্ষেত্রে অন্য জায়গা (সেক্টর) বেছে নেয়। তাই আমিও আগেভাগে চলে যাওয়ার কথা ভাবি।
এমন ভাবনা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সবুজ ক্যাম্পাস ছেড়ে ইট পাথরের ঢাকায় চলে আসি। এমবিএতে ভর্তির জন্য বছরখানেক চেষ্টা করি। একসময় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) এমবিএ ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেলাম। ইন্টারভিউ বোর্ডে শিক্ষকদের মন্তব্য শুনে মনে হলো, আমার ‘মূল’ হচ্ছে পরিসংখ্যান। এখান থেকে পালিয়ে বেড়ালে হবে না। তাই এমবিএতে সুযোগ পাওয়ার পরও সিদ্ধান্ত পাল্টে ভর্তি হলাম ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগের মাস্টার্স কোর্সে।
এখানে এসে দেখা বন্ধু সেজানের সঙ্গে। তার কাছেই জানতে পারলাম ওই ডিপার্টমেন্টে আছেন প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ড. আতাহারুল ইসলাম। তাঁর সম্পর্কে অনেক প্রশংসাও শুনলাম।
পরবর্তীতে এডভাইজিংয়ের সময় শিক্ষক আতাহারুল ইসলামের কোন কোর্সই দেখলাম না। আমি একটু অবাকই হলাম। এত ভালো শিক্ষক, কিন্তু কোন কোর্স নেই! পরে শুনলাম তিনি অসুস্থ, তাই এই সেমিস্টারে কোন কোর্স নিচ্ছেন না।
তো, খুব ভালোভাবেই প্রথম সেমিস্টার পার করলাম এবং পুরো সেমিস্টার জুড়েই আতাহার স্যারের অনেক প্রশংসা শুনলাম। পরবর্তী সেমিস্টারে স্যার নেবেন সারভাইভাল এনালাইসিস কোর্স। আমি কোনকিছু না ভেবেই কোর্সটি নিলাম। কিন্তু ওই কোর্সের একটি প্রি-রিকোইজিট কোর্স ‘জেনারালাইজড লিনিয়ার মডেলিং’ করা দরকার ছিল, যা ইউনিভার্সিটি পরে অফার করে। ওপেন ক্রেডিট কোর্স সিস্টেম হওয়া স্বত্তেও সবসময় সব কোর্স অফার করে না।
স্যার ক্লাস নেয়া শুরু করলেন, সারভাইভাল এনালাইসিসের মতো একটি কঠিন কোর্স। প্রি-রিকোইজিট কোর্স করা না থাকা সত্ত্বেও অনেক ভালো বুঝলাম। ‘ভালো বুঝলাম’ একারণে বললাম, পরবর্তীতে ওয়ার্কলাইফে (ইন্টার্ন করছিলাম তখন) একটা সময়ে কক্স হ্যাজার্ড মডেল ফিট করতে হয়। সবাই বলেছিল, লজিস্টিক মডেল এপ্লাই করতে। কিন্তু আমার স্যারের লেকচার মনে ছিল। আমি টাইম ডিপেন্ডেট সিনারিও হওয়াতে কক্স হ্যাজার্ড মডেলই এপ্লাই করি। একজন ইন্টার্ন হওয়ার পরেও এভাবে নিজে থেকে ডিসিশন নিতে পারার কনফিডেন্স স্যারের ছাত্র হওয়ার কারণেই পেরেছিলাম।
তো, খুব ভালোভাবে স্যারের কোর্স শেষ করলাম। আমি ভেবেছিলাম এই কোর্স এত ভালো পারার কথা না। এখানেই স্যারের বিশেষত্ব। স্যার খুব সহজ করে, প্রি রিকোইজিট কোর্স না করা সত্ত্বেও তাঁর শিক্ষার্থীদের বোঝাতেন।
পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে ডিপার্টমেন্টের আরেক শিক্ষার্থী মাহিবের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। সেও বললো, ‘ভাই এখানেই স্যার অন্য সবার থেকে আলাদা। আমরা অনেকে অন্য ব্যাকগ্রাউন্ড হওয়া সত্ত্বেও স্যারের প্রত্যেকটি লেকচার অনেক সহজে বুঝতে পারি।’
বিভিন্ন সময় স্যার আমাদের সঙ্গে রিয়েল লাইফে থিওরিটিক্যাল বিষয়গুলোর প্র্যক্টিকেল প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। স্যার একজন জার্মান শিক্ষার্থীর গল্প বলেছিলেন, সেই শিক্ষার্থীরও আমার মতোই অভিজ্ঞতা।
যাই হোক, শেষ সেমিস্টারে থিসিস করবো। আমার ইচ্ছে আতাহার স্যারের তত্ত্বাবধানে কাজ করার। কিন্ত স্যারের অনেক ব্যাস্ততা এবং তখন আরো অনেকে স্যারের কাছে থিসিস করছিলেন। স্যার খুব নির্ভুলভাবে কাজ করতে চান বলে থিসিস শেষ করতে করতে তাদের কয়েক বছর লেগে যাচ্ছিল। আমি হতাশ হয়ে ডিপার্টমেন্টে ঘোরাফেরা করতাম। স্যারের কাছে যাওয়ার সাহসও পেতাম না।
এদিকে, ডিপার্টমেন্টের আরেকজন স্যার চেয়েছিলেন আমি যেন তাঁর তত্ত্বাবধানে থিসিস করি। একদিনের ঘটনা, ক্লাস করতে লিফটে উঠছি, আতাহার স্যারও একই লিফটে উঠলেন। আমি স্যারকে সালাম দিলাম। স্যার নিজে থেকেই অনেক কথা বললেন, বললেন পরীক্ষায় কোথায় ভুল করেছি। স্যারের কথায় একটু সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেললাম, আমি তাঁর তত্ত্বাবধানে থিসিস করতে চাই। স্যার না করে দিলেন, স্যারকে বোঝালাম আমি পারব। আমি চাকরি করি না, তাই সময়মতো শেষ করবো বলে কথা দিলাম। পরবর্তীতে আমি সেই কথা রেখেছি এবং স্যারের তত্ত্বাবধানে থাকা সব শিক্ষার্থীর আগেই শেষ করি আমার গবেষণার কাজ।
একদিন স্যার থিসিসের জন্য অনেকগুলো কাজ দিলেন। আমি রাতজেগে কাজ করে স্যারকে দেখালাম। কিন্তু স্যারের পছন্দ হলো না। আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম সেদিন। তিনি ব্যাপারটা ধরতে পারলেন। স্যার তার সময়ের কথা বললেন, হাতেহাতে ল্যাটিন স্কয়ার ডিজাইন, র্যান্ডমাইজড ব্লক ডিজাইনের ৩×৩, ৪×৪ আরো হায়ার লেয়ারের অংক করার কথা শোনালেন, উৎসাহ দিলেন।
এভাবেই স্যার আমাকে থিসিসের প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যখন থিসিস এর কাজের জন্য দেখা করতাম তখন শুধু সেই সংক্রান্ত আলোচনাই নয়, বরং জীবনের নানা বিষয় ও ক্যারিয়ার গঠনের পরামর্শ দিতেন। মানুষ ও সমাজের জন্য কিছু করার কথা বলতেন।
ওই দিনগুলো ছিল আমার জীবনের অন্যরকম মুহূর্ত, যার ফলে নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছি। যে আমি পরিসংখ্যান ছেড়ে অন্যকিছু করার কথা ভেবেছিলাম, আমার সেই চিন্তা আমূল পাল্টে দিয়েছেন আতাহার স্যার।
স্যারের সঙ্গে পরবর্তীতেও নানা বিষয়ে কথা বলতাম। অসুস্থতার সময়ও যখনই ফোন দিয়েছি স্যার কথা বলেছেন। স্যারের মৃত্যু অপূরণীয় এক ক্ষতি। একটি নক্ষত্র ও তাঁর স্নেহময় স্পর্শ হারালাম আমরা। গভীর বেদনার মাঝেও তৃপ্তি একটাই- স্যারের দাফনের সময় থাকতে পেরেছি, কবরে মাটি দিতে পেরেছি।
ওপারে ভালো থাকবেন স্যার….
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ফলিত পরিসংখ্যান বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
- This author does not have any more posts.