জুলাই 12, 2025

অসমাপ্ত

“কী সুতপা, ভালো আছেন?” – প্রথমবার যেদিন তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্যার স্মিতহাসি দিয়ে বিভাগের করিডোরে তাঁর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আমি এই ছোট্ট প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমাদের দেশের সংস্কৃতিই এমন, কোন শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীর কুশলাদি জানতে চাইলে সেই দুর্লভ ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত, তা ছাত্র-ছাত্রীদের জানা থাকে না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে এক প্রকার পালিয়ে এলাম। বলা বাহুল্য, স্যারের এই ছোট্ট প্রশ্ন আমার চোখে স্যারকে সম্মানের অনেক উঁচু স্তরে তুলে দিল। স্যারের প্রতি ভরসার জায়গা তৈরি করে দিল। স্যারের সাথে যতদিন দেখা হয়েছে, যতবার সাহায্য কিংবা পরামর্শের জন্য গিয়েছি, কোনদিন খালিহাতে ফিরে আসি নাই। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, এই বিভাগে এমন একজন ছাত্রও পাওয়া যাবে না যিনি স্যারকে অপছন্দ করেন। ছাত্র-শিক্ষকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ধারণা আমরা প্রথম স্যারের কাছেই পাই।

স্যার তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে আমাদের ক্লাস নিতেন। স্যারের পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে বলার যোগ্যতা আমার হয়ে উঠেনি, কখনও হবে বলেও মনে হয় না।  শুধু প্রমাণস্বরূপ এতটুকুু বলতে পারি- স্যারের ৮টার ক্লাসে আমাদের বরাবর রেকর্ড পরিমাণ উপস্থিতি থাকতো। আমরা সবাই স্যারের ক্লাসে শিখতে যেতাম, পরীক্ষা পাশের মাথাব্যথা আমাদের ছিল না। স্যারের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল – স্যারের প্রশ্ন এমন হবে আমরা সবাই পাশ করব। এখনও মনে আছে, স্যার সব সময় বোনাস প্রশ্ন রাখতেন ইনকোর্সগুলোতে। স্যারের বোনাস প্রশ্ন নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা থাকতো। আসল ইনকোর্সে যা-ই পাই, বোনাস প্রশ্ন পারার পর স্যারের প্রশংসা পাওয়ার জন্য যে দ্বন্দ্ব চলত নিজেদের মাঝে, তা স্যারও হয়তো জানতেন না।

তৃতীয় বর্ষের মাঝামাঝি স্যার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। যেখানে অন্য কোর্সগুলোর একটা ক্লাস হবে না শুনলে আমরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠতাম, সেই প্রথমবার ব্যতিক্রম হল। ততদিনে স্যার আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষকের তালিকায় চলে এসেছেন- স্বাভাবিকভাবেই আমরা বেশ কষ্ট পেলাম। স্যার সুস্থ হয়ে যখন ফিরে এলেন, আমরা বেশ আড়ম্বর করে স্যারকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালাম, কিন্তু সাথে এটাও দেখলাম স্যার তখনও যথেষ্ট ক্লান্ত। আমরা স্যারকে অনুরোধ করলাম, স্যার যেন কিছুদিন পর ক্লাস নেয়া শুরু করেন। সত্যি বলতে কী,  আমরা ধরেই নিয়েছিলাম স্যার আর হয়তো ক্লাস নিতে পারবেন না। স্যার আমাদের অবাক করে দিয়ে প্রজেক্টর দিয়ে চেয়ারে বসে ক্লাস নেয়া শুরু করলেন। কোন ছাত্র এমন আছে যে শিক্ষকের এই প্রচেষ্টাকে পাশ কাটিয়ে ক্লাস মিস করবে? আমরা আবার কোর্স শুরু করলাম এবং স্যার সফলতার সাথে কোর্সটি শেষও করলেন। ঐ বছর যদি স্যার কোর্সটি ছেড়ে দিতেন, আমরা বেশ বিপদে পড়ে যেতাম। স্যার নিজের শারীরিক কষ্টকে পাশে রেখে আমাদের কী উপকার সে বছর করেছেন, সেটা আজ এসে বুঝি। তাঁর শিখানো বিষয়গুলো এখনও আমাদের কর্মজীবনে প্রতি মুহূর্তে কাজে লাগে এবং স্যারের কথা আমরা যে যার স্থান থেকে শ্রদ্ধাভরেই স্মরণ করি।

৬১ ব্যাচ
ছবিঃ ৬১ তম ব্যাচের সাথে তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্যার

স্যারের মধ্যে এক অদ্ভুত ইতিবাচকতা ছিল। তিনি কিছু না বলেও মনের মধ্যে অন্যরকম একটা আত্মবিশ্বাস এনে দিতে পারতেন। মনে আছে, চতুর্থ বর্ষে স্যার Newton Raphson Method এর কোড পড়াচ্ছিলেন। স্যার আমাকে বিশেষ জোর দিয়ে বললেন আমি যেন ভালো করে ব্যাপারটা বুঝে নিই, যাতে ভবিষ্যতে তত্ত্বীয় পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করতে আমার কোডিং নিয়ে সমস্যায় পড়তে না হয়। স্যার শিক্ষার্থীদের উপর যে আস্থাটুকু দেখাতেন সেটাই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে মনে ছাপ রেখে গিয়েছে। থিসিস নেয়ার সময়ও স্যারের কাছে গেলাম উপদেশের জন্য। তিনি আমার আশঙ্কা দেখে হাসতে হাসতে বললেন, “আরে চিন্তা কইরেন না। লটারি হইলেও ওইটায় আপনার নাম কেমনে উঠানো যায় আমি দেখতেসি!” সামনের বেঞ্চে বসে আমার নিচু স্বরে বলা কথা কিংবা বান্ধবীর কাছে পাঠানো চিরকুটের জন্য স্যারের সাবধান-বাণী কম শুনিনি। শিক্ষকতা পেশায় আসার পর বুঝি – আসলে কতোটা বিরক্তই না করতাম স্যারকে, তিনি কোনদিন বুঝতেই দেন নাই। স্যারের মতো ছাত্র-বান্ধব শিক্ষক শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, পুরো বাংলাদেশেই হাতে গোনা।

আমাকে গত কয়েকদিনে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে, স্যার ছাড়া বিভাগে গিয়ে কেমন লাগে। একটু রূঢ় শোনালেও সত্য, আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। আমার এটাই এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে স্যার নেই। স্যার অসুস্থ থাকলেও বিশ্বাস ছিল স্যার সুস্থ হবেনই। যেদিন সে অলক্ষুণে সংবাদের ফোনকল এলো, আমি প্রথমে ভেবেছি তিনি হয়তো আবার হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু, সেদিনই আমি প্রথম ও শেষবারের মতো স্যারের গম্ভীর মুখশ্রী দেখেছি

কেমন যেন ঘোরের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে স্যার হয়ত গিয়েছেন কোথাও, ছুটি শেষে আবার ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে, লাউঞ্জে বসে এই লেখনী পড়ে হেসে বলবেন “কী যে লিখসো সুতপা…”। স্যারের অসমাপ্ত গল্পের হাল স্যার নিজে যদি এসে ধরতেন!!

যেখানেই আছেন ভালো থাকবেন, তসলিম স্যার। আমি জানি, আমাদের সবার সাথে আপনার আবার দেখা হবে। মাঝের এই সময়টুকু বিধাতা আপনাকে শান্তিতে রাখুক।

02 copy
প্রভাষক | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ৬১ তম ব্যাচ

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ