fbpx

কাব্যরচনা

কবি আজ ভীষণ প্রেমময় বোধ করছেন। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আলতো পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আকাশে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। জোৎস্নার রূপালী আলো চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে অপরূপ মায়া। সব মিলিয়ে কবিতা লেখার জন্য অসাধারণ এক সময়। এমন সময়েই কবি তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লেখেন। তার লেখা অসাধারণ সব প্রেমের কবিতা বের হয়েছে এ ধরনের প্রেমময় পরিস্থিতিতে। তবে কবিতা এমনি এমনি বের হয় না। তার জন্য দরকার পড়ে এমন কোন অনুপ্রেরণাদাত্রীর যাকে মানসচক্ষে কল্পনা করে লিখে ফেলা যায় সহস্র পঙ্‌ক্তি।

এমন অনুপ্রেরণাদাত্রীকে কল্পনায় ফুটিয়ে তোলা কবির জন্য কঠিন কিছু নয়। কবি বহু আগেই তার কল্পনায় গড়ে তুলেছেন এক অসাধারণ নারীসত্ত্বা। সে নারী কোন ধরনের ধরা-ছোঁয়ার উর্ধ্বে। সে নারী কবির একান্তই নিজস্ব। অসংখ্য কবিতা কবি রচনা করেছেন সেই কল্পলোকের অধিষ্ঠাত্রীর উদ্দেশ্যে। আজ যেমন করবেন।

মুহূর্তের ভেতরই কবির কল্পনার নারীকে নিয়ে এলেন তার সামনে। জলচৌকির পাশে ছোট মোড়ার উপর সে যেন বসে। তার দীঘলকালো কেশ ছড়িয়েছে কোমর পর্যন্ত। চিরল দাঁত ঝিকিয়ে উঠছে মায়াময় হাসিতে। নারীর দৃষ্টিতে আগ্রহ। অপেক্ষা করছে সে কবির হৃদয়প্রসূত নতুন কাব্যের জন্য।

কবির হৃদয় এক অনির্বচনীয় আবেগে পূর্ণ হল। এই তার অসংখ্য কাব্যের অনুপ্রেরণাদাত্রী নারী। এর উদ্দেশ্যেই তিনি লিখেছেন তার হৃদয়ের সমস্ত কথা। এমনই এক নারী সে, যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না; শুধু দূর থেকে ভালবাসা যায়। আর লেখা যায় কবিতা।

কবি এই নারীকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছেন, সে চাইলে তিনি এনে দেবেন আকাশের চাঁদ, মরুভূমিতে ফোটাবেন অজস্র গোলাপ, পাড়ি দেবেন সাত সমুদ্র তের নদী। তার ইচ্ছেপূরণের জন্য অসাধ্য সাধন করবেন অনায়াসে। তার উদ্দেশ্যেই তিনি বলেছেন, সহস্র বছর করবেন সাধনা শুধু একটিবার তাকে পেতে, আকাশ-পাতাল এক করে ফেলবেন শুধু তার মুখে এক টুকরো হাসি ফোটাতে। সে নারীর প্রতি তার চূড়ান্ত ভক্তি। তার জন্য তিনি হবেন…

“কর্তা…” হঠাৎ ডাকে কবির আবেশ কেটে গেল। উধাও হয়ে গেল তার কল্পনার প্রেমময়ী নারী। প্রচণ্ড বিরক্তির সাথে তিনি তাকালেন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উজবুকটার দিকে। বেয়াদব চাকরটাকে তিনি বহুবার বলেছেন তার কাব্যচর্চার সময় বিরক্ত না করতে। সে কথা তার মাথায় ঢোকে না।

“কী হয়েছে?” কবি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন।

চাকর ঢোক গিলল। ভীতু কণ্ঠে বলল, “চৌধুরীবাড়িতে পালাগান বসেছে। গিন্নী ওখানে যেতে চান।”

কথা শুনে কবির ক্রোধ আরও বেড়ে গেল। এমন তুচ্ছ কারণে তার কাব্যধ্যান ভঙ্গ করা হল। তিনি বললেন, “গিন্নীকে বল ন্যাকামো বন্ধ করতে। সে জানে রাতে সে বাইরে বেরুতে পারবে না। আর আমিও এখন কাজ ফেলে তাকে নিয়ে যেতে পারব না। তাকে সেলাইয়ে মন দিতে বল।”

চাকর তারপরও ইতঃস্তত করতে লাগল। কবি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন পরিস্থিতিতে একজন মানুষ কীভাবে কবিতা লিখবে?

“কী হল?” তিনি ধমকে উঠলেন।

চাকর করুণ কণ্ঠে বলল, “আমার কথা গিন্নী শুনবেন না।”

কবি কাগজ ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। গিন্নীর দেমাগ দিন দিন বাড়ছে। অনেক বেশি লাই দেয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। হন হন করে তিনি নেমে এলেন নিচ তলায়।

উঠানে গিন্নী অপেক্ষা করছিলেন। হয়ত ভাবছিলেন কবি তাকে নিয়ে বেরুবেন এখন। কবির হুংকারে তার ভুল ভাঙল।

বেশ কিছুক্ষণ অনর্গল ধমকের তুবড়ি ছোটালেন কবি। গিন্নীর চোখ বেয়ে দর দর করে পানি ঝরছে। পুরোটা সময় তিনি চুপ ছিলেন। একবার শুধু মৃদু কণ্ঠে বলতে গেলেন, “বাড়ির কাছে একটু বেড়াতে চেয়ে কী এমন…”- কবির কঠিনতর ধমকে তাও থেমে গেল।

অবশেষে অনেক চেষ্টার পর কবি শান্ত হলেন। রূক্ষ কণ্ঠে বললেন, চোখের পানি ফেলার এই ঢংটা যেন তার সামনে না করা হয়। গিন্নীকে ঘরে যাবার আদেশ দিয়ে তিনি দোতলার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পিছনে আর ফিরে তাকালেন না। জানেন, আদেশ পালিত হবে।

ঘরে ঢুকে লম্বা একটা শ্বাস নিলেন কবি। কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে বসলেন জলচৌকির সামনে। বেশ কিছুক্ষণ তার বিক্ষিপ্ত মনে ভাবাবেশ এল না। কী যেন ভাবছিলেন তিনি?

মনে পড়েছে। সে নারী চাইলে করবেন তিনি অসাধ্যসাধন।

(সমাপ্ত)

প্রভাষক | বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি , কুমিল্লা