fbpx

কন্তকালিনীর কান্না

আমাদের বাড়ি এখন যোদপুরে। ঐ যে খেলার মাঠটা আছে, তার ঠিক দক্ষিণ দিকে মসজিদের পাশটায়। কত শখ করে কিনা বাড়ি! বাবার প্রায় জীবনের অর্ধেকটা বেঁচে দিতে হলো এই দোতলা বাড়ির জন্যে। অর্ধেক বললেও কম হবে বৈকি। দিনের পর দিন অফিসে যাওয়া আসা, রাত্রি করে বাড়ি ফেরার পরেও কলের পর কল, কাজ থেকে রেহাই নেই। ঘণ্টা দরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার পর শেষমেস বাবার এই দোতলা বাড়ি উঠানোর স্বপ্ন পূরণ হলো। বাড়ির পূর্ব পাশে বয়ে গেছে কন্তকালিনী নদী। সে নদীর থেকে জলের শান্ত ধীর বয়ে চলাও অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায় কলকল শব্দ করে। প্রায় সবকটি ঘর থেকে সে আওয়াজ আমাদের কান পর্যন্ত এসে পৌঁছোয়। দক্ষিণের বাতাসের সাথে নদীর ধারের কাশফুলের গন্ধ একত্রে এসে হাজির হয়। এক কোণায় মসজিদ তো আরেক কোণায় বিস্তৃত মাঠ। এর চেয়ে সুন্দর কোথাও নিজেদের ঠাই পাওয়া নিয়ে কষ্টিকালেও ভাবতে পারি নি। আমরা আছি তাই মহাআনন্দে। কপালে ভাঁজ পরেছে কেবল বাবার। কত জনের থেকে ধার দেনা করে এই ঘর উঠাতে হয়েছে কিনা!

সেদিন বেরিয়েছিলাম পাড়ার এদিক ওদিক একটু ঢু মারবার জন্য। আমি এবার সদ্য ক্লাস সেভেনে। বাসায় কড়া নির্দেশ সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে। এমন কি বাড়ি থেকে কোন দিকে কত দূর যাওয়া আমার ভাগ্যে আছে, সেটাও বাড়ি থেকে ঠিক করে দেয়া। সে যাই হোক, নিজের সীমার ভেতরে যতখানি দেখা যায় তাই সই। বাসায় বসে তো আর থাকা যায় না। এই এলাকায় আসার পর প্রথম যে বিষয় নিয়ে চিন্তায় পরে গেছি তা হচ্ছে বন্ধু-বান্ধব। নতুন স্কুলে ক্লাস এখনো শুরু হয়নি। কেমন হবে এরা কে জানে? মিশবে টিশবে নাকি আবার নিজেরা নিজেরা দল বেঁধে কাঁচকলা দেখিয়ে চলে যাবে সেও বা কে জানে! ইতিমধ্যে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে টের পেয়েছি, যেদিকেই যাই না কেন মানুষজন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। আরে বাবা! অমনি করে দেখার কী আছে হ্যাঁ? নতুন করে কি কেউ আসতে পারে না তোমাদের মাঝে?

হাঁটছি তো হাঁটছি। নদীর তীর ধরে হাঁটতে খারাপ লাগে না বৈকি। কাশফুলের গন্ধ, ঠাণ্ডা এক বাতাস, পাখির ডাক আহা! বেশ খিদে পেয়ে গেছে এর মধ্যে। নতুন জায়গার নতুন কী কী খাবার আমার জন্য অপেক্ষা করছে একটু ঘুরে দেখে এলে খারাপ হয় না। আমি আবার খাবার বলতেই পাগল। সে খাবারের সন্ধান পেতে আবারো হেঁটে যেতে লাগলাম বাজারের রাস্তায়। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর যখন অনেক দূর থেকে আজানের শব্দ শুনতে পেলাম তখন মাথায় এলো সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হাতে একদমই সময় নেই। এহহে! আজকে আবার পিটুনি খাওয়া লাগবে যে! আমি পথের মাঝে দাঁড়িয়ে ভাবনার পাহাড় গড়ে তুলছি কীভাবে এখন বাড়ি পৌঁছানো যায় সন্ধ্যার আগে। ভাবনার মাঝে মায়ের মুখ থেকে যেসব কড়া কড়া কথা ছুটে আসবে সেগুলিও যেন শুনতে পাচ্ছি। আর সে সাথে বুকের ভেতর কাঁপুনি দিয়ে উঠছে। হুট করে খুব বিচ্ছিরি ভাষায় গালাগাল শুনতে পেলাম। শুনে নিজেই অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। এটাও কি কল্পনা! ধুর না। মা বকা দিলেও গালাগালি দিবে না। এতোটাও খারাপ না। তাহলে কে? ক্রমাগত গালাগাল করতেই আছে সে কণ্ঠ। কী যে বিচ্ছিরি সেসব গালাগাল! সবগুলির অর্থও জানি না।

হুট করে চোখ পড়ল কিছুদুরে বাজারের মাঝেই এক দোকানের কোণায় বসে থাকা এক লোকের দিকে। পরনে ছেঁড়া এক গেঞ্জি আর লুঙ্গি। গেঞ্জির রঙ ময়লা জমতে জমতে কালচে হয়ে গেছে। তার চেহারা দেখার আগেই তার চেঁচামেচি আর রাগের মাথায় হাত-পা ছুড়াছুড়ি চোখে পরে। লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে যেমন ভয় ভয় করছে, আবার ঘটনা কী বুঝবার জন্য চোখ ফেরাতেও পারছি না। এমন সময়ে সে লোক আমার দিকে দৃষ্টি দেয়। ভয়ে তো আমার আত্মা শুকিয়ে যাবার উপক্রম। আমাকে দেখে চুপ মেরে যায় খানিক সময়। তারপর আবার গালাগাল শুরু। তবে এবার আমার দিকে তীব্র বেগে ছুটে আসছে সে শব্দগুলি। কী উঁচু স্বর! আমি পালাব কিনা ভাবছি। অবশ্য পালাতে গেলে যদি আমার পিছে দৌড়ে আসে? তখন আমাকে বাঁচাবে কে! মা তো বাসায়। বুক যে শুকিয়ে গেল ভয়ে। মায়ের বকুনি, পিটুনি এখন আর কিছুই না আমার সামনে। এই যাত্রায় কেটে পড়তে পারলে হয়।

হঠাৎ করে আমার কাঁধে একজনের হাত এসে পড়ল। আমি কেঁপে উঠে হুড়মুড় করে পাশে সরে তার দিকে ফিরলাম। “ভাল আছ বাবা? ভয় পাচ্ছ বুঝি? আরে সে পাগল, বদ্ধ উন্মাদ। এত ভয়ের কিছু নেই খোকা। পাগলের কি আর কাম-কাজ থাকে কোন বলো? সারাদিন চেঁচিয়ে মেজাজটা খারাপ করে দেয়।” এই বলে লোকটা আমার কাঁধ থেকে নিজের হাত নামায়। তারপর খুব কড়া গলায় পাগলটার সামনে গিয়ে মা-বাপ তুলে কী যেন গালি দিয়ে, হাত উঁচু করে চড় মারবার হুমকি দিয়ে আসে। মুহূর্তের মাঝে ঐ পাগল লোকটার গালাগাল চুপ হয়ে যায়। আমিও এই সুযোগে বাসায় ফিরবার জন্য হাঁটা ধরি। পাগল লোকটার সামনে দিয়েই যেতে হবে। ধীরে ধীরে কদম ফেলে যাবার সময় লোকটাকে আরেকটিবার দেখে যাই। এই প্রথম তার মুখ ভাল করে নজরে পড়ে। বেশ শান্ত এক চাহনি। চোখে বিন্দুমাত্র হিংস্রতা নেই। বয়স বেশি হলে পঁচিশ। চেহারাটা মাথায় পাক খাওয়াতে খাওয়াতে হাঁটতে থাকি। পথের শেষ প্রান্তে যেতে না যেতেই আবার সেই বিচ্ছিরি গালাগাল কানে আসে।

*****

নতুন বাড়িতে কাশফুলের গন্ধের সাথে যে গন্ধ বেশ প্রকট আকার ধারণ করে আছে তা হচ্ছে কাঁচা রঙের গন্ধ। দেয়ালগুলি রঙে রঙে ঝকমক করছে আর গন্ধ ছড়াচ্ছে। সকালের মৃদু রোদ এসে জানালা দিয়ে জানান দিয়ে গেছে যে উঠতে হবে। আমি চোখ আধো খোলা অবস্থায় ঘড়ি দেখে আবারো চোখ বন্ধ করব কিনা ভাবছি। ইদানিং খুব আরামের এক সময় পার করছি। কোন ক্লাস নেই, ঘুম থেকে উঠবার তাড়া নেই। নিশ্চিন্ত জীবন। শুধু সময় মত খাওয়া, গোসল করা আর বাড়ি ফেরা এই নিয়ে একটু সচেতন থাকা। বিশেষ করে সেদিন সন্ধ্যার পর ফেরায় মায়ের হাতে যে মার খেতে হয়েছে, ঐ দাগ পিঠে নিয়ে বাড়ি ফেরার ব্যাপারটায় অন্তত সতর্ক থাকাই লাগে।

প্রায় প্রতিদিন ই পাগল লোকটার কাছে যাওয়া হয় আজকাল। জানি না কেন যাচ্ছি। তবুও কিসের টানে যেন ঐ লোকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কৌতূহল বোধ হয়। প্রতিদিনই বাজারের পথ ধরা মাত্র তার গলায় গালাগালের শব্দ ভেসে আসতে শুরু করে। যতই কাছে যেতে থাকি সে গাল গুলি আরও প্রকট ভাবে আমার কানে নিজেদের জায়গা করে নিতে থাকে। কখনো দেশকে নিয়ে, কখনো সমাজকে নিয়ে, কখনো আবার অচেনা কিছু নাম ধরে কত গালমন্দ! একের পর এক গালাগাল ছুটে যেতেই থাকে তার গলা বেয়ে। একদম ই নিরলস সে কণ্ঠ। খুব ই অবাক লাগে এত সময় ধরে এক টানা কীভাবে এত গাল দিয়ে যেতে পারে একজন? তার মনে কি এতই বিতৃষ্ণা এই সমাজের প্রতি? এতই বিতৃষ্ণা এই দেশের প্রতি? কী হয়েছে তার জীবনে যার জন্য এত ক্ষোভ! উত্তর জানার বেশ ইচ্ছা আমার। যদিও সে উত্তর জানার জন্য কখনো সামনে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবার সাহস হয় নি। অন্য কারো সে নিয়ে মাথা ব্যথাও দেখা যায় নি। কাউকে ঐ লোক নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা মাত্রই তার মুখের পরিবর্তন বলে দেয় সেই প্রাণের মূল্য কত নগণ্য। কত তুচ্ছ সে আত্মা, কত তুচ্ছ তার অস্তিত্ব! 

আমার হাতে দুটি রুটি নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সামনে অনবরত গালাগাল করে যাচ্ছে সে কণ্ঠ। কেন জানি আজকে তার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসার ইচ্ছা হয়েছে। বাসায় জানাই নি। মা আবার কী না কী  ভেবে বসে! লুকিয়ে দুই খানা রুটি নিয়ে এক ছুটে নদীর পার দিয়ে বাজারের পথ ধরে পাগল লোকটার সামনে। সে ঐ একি গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে বসে আছে। এতো শান্তভাবে বসে এত তীব্র ক্ষোভ কেউ কীভাবে প্রকাশ করে কে জানে?! একদিকে খুব মায়া কাজ করছে, আরেকদিকে ভয়। কীভাবে রুটি দুটি দিব বুঝে উঠতে পারছি না একদম। কোন থালা হলে ভাল হত। কারো কাছ থেকে চেয়ে নিব কি? আশেপাশে তাকাতেই এক লোক চলে আসলো। তাকে কিছু বলবার আগেই সে হাত থেকে রুটিগুলি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “পাগলটারে দিবা বাবা?” আমি মাথা নাড়লাম। ঐ লোক তখন বিন্দুমাত্র দেরি না করে রুটিগুলি সাথে করে নিয়ে পাগলটার সামনে ছুড়ে ফেলল। “ওমা এ কী!  আপনি মাটিতে ফেললেন কেন? কী আশ্চর্য!” লোকটা আমার কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে লাগল,” দেখসস তোর জন্য পোলাডা কত কষ্ট কইরা রুটি নিয়া আইসে? খা এইবার মন জুইরা।”

আমি সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। সারাক্ষণ বাজার জুড়ে চলতে থাকা গালাগালের শব্দের সমাপ্তি ঘটে কিছু মুহূর্তের জন্য। পাগল লোকটা মাটিতে পরে থাকা রুটিগুলি হাতে নিয়ে ঝারতে থাকে দুই হাত দিয়ে। কিছু বালি, কিছু মাটি লেগে থাকা ঐ রুটিগুলিতেই তারপর একের পর এক কামড় বসিয়ে গপাগপ খেতে থাকে সে। লোকটা এতোটা ক্ষুধা নিয়ে বসে ছিল দেখে অবাক ই লাগলো খুব। কী অদ্ভুত! তাকে কি কেউ খেতেও দেয় না? আমি পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে তার খাওয়া দেখলাম। স্বভাবত মানুষের খাবার সময়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পক্ষে আমি নই। তবে লোকটা এতো তৃপ্তি নিয়ে, স্বস্তি নিয়ে খাচ্ছে! সেটা দেখে আমার পক্ষে সরে যাওয়া সম্ভব হলো না। দুটা রুটি যে কেউ এতোটা তৃপ্তির সাথে খেতে পারে জানা ছিল না। আমি মুগ্ধ হয়ে তৃপ্তি দেখতে লাগলাম। খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে তখন হাঁটা ধরলাম বাড়ির পথে। যেতে যেতে শুনতে পেলাম আবার জোর গলায় গালাগাল শুরু হয়েছে।

সেদিন বিকালেই আবার পেঁয়াজ কিনতে মা বাজারে পাঠায়। বাজারে গিয়ে পেঁয়াজ কিনা শেষ করা মাত্রই গালাগালের শব্দ শুনে একবার দেখে আসব বলে ঠিক করি। হাঁটতে থাকি পথ ধরে। প্রকট হতে থাকে সেই চেঁচামেচির শব্দ। ঐদিন কোন এক কারণে বাজারে অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছিল। তাদের ভিড় ঠেলে যেতে থাকি। যেতে যেতে এক পর্যায়ে যথাস্থানে দোকানটার সামনে ঐ লোকটাকে দেখতে পাই। ভিড়ের মাঝে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে। কণ্ঠে গাল, চাহনিতে স্থিরতা। কোন রকম হিংস্রতা ছাড়াই জগতের প্রতি ক্ষোভ ঝেড়ে যাচ্ছে। তবে জমায়েত হওয়া লোকগুলির মাঝে ভীষণ বিরক্তি। আমি দূর থেকে তাদের কথোপকথন শুনে যাই। কথোপকথন অনেকটা এমন-

“এই জিনিস এহানে ক্যান? এডারে সরা এহনি।”

“আরে ভাই কইয়েন না আর! মাথাডা পুরা জ্বালা কইরা ছারল। এমনিতেই হাই প্রেসার।”

“ঐ থাম কইলাম!! নাইলে তোর এই গেঞ্জি আর লুঙ্গি খুইল্লা পুরা বাজার ঘুরামু কইলাম।”, হো হো করে হেসে উঠে কয়েকটা কণ্ঠ। কেউ কেউ “ঠিক কইসেন” বলে সম্মতি দিতে থাকে। 

“দুইটা কইসা লাগান না ক্যান?”

“এডিরে ধরতেও তো ঘিন লাগে।”

“অত ঘিন লাগলে কি চলব নাকি মিয়া? দেহেন আমারে ক্যামনে চুপ করানি লাগে।”

ঠাস করে এক শব্দ শুনা যায়। গালাগাল থেমে সমস্ত বাজারে থমথমে এক পরিবেশ দেখা দেয়। সবাই ফিরে তাকায়। খুব মুচকি এক হাসি দিয়ে তাদের বেশিরভাগ আবার যার যার বাজার করতে লেগে যায়। কেউ কেউ আবার একে অপরের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দেয় উচিত কাজ করা হয়েছে। এতক্ষণে শান্তি এসেছে। শুধু আমার মাঝেই হাসি চলে যায়। খুব ভার হয়ে আসে মন। প্রচণ্ড রাগও লাগে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ির পথে হাঁটা ধরি।    

*****

দেখতে দেখতে শীতকাল চলে এসেছে। কন্তকালিনী নদীর স্রোত কমে একদম প্রাণহীন। অবশ্য এই প্রাণহীনতার মাঝেও সে তার কলকল ধ্বনি ঠিক ই শুনিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির যেদিকটায় মাঠ, সেদিক পুরোপুরি কুয়াশায় ঢাকা। যোদপুরের শীত যে এতো প্রচণ্ড তা নিয়ে ধারণা ছিল না। বাসার বাইরে যাওয়া একদম ই বন্ধ তখন। সত্যি বলতে কনকনে শীতে নিজেরই লেপ ছাড়তে ইচ্ছা করে না। আহ! কী আরাম। মায়ের আবার নতুন শখ জেগেছে এর ভিতরে। বাসার দোতলায় বাগান করে ফেলেছে বিশাল। গাঁদা ফুল ফুটে আছে রাশি রাশি। গাঁদার গন্ধে মৌ মৌ করে ঘর। রোদের দেখা পেতে পেতে বেলা বারোটা বেজে যায়। এর মাঝেই বাসায় পিঠা বানানোর ধুম পরে। বেশ কিছু বন্ধুও জোগাড় হয়ে যায়। বাড়ির ছাদে তাদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলি রাতভর। সকালে বেলা করে উঠে গুড় আর খেজুরের রসে ডুবিয়ে পিঠা! ভাপা আর চিতইয়ের স্বাদ মুখে নিয়ে বেশ ভালোই দিন যেতে থাকে।

ঐদিন রাতে একটু আগে আগেই খেলা শেষ করে ঘরে এসে লেপের ভিতরে শরীর এলিয়ে দেই। শীতের রাতে নীরবতা যেন আরও বেড়ে যায় প্রকৃতির মাঝে। বহু দূরের ঘরের খটখট করে থালা বাসন নাড়বার আওয়াজও পেতে থাকি নিজের ঘরে থেকে। নদীর কলকল শব্দ যেন কানের ঠিক পাশে এসে পরে। একই সাথে চলতে থাকে ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসের শা শা আওয়াজ। ঠিক এমন এক সময়ে আমাকে স্তব্ধ করে দিয়ে দূর থেকে ভেসে আসতে থাকে এক কণ্ঠ,”ভাই কেউ আসেন? কেউ আসেন ভাই??” আমি আবার কণ্ঠটা শুনবার চেষ্টা করি। চেনা চেনা লাগছে। আরে ঐ পাগল লোকটা না? হ্যাঁ, সে-ই তো। এক নাগারে বলে যাচ্ছে, “ভাই কেউ আমারে একটা কম্বল দিবেন? একটা কম্বল দেন না ভাই? ভাই আসেন কেউ??” আমি উঠে দাড়াই। জানালা দিয়ে দেখবার চেষ্টা করি। সে ক্রমাগত করুণ গলায় ডেকেই যাচ্ছে। আমার খুব মায়া লাগতে থাকে। অবাকও হই। এই প্রথম তার কণ্ঠে গালাগাল ছাড়া অন্য কথা শুনছি।

হঠাৎ করে মা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। কিছু বলার আগেই ধমক দেয়া শুরু করে। আমি ভাবলাম মাকে বলি যেন একটা কম্বল দিয়ে আসা হয়। কিন্তু এরপর ই মায়ের কড়া চাহনি দেখে আর কথা না বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পরি। মা চলে যায়। এপাশ ওপাশ করতে থাকি আর করুণ গলায় ঐ লোকটার ডাকাডাকি শুনতে থাকি।” ভাই একটা কম্বল দেন না? একটা কম্বল দেন ভাই।” কণ্ঠ একদম কাছে এসে পরে জানালার। আমি ভাবতে থাকি বাসার দরজা খুলে বাইরে বের হবো কিনা। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে হাঁটতে থাকি। কিছু যদি দিতে পারি। নিজের লেপ দিয়ে দিলে কেমন হয়? না, টাকা দিয়ে দেই। নিজের জমানো টাকা আছে। কিন্তু এত রাতে টাকা পেয়েও তো সে কিছু কিনতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতে সে কণ্ঠ দূরে চলে যায়। আমি এসে শুয়ে পরি। খুব কষ্ট হতে থাকে। এখনো সে করুণ গলা ডেকেই চলেছে।

আমি কণ্ঠ শুনে যাচ্ছি আর বুকের ভেতর হা হা করে উঠছে। এত ঠাণ্ডা বাইরে! যদি লোকটার কিছু হয়ে যায়? আমি নাহয় আজকে কিছু করতে পারছি না, তবে সমাজের এত এত মানুষ। ওরা কেউ ই কি পারে না একটা কম্বল দিতে? এত এত প্রাণের মাঝে এই প্রাণটির মূল্য কি এতই তুচ্ছ? এই শরীর, এই চাল চলন সবই তো শুধু বাইরের আবরণ। ভেতরের প্রাণের মূল্য নির্ধারণ কেউ কীভাবে করতে পারে? আজকে এই জীবনের সমাপ্তি ঘটলে কি পুরো সমাজের কাঁধে এর দায় পড়বে না? আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে। প্রকৃতি যতটা না নিষ্ঠুর, মানুষ তার চাইতেও বেশি। 

এক সময় লোকটির করুণ কণ্ঠ থেমে যায়। থেকে যায় শুধু কন্তকালিনীর কলকল ধ্বনি।

সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (IUT)

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯

হাসিন ইশরাক

সেশনঃ ২০১৮-২০১৯