জুন ২০, ২০২৫

অপারেশন কিলো ফ্লাইট

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের  শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্নভাবে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করতে থাকে। সড়ক ও নৌপথে গেরিলাদের অতর্কিত আক্রমণে চলাচল ও রসদ সরবরাহে পাকিস্তানিদের বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। কিন্তু  পাকিস্তানিদের গুরুত্বপূর্ণ ঘাটিগুলোতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে আক্রমণ করা যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে যুদ্ধের ফলাফলের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিমান আক্রমণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

কিন্তু তখনও পর্যন্ত আমাদের না ছিল কোন বিমান, আর না ছিল কোন সংঘটিত বিমানবাহিনী। যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা ও অফিসাররা যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তান থেকে বিমান ছিনতাই করে  আসার সময় শহিদ হন।  এ ছাড়া বিমানবাহিনীর বাঙালি অফিসার উইং কমান্ডার এম কে বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিন, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম, ফ্লাইং অফিসার ইকবাল রশীদসহ অনেক কর্মকর্তা ও বিমানসেনা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দু’চোখে ধারণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে গমন করেন।

এ কে খন্দকার ভারতে অবস্থানরত সব দক্ষ বাংলাদেশি বৈমানিক ও বিমানসেনাদের নিয়ে বিমান বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে ভারত সরকারের সার্বিক সহযোগিতা লাভের প্রত্যাশায় মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানান। পরবর্তীতে তাজউদ্দীন আহমদ এ কে খন্দকারসহ ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসেন।

ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল জানান, ভারতের যুদ্ধবিমান এর স্বল্পতা রয়েছে, তাই বাংলাদেশকে কোন যুদ্ধবিমান দেয়া সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশি পাইলটরা চাইলে ভারতীয় কোড ও নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে ভারতীয় ফ্লাইং স্কোয়াড্রনে উড্ডয়ন করতে পারে। কিন্তু এ কে খন্দকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আর একটি স্বাধীন দেশের পাইলট কোনভাবেই অন্য কোন দেশের কোড বা নিয়ম কারণ অনুসরণ করতে পারেন না।

কিছুদিন পর ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত বাংলাদেশকে বিমানবাহিনী গঠনের জন্য তিনটি এয়ারক্র্যাফট এবং উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য ভারতের পূর্বাঞ্চল নাগাল্যান্ড প্রদেশের ডিমাপুর নামক স্থানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত একটি পরিত্যক্ত বিমানক্ষেত্র ব্যবহার করতে দেয়। তবে এই তিনটি বিমানের কোনোটিই যুদ্ধবিমান ছিল না। সেগুলো ছিল অনেক পুরনো মডেলের এবং অত্যন্ত সাধারণ মানের বিমান। এর মধ্যে  ছিল যোধপুরের মহারাজার দেয়া আমেরিকায় প্রস্তুতকৃত ডিসি-৩ ডাকোটা,  কানাডায় তৈরি ডিএইচথ্রি অটার বিমান এবং অন্যটি ছিল ফ্রান্সে তৈরি এলুয়েট থ্রি মডেলের একটি হেলিকপ্টার।

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে অত্যন্ত গোপনভাবে গোড়াপত্তন হয় ক্ষুদ্র বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর, গোপনীয়তা রক্ষার্থে যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘কিলো ফ্লাইট’। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে ৯ জন বাঙালি পাইলট এবং ৫৮ জন প্রাক্তন পিএএফ সদস্যদের নিয়ে এই ইউনিট গঠিত হয়।

Kilo Flight 1

কানাডার তৈরি অটার বিমানটি ছিলো বেসামরিক। রকেট পড লাগিয়ে এটিকে বোমারু বিমানে পরিণত করেন আমাদের বিমানসেনারা। পেছনের দরজা খুলে লাগানো হয় মেশিনগান। এছাড়া ২৫ পাউন্ডের ১০টি বোমা ফিট করা হয় অটারের মেঝের পাটাতন খুলে। অবশ্য বোমাগুলো স্বয়ংক্রিয় ছিলো না। হাত দিয়ে পিন খুলে নিক্ষেপ করতে হতো। ফ্রান্সের তৈরি ছোট আকৃতির অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টারটি আগে বেসামরিক কাজে ব্যবহার করা হতো। এতে মেশিনগান ও রকেট পড যোগ করা হয়। সাথে ছিলো ২৫ পাউন্ড ওজনের বোমা ফেলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। খুব নিচু দিয়ে উড়তে হয় বলে নিরাপত্তার জন্য এর তলদেশে এক ইঞ্চি পুরু স্টিল প্লেট লাগানো হয়। আমেরিকায় তৈরি ডিসি-৩ ছিলো যোধপুরের মহারাজা গজ সিংজির ব্যক্তিগত ব্যবহারের বিমান। এটিকেও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়।

এরপর শুরু হয় প্রশিক্ষণ। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সকাল-বিকেল এবং রাত্রিকালীন উড্ডয়ন কার্যক্রম চলতে থাকে। রাতের অন্ধকারে নিশানায় আক্রমণ চালানোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন যোদ্ধারা।  দুই মাস প্রশিক্ষণ শেষে বিমানযোদ্ধারা চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন।

kilo team

প্রথমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং নারায়ণগঞ্জ জ্বালানি তেলের ডিপোতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কেননা জ্বালানি তেল ধ্বংস করা গেলে পাকিস্তানি সেনাদের জাহাজ ও বিমান অকেজো হয়ে পড়বে। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে দুপক্ষের যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, ঠিক সেই সময় পাইলট শামসুল আলম ও কো-পাইলট আকরাম আহমেদের আওতাধীন অটার বিমানটি ত্রিপুরার মণিপুরের কৈলাসশহরে নিয়ে গিয়ে চট্টগ্রামে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নেয়। অন্যদিকে সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলমের হেলিকপ্টারটির তেলিয়ামুরা থেকে রওয়ানা হয়ে নারায়ণগঞ্জে হামলা করবে বলে ঠিক হয়।

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। গভীর রাতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম লক্ষ্যের অনেক কাছে গিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। প্রথম তিনবার বোমা লক্ষ্যে আঘাত করলেও সেখানে কোন বিস্ফোরণ ঘটেনি। শত্রুরাও টের পেয়ে যায় তাঁদের উপস্থিতি। গুলি করা শুরু করে ওরা। শামসুল আলম শেষবারের মত বোমা নিক্ষেপ করেন। এবার তিনি সফল হন। একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে ট্যাংকারগুলো। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখায় একটানা তিন দিন আলোকিত ছিল পুরো পতেঙ্গা । একই সময়ে কোনরকম প্রতিরোধ ছাড়াই নারায়ণগঞ্জে সফল আক্রমণ চালান সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম। একাত্তরের ডিসেম্বরে ১৬ ডিসেম্বর এর মধ্যে ইউনিটটি সফলভাবে ৯০ টি অভিযান এবং ৪০ টি যুদ্ধের মিশন পরিচালনা করেছিলো।

বাংলাদেশের ইতিহাসে অপারেশন কিলো ফ্লাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। এই আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে যা আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। সেই সাথে অপারেশন কিলো ফ্লাইট থেকেই মূলত যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যা আজও এই স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশ মুক্ত রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে অপারেশন কিলো ফ্লাইটে অংশগ্রহণকারী সকল অকুতোভয় বীরদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র-

১। উইকিপিডিয়া

২। https://www.quizards.co/কিলো-ফ্লাইট/

৩। https://www.dailynayadiganta.com/opinion/443803/

৪। https://www.youtube.com/watch?v=kFNkxBdNbY0&t=4s

Humayun Kabir
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৮-১৯

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp