জুলাই 12, 2025

মনের মানুষ, প্রাণের মানুষ

সদ্য প্রয়াত সকলের মনের মানুষ অধ্যাপক ডঃ তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্মরণে প্রকাশিত প্যাপাইরাসের বিশেষ সংখ্যাটি (ফেব্রুয়ারি, ২০২১) খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। ত্রিশটি লেখার প্রত্যেকটিই যে অন্তরের গহীন থেকে লেখা, অত্যন্ত আবেগ নিঃসৃত তা মনোযোগী পাঠকমাত্র সহজেই অনুধাবন করতে পারবে। এর মধ্যে ‘পান্থশালা’ নামে আমারও একটি লেখা রয়েছে। কিন্তু সেটা লেখার পরে একটা অদ্ভুত রকমের অতৃপ্তি কাজ করছিল ভেতরে ভেতরে। জনশ্রুতি আছে, মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যাস মহাভারতের মতো মহাগ্রন্থ রচনা করার পরও সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। অন্তরে কোনো এক অতৃপ্তি কাজ করছিল তাঁর। পরবর্তীতে ব্রহ্মার উপদেশে শ্রীমদ্ভাগবত রচনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর মনের অতৃপ্তি দূর করেন। যদিও এই উদাহরণটি এখানে যথোপযুক্ত নয় বরং শিশুসুলভ বটে কিন্তু একজন লেখক তার লেখা নিয়ে পরিপূর্ণ তৃপ্ত নাও হতে পারে, সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয় – সেই উদ্দেশ্যেই এই উদাহরণটি টানা। এছাড়াও এই সংখ্যার লেখকদের মধ্যে বেশ ক’জনের সাথে আমার কথা হয়েছে এবং সবার ক্ষেত্রেই একই বিড়ম্বনা। কেউই তার লেখাটি নিয়ে তৃপ্ত নয়। কী একটা লেখা হয়নি, কী একটা আরও লেখা বাঁকি এরকম একটি অনুভূতি সকলের। তাই নিজের অন্তরকে তৃপ্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে আজকের এই লেখাটি লিখতে বসা।

বরাবরের মতোই স্বল্পপাঠ্য কিন্তু চুম্বকীয় এবং হৃদয়গ্রাহী সম্পাদকীয় অংশে অধ্যাপক ডঃ জাফর আহমেদ খান লিখেছেন, “পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু নাকি পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ – এই ভার মল্লিক স্যার বয়ে যাচ্ছেন কীভাবে!” এই অংশটুকু পাঠকের চোখ অশ্রুসিক্ত করে তুলবে পাঠকের নিজের অজান্তেই। উল্লেখ্য যে, অধ্যাপক ডঃ তসলিম সাজ্জাদ মল্লিকের পিতা শাহাদাৎ আলি মল্লিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক।

অধ্যাপক সায়েমা শারমিন লিখছেন এইভাবেঃ

“…… কোন ব্যাপারে একমত হলে মিটিং চলাকালেই হাই-ফাইভ করতাম আমরা। আমি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ওয়াসিম একদিন বললো, “এখন মিটিং-এ আপনাকে তো টেবিলের অন্যপাশে বসতে হবে, ভাতিজার সাথে হাই-ফাইভ করবেন কিভাবে?” আমি বলেছিলাম, “উই উইল ফাইন্ড আওয়ার ওয়ে।” হায়! ব্যাপারটা সহজ করার জন্যই বোধহয় ও চলেই গেল।“

শেষের দিকে তিনি লিখেছেন, “সেদিন সকালেই ওর ড্রাইভারকে রুম থেকে কিছু জিনিস নিয়ে যেতে দেখেছিলাম। সেটা মনে আসাতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি রুম থেকে জিনিসপত্র নিয়ে গেছ কেন? আর কি অফিসে আসবা না?” ফুপির কথার মান রাখতে গিয়েই কি ও রাত না পোহাতেই চলে গেল!”

অধ্যাপক মোঃ লুৎফর রহমান লিখেছেন, “ভাবতেই চোখে জল আসে এমন অনেক ঘটনাই আছে তসলিমের সঙ্গে, যা লেখার সাহস আমার নেই।“
অধ্যাপক মুরশীদা খানম তাঁর এই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটি সম্পর্কে লিখেছেন, “সবসময়ই সবকিছু নিয়ে মজা করে কথা বলতো সে। এত রসবোধ-সম্পন্ন একজন মানুষ ছিল, যা বলে শেষ করা যাবে না।“

এ জেড এম শফিউল্লাহ এ হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক অনিবার্যতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতার মধ্য দিয়ে-

আর বৃদ্ধ পিতা, মূহ্যমান
ভারাক্রান্ত খাটিয়ার ভারে,
মমতাময়ীর আর্তনাদ
অহর্নিশ আকুতি
“ফিরে দাও তারে।”

শাহনাজ নীলিমা লিখেছেন, “মনে হচ্ছে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙ্গে গেলে জানবো তিনি বেঁচে আছেন, প্রিয় কর্মস্থল পরিসংখ্যান বিভাগের চিরচেনা তাঁর বসার কক্ষে সহকর্মী অথবা শিক্ষার্থীদের সাথে গবেষণার কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন।“

তাসমিয়াহ সাদ সুতপা লিখেছেন, “স্যারের মতো ছাত্র-বান্ধব শিক্ষক শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, পুরো বাংলাদেশেই হাতে গোনা।”

আহসান রহমান জামী লিখেছেন, “অসম্ভব শান্ত আর ধৈর্যশীল ছিলেন আমাদের তসলিম স্যার। একাডেমিক কিংবা নন-একাডেমিক যেকোনো বিষয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলে ধৈর্যের সাথে শুনতেন এবং যদি উনার কাছে সঠিক সমাধান থাকে কেবল তখনই সেইটা দিতেন। কোনো উত্তর জানা না থাকলে সেটা অকপটে স্বীকার করতেন এই বিনয়ী মানুষটা, সাথে কোথায় ঘাটাঘাটি করলে বা কার কাছে গেলে সেই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাবে সে রাস্তাটাও বাতলে দিতেন।“

সাকিব ইবনে সালাম লিখেছেন, “কত প্ল্যান তার মাথায় গিজগিজ করে। বলার সময় চোখ চকচক করে স্যারের। টানা বলে যান, এটা করলে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে; আনন্দ নিয়ে পড়ালেখা করতে পারবে; আগে থেকে অনেক কিছু নিয়ে সচেতন থাকতে পারবে। পেছনের সারির ছাত্ররা এগিয়ে আসা শুরু করবে।”

আবার স্যারের রসবোধের মাত্রা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “……হার্টএটাক নিয়ে তিনি হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে সবসময়ের মতো রসিকতা করে বললেন, হার্টে রিং পরানো হয়েছে, তাই বলে যেন ভেবে না বসি সেটা ওয়েডিং রিং!”

‘পরকালেও আমাকে তোমার বন্ধু করে নিয়ো’ শিরোনামে শাহ্‌রিয়ার জামান সিয়াম অত্যন্ত আবেগঘন একটি লেখা লিখেছেন। শেষের দিকে তিনি লিখেছেন, “আমি তো শুধু একজন শিক্ষককে হারাই নি। হারিয়েছি আমার বন্ধুকে।“

সাকিয়াতুল জান্নাত রুহী তাঁর লেখাটি শুরু করেছেন এভাবেঃ

“কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের চতুর্থ তলায় এক অনিন্দ্য জগৎ আছে; সেই জগতেরই এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম ‘তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক’। যে নামের আড়ালে ফুটে আছে এক স্মিত হাসি। এ হাসির ঔজ্জ্বল্য বহু দিকভ্রান্ত পথিকের আশায় প্রাণ সঞ্চার করে এসেছে।“

স্যারের শিক্ষক অধ্যাপক ফজলুল বাসেত স্মৃতিচারণা করে লিখছেন এভাবে, “প্রচণ্ড নম্র স্বভাবের এই ছেলেটার ভদ্রতা-নম্রতা চোখ-মূখ ছাপিয়ে সর্বাঙ্গে প্রতিধ্বনিত হত। বন্ধুদের সাথে করিডোরে হাঁটছে; সদ্য নিয়োগ-প্রাপ্ত প্রভাষক আমি – আমাকে দেখে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দিচ্ছে সালাম। আনত দৃষ্টি, কিঞ্চিত অবনত মস্তক– আমার দৃষ্টির বাইরে কোথাও লুকোতে চাইছে যেন! লজ্জায় নয়, ভয়ে নয়– নম্রতায়, শ্রদ্ধায়। আমার সঙ্গেই যে সে এমনটি ছিল তা নয়– অন্য সব গুরুজনেও তার ছিল অপরিসীম নতি।“

আমার অত্যন্ত স্নেহের সৌরভ রায়ের লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি করছি না। ‘তসলিম স্যার’ শিরোনামের হৃদয়স্পর্শী এ লেখাটি পড়ে ফেলতে পাঠকের অর্ধ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু মস্তিষ্কে এর রেশ থেকে যাবে দীর্ঘ সময় ধরে।

এভাবে প্রতিটি লেখায় ফুটে উঠেছে স্যারের ছাত্রবাৎসল্যের কথা, তাঁর মহানুভবতার কথা। বারংবার উঠে এসেছে কিউএমএইচ স্ট্যাটিসটিক্স ক্লাবের কথা। প্রতিটা লেখার কোনো না কোনো বাক্য চোখের এক কোণে অশ্রু এনে জমা করে। প্রতিটি লেখায় এতটা আবেগতাড়িত হয়ে লেখা যে, সবশেষ আরেকটি লেখার কথা বলে আজকের মতো ইতি টানছি। স্যারকে নিয়ে একটি অসাধারণ অ্যাক্রস্টিক সনেট লিখেছেন আশরাফুন জান্নাত সুপ্তি।

জানি, এ শোকও সকলে একদিন কাটিয়ে উঠবে। পরিসংখ্যান পরিবার এগিয়ে চলবে তার স্বাভাবিক ছন্দে। স্যারের যোগ্য উত্তরসূরিরা সামলাবে তাঁর স্বপ্নের কিউএমএইচ স্ট্যাটিস্টিক্স ক্লাব, আয়োজিত হবে স্ট্যাটিসটিক্স ফেস্ট। শুধু চোখে পড়বে না স্যারের ব্যস্ততা। বড় এক স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন বারান্দার কোনো এক কোণায়। স্যারের মেয়েরা বড় হবে তাঁদের বাবার স্মৃতিকে সঙ্গী করে। হয়ত তারাও একদিন এই লেখাগুলো পড়বে। তাই মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছে করে, ভাগ্যিস আমাদের একটি প্যাপাইরাস ছিল!

নিচের কবিতাটি স্যারকে উৎসর্গ করে লেখা-

একটা মানুষ মনের মানুষ হারিয়ে গেল শেষে
ঐ আকাশে দূর আকাশে তেপান্তরের দেশে।
এই বাতাসেই হাসতো মানুষ কইত কত কথা
হঠাৎ করে মানুষটা হায় হারিয়ে গেলে কোথা?

একটা মানুষ মজার মানুষ হাসতো পরান খুলে
শতেক ব্যথা মনের ব্যথা মিটতো তাঁহার বোলে।
সেই না মানুষ হারিয়ে গেল পালিয়ে গেল কোথা
দূর নীলিমায় তারার মাঝেও পাইনে যে তাঁর দেখা।

একটা মানুষ আশার মানুষ আশায় পরান বাঁধা
শূন্যে হঠাৎ মিলিয়ে গেল কাজটি ফেলে আধা।
এমন মানুষ মিলবে কোথায় বলতে কি কেউ পারো?
কইব কথা হরেক কথা মিশব ক’দিন আরও।

একটা মানুষ আজব মানুষ আজব মতিগতি
হাওয়ায় সে আজ মিলিয়ে গেছে মন মানুষের জিতি।
চলছে সবই আগের মতোই যাচ্ছে সময় বয়ে
ভালো থাকুক ভালো মানুষ মহাকালের হয়ে
0504 হরিপদ শীল অব্যক্ত Poem 2nd 1
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬-১৭

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ