এভাবে একটা স্মৃতিকথা লিখতে হবে কখনোই ভাবিনি। বলছি আমার বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মী অধ্যাপক ড. তসলিম সাজ্জাদ মল্লিকের কথা। তাঁর সাথে কত যে স্মৃতি, কোনটা রেখে কোনটা লিখি। আর কিইবা লিখি। এত সহজে একজন মানুষ হারিয়ে যায়! যেদিন সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল (২৭শে জানুয়ারী, ২০২১) তার দু’দিন আগেও কথা হল তাঁর সাথে। আমাকে দু’বার ফোন দিয়েছিলো, আমি ফোন ধরতে পারিনি। পরে কলব্যাক করলাম। বললাম, “আমি তো চতুর্থ বর্ষের রেজাল্টটা জমা দেয়ার জন্য রেজিস্ট্রার বিল্ডিং-এ গিয়েছিলাম, তাই তোমার ফোনটা ধরতে পারি নাই, দুঃখিত।” তখন পারতু (ওর ডাক নাম) বলেছিল, “মুরশীদা, তুমি কি কাজ ছাড়া থাকতেই পারো না?”
এরপর দুই একটা কথার পর হঠাৎ করে ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল। বলল, “আচ্ছা মুরশীদা, তোমার মনে আছে, আমি আর তুমি যে একসাথে, একই সময়ে ২০০০ সালের মার্চে ভূঁইয়া স্যারের (তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোখলেছুর রহমান ভূইয়া) কাছে গিয়েছিলাম বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদানের জন্য? তোমার কি মনে পড়ে?” আমি বললাম, “মনে পড়বে না কেন?”
এরপর বলল, “প্রফেসর হওয়ার পরও কিন্তু আমি আর তুমি একসাথে লুৎফর স্যারের (তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক লুৎফর রহমান) কাছে গিয়েছিলাম জয়েন করার জন্য। তোমার কি মনে আছে?” বললাম, “আমার সবই খুব মনে আছে।”
যেহেতু তার কয়েক দিন আগেই ওর হার্টে স্টেন্টিং করা হয়েছে তাই বললাম, “পারতু তোমার এত কথা বলা ঠিক না। তোমার বিশ্রাম করা প্রয়োজন।” ও বলল, “কী যে শুরু করলা তোমরা! কথা বললেই বল যে, কথা বলা ঠিক না।”
তারপর দু’একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিল। এটাই ছিল আমার সঙ্গে ওর শেষ কথা। তার দু’দিন পরেই শুনি আমার সেই সদা হাস্যোজ্জ্বল বন্ধুটি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে!
সবসময়ই সবকিছু নিয়ে মজা করে কথা বলতো সে। এত রসবোধ-সম্পন্ন একজন মানুষ ছিল, যা বলে শেষ করা যাবে না।
যেদিন আমাদের প্রফেসর সিলেকশন ছিল, সেদিন রাতে আমাকে ফোন দিয়ে বলল, “মুরশীদা তোমাকে অভিনন্দন। তুমি এখন প্রফেসর মুরশীদা।” আমি বললাম, “তোমাকেও অভিনন্দন, তুমিও তো প্রফেসর হয়েছো।” তখন বলল, “ও আচ্ছা তাইতো! আমিও তো প্রফেসর হয়েছি, আচ্ছা আমাকেও অভিনন্দন। আমার তো মনে ছিল না।”
এরকমই মজা করে, আনন্দ নিয়ে কথা বলত সবসময়।
তসলিম যে শুধুই একজন ভাল বন্ধু ছিল, তা নয়। সে ছিল একজন ভাল শিক্ষক, ভাল সহকর্মী এবং সর্বোপরি একজন ভাল মানুষ।
বন্ধু হারিয়ে গেল দূর অজানায়, দূর সীমানায়। অনন্তের পথে যাত্রা করল সে। এই পথে একদিন আমাদের সবাইকেই যাত্রা করতে হবে। কেউ হয়ত একদিন আগে অথবা একদিন পরে। জানি বন্ধুর সাথে আর দেখা হবে না। তারপরও মনে হয়, এই বুঝি ডিপার্টমেন্টে গেলেই দেখা হবে।
কবির সুমনের সেই গানের কথা মনে পড়ছে –
“হঠাৎ রাস্তায় অফিস অঞ্চলে
হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে
বন্ধু কী খবর বল
কত দিন দেখা হয়নি।”
বন্ধু আর ফিরবে না, জানি। তবুও তার অপেক্ষায় থাকি, তাকে খুঁজে ফিরি জোছনায়। ওপারে বন্ধুটি ভাল থাকুক, সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকুক, সেই প্রত্যাশায়, সেই প্রার্থনায়।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশন : ১৯৯২ - ৯৩
- মুরশীদা খানমhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a6%b6%e0%a7%80%e0%a6%a6%e0%a6%be-%e0%a6%96%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%ae/বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৪, ২০২৪