জুলাই ১০, ২০২৫

অপূর্ণতা দিয়ে গেলেন যিনি

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটু গম্ভীর হন। ছোটবেলা থেকে এই বাণী নানা মুখেই শুনে এসেছি। আসবেন, লেকচার দিবেন, চলে যাবেন; সকলের গুরু। এরকম একটা চিন্তা ভাবনা নিয়েই গুটি গুটি পায়ে পদার্পণ আমার বিশ্ববিদ্যালয় গণ্ডিতে। শিক্ষকদের দেখলেই উল্টো দৌড় দিতাম। না জানি কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন যার উত্তর এই ছোট মাথায় থাকবে না। যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। না জানি কী ভুল করে ফেলি এই ভেবে। বরাবরের মতই আমার মতন চঞ্চল মানুষের জন্য এটা খুবই কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। হয়তো আমার এই কথা ভেবেই আল্লাহ আমাকে এই ডিপার্টমেন্ট এ এনে ঠেকিয়েছেন।

 কলেজ লাইফ থেকেই আমার পড়াশুনা বাদে অন্যান্য কাজের প্রতি আগ্রহ থাকতো বেশি। ফলশ্রুতিতে আমি কলেজের প্রায় সকল ইভেন্টেই কাজ করবার সুযোগ পেয়েছি জীবনে। কলেজ পেরিয়ে এসে এই ডিপার্টমেন্টেও সুযোগ খুঁজছিলাম যে কীভাবে মিশে যাওয়া যায় এই ডিপার্টমেন্ট এর সাথে। আশীর্বাদস্বরূপ আসলো জীবনে কিউএমএইচ স্ট্যাটিসটিক্স ক্লাব। সুযোগ আসলো ডিপার্টমেন্ট এর সাথে কাজ করার। তখন আবার এটা ভেবে অস্বস্তি লাগছিল যে এইবার তো তাহলে সেই ভয়ের জায়গা শিক্ষকদের মুখোমুখি হওয়া লাগবে । এখন কী করবো?

কথাবার্তা অল্প স্বল্প বলতাম, প্রয়োজনের বাইরে যত কম বলা যায় কিন্তু এটা আমার জন্যে স্বভাববিরুদ্ধ কাজ ছিল। আমাকে যারা চিনেন তাদের কাছে একথা বলা এক প্রকার বাহুল্যতাই। যাই হোক, ক্লাবের কাজের জন্য স্বাভাবিকভাবেই একজন স্যারের কাছে যেতে হয়েছিল। প্রথম যেদিন উনার রুমে গেলাম আমার কলিজা কাঁপছিল। ডিপার্টমেন্ট এ আসার পর থেকেই শুধু উনার গুণগান শুনে যাচ্ছিলাম। ভাবতাম উনার বিশেষত্ব কী যে উনার এত প্রশংসা। যখন উনার সাথে কথা বলার সুযোগ হলো তখন আমার এরকম মনে হচ্ছিল যে উনি তো আমার সেই গদবাধা চিন্তাধারার কেউ নন। কথা বলার ধরন, টোন, বাচনভঙ্গি কোনোটাই খুব একটা ফর্মাল ছিল না। উনি নিজের মত করে আলাদা এক কমফোর্ট জোন তৈরি করে রেখেছেন সবার জন্যে। ক্লাবের কাজ যত আগাচ্ছিল, তত উনার সাথে আরও বেশি করে কাজ করার সুযোগ হচ্ছিলো। দেখা হলে দূর থেকেই হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করতেন, “কী অবস্থা অর্নব?”। রুমের সাইড দিয়ে যাওয়ার সময় নিজে ডেকে নিয়ে কথা বার্তা বলতেন। এ যেন সন্তানসুলভ স্নেহ। ভুল করলে উনার সংশোধন করানোর ধাঁচটাও যেন অন্য রকম। মনে এক সুন্দর দাগ কেটে যায়। আমাদের যেকোনো প্রস্তাবকেই উনি সাদরে গ্রহণ করে গিয়েছেন। Students were his first priority.  ALWAYS!

ক্লাবকে উনি নিজের পরিশ্রমে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন এক অন্য উচ্চতায়। লকডাউনে যেকোনো পুরো ডিপার্টমেন্ট অলস সময় কাটাচ্ছে, সেখানে তিনি চালিয়ে গেছেন ক্লাবের কাজ। ক্লাবে আমরা যারা শুরু থেকে কাজ করে যাচ্ছি তারাও জানতাম না যে কী হবে বা ভবিষ্যত প্ল্যান কী। উনি একা হাতে সামলিয়ে গিয়েছেন সব কিছু। নিজে নিজেই সকল কাজ গুছিয়ে রাখতেন যেন স্টুডেন্টদের খাটনি কম হয়। উনি এক অনন্য পর্যায়ের মানুষ।

উনি আর কেউ নন।

আমাদের সকলের প্রিয় তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্যার। সত্যি কথায় উনার মতো মানুষ হয় না। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই উনার নাম শুনতে শুনতে ইচ্ছা হতো কবে থার্ড ইয়ার এ উঠবো আর উনার ক্লাস করবো। তা আর হচ্ছে কই!?

জীবন অপূর্ণতায় ভরপুর। ভালো মানুষগুলোর অপূর্ণতা কখনোই পূর্ণ হয় না। এই অপূর্ণতায় পরিপূর্ণ থাকুক জীবন। আমি নিজেকে গর্বিত ভাবি যে তসলিম স্যারের মাধ্যমে আমি আমার জীবনের গল্পের কিছু পর্বকে সাজাতে পেরেছি। আমার পরবর্তি প্রজন্মকে উনার গল্প আমি আজীবন বলে যাবো। উনি চিরদিন আমার কাছে থেকে অমর হয়ে থেকে যাবেন। ভালো মানুষগুলো তো এমনই হন।

রাফিইউ হোসেন অর্নব সেশন ২০১৮ ১৯
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ

সেশনঃ ২০১৮-১৯ 

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp