জুন ২০, ২০২৫

সমুদ্রপারে

সাগর আমার কখনোই ভাল লাগে নি। এই বিপুল সীমাহীন জলরাশির প্রতি প্রথম দর্শন থেকেই আমি বিরূপ। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ, জোয়ারের চাপ, ভাটার টান- এগুলোর সামনে নিজেকে অনেক তুচ্ছ মনে হয়। এই বিশাল সৃষ্টির তুলনায় আমি যে কত ক্ষুদ্র তা প্রত্যেকবার উপলব্ধি করি। উপলব্ধিটা আমার জন্য সুখকর নয়। নিজেকে তুচ্ছ ভেবে আমি অভ্যস্ত না। তাই সহজে সাগরের আঙিনায় পা দিই না।

না চাইলেও মাঝে মাঝে আসতে হয়। বন্ধু নামক একশ্রেণির পিশাচ আছে যাদের নানা ধরনের আবেগপূর্ণ অনুরোধ অগ্রাহ্য করা কঠিন। তেমন কয়েকজনের পাল্লায় পড়ে আবার আসতে হয়েছে জলধিদর্শনে। পিশাচগুলো এ মুহূর্তে তিন-চার বছরের বাচ্চাদের মত সাগরে হাপুস-হুপুস করে ঝাঁপাচ্ছে। একজন আরেকজনের গায়ে জল ছুড়ছে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের আঘাতে উল্লসিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠছে। খানিক পর পর আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি করছে। আমি মুচকি হেসে অপারগতা প্রকাশ করছি। তাদের আচরণ দেখেই আমার লজ্জা লাগছে। যোগ দিতে হলে সলীলসমাধি নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

দামড়া ছেলেদের জলকেলি দেখতে আর ভাল লাগছে না। সমুদ্রতীর ধরে ডান দিকে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে কোলাহল পার হয়ে সৈকতের মোটামুটি নির্জন একটা জায়গাতে হাজির হলাম। এদিকটাতে লোক দু-চারজন। এখানে ঢেউয়ের তীব্রতা বেশি। সাগরও দ্রুত গভীর হয়ে ওঠে। লোকজন তাই সচরাচর এদিকে আসে না। গোধুলি ঘনাচ্ছে। অস্ত যাওয়ার আগে সূর্য সাগরে বুলিয়ে দিচ্ছে অপূর্ব মায়া। ভাবুক কেউ হলে তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত। আমি ভাবুক না। এই যাত্রাতে আরও কত টাকা খসবে তা চিন্তা করতে করতে হাঁটছি।

আবছাভাবে আসা একটা শব্দ মনোযোগ কাড়ল। ভ্রু কুচকে এদিক ওদিক তাকালাম। আশে-পাশে কেউ নেই। দূরে দু-একজন হাঁটাহাঁটি করছে। শব্দ শুনে মনে হল কেউ চিৎকার করেছে। কিন্তু আশেপাশে তেমন কোন দৃশ্য চোখে পড়ল না। আবার নিজের চিন্তাতে মগ্ন হতে যাব, তখন আবার শুনলাম। আগের চেয়ে জোরে।

নিশ্চিতভাবে কোন মনুষ্যসন্তান চিৎকার করছে। সাগরের দিকে তাকালাম। ঢেউ উঠছে-নামছে, আসছে-যাচ্ছে। ঢেউয়ের সাথে ওঠা-নামা করছে নানান ধরনের আবর্জনা। শুধু… এতক্ষণ যেটাকে একটুকরো কালো কাপড় বলে মনে হচ্ছিল তার দুপাশে দুটো হাত উঠে আসায় বোঝা গেল তা মানবমস্তক। সে আবার চিৎকার করল।

আমি সহজে অবাক হই না। কিন্তু একটি শান্ত গোধুলিবেলাতে একজনকে ডুবে যেতে দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। এত দূর থেকে ডুবন্ত ব্যক্তিকে ঠাহর করা যাচ্ছে না, কিন্তু চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে তের-চৌদ্দ বছর বয়সী কোন কিশোর। দ্রুত মাথাতে একগাদা চিন্তা খেলে গেল। ছেলেটা ডুবে যাচ্ছে। ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে। সাঁতরে তার কাছে যেতে হবে। আমি সাঁতার জানি। কিন্তু স্থির পুকুরে ভেসে থাকার মত সাঁতার। সমুদ্রের মাতাল ঢেউয়ের সাথে লড়ার মত সাঁতার আমি জানি না। ছেলেটাকে বাঁচাতে গেলে আমাকেও তার পরিণতিই বরণ করা লাগবে। আমি এতটা নিঃস্বার্থ না যে এসব আগ-পাছ না ভেবে চোখ বুজে ঝাঁপ দেব।

এদিক-ওদিক তাকালাম। আশেপাশে সাহায্য করার মত কেউ নেই। দূরে কয়েকজন আছে। তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, “এই যে ভাই, হ্যালো, হ্যালো! একজন ডুবে যাচ্ছে। সাহায্য করুন। এই যে ভাই!”

ছোটবেলায় স্কাউট লিডার নির্বাচনের সময় বুঝেছিলাম আমার গলার জোর ভাল না। আজ আবার বুঝলাম। কেউই শুনল না। একজন দেখলাম আমার দিকে তাকাল। আমার হাত-পা নাড়ানাড়ি দেখে নিজের আশপাশে তাকিয়ে হনহন করে চলে গেল।

আমি আবার ছেলেটার দিকে তাকালাম। তার গলার জোর কমে এসেছে। আর বেশিক্ষণ টিকতে পারবে বলে মনে হয় না। কাউকে নিয়ে আসার জন্য দৌড় দেব নাকি তা যখন ভাবছি, তখন দেখলাম একজন ছুটে আসছে। মাথাজোড়া টাক লোকটার। মুখভর্তি ব্রণ। কপালে বিশাল এক কাটাদাগ। সেই মুহূর্তে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ বলে মনে হল।

“কী হইছে, ভাই? কী হইছে?” সে হাঁপাতে হাঁপাতে আমাকে জিজ্ঞেস করল।

আমি ডুবন্ত ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করলাম। “ছেলেটা ডুবে যাচ্ছে। তাকে বাঁচাতে হবে। আপনি সাঁতার জানেন?”

“জানি ভাই, জানি।” লোকটা আমাকে আশ্বস্ত করল। “আপনি কোন চিন্তা করবেন না। শুধু কন আপনার ভাই সাগরে নামছিল কোন জায়গা দিয়ে।”

“সে আমার ভাই না।” আমি তাকে জানালাম। ছেলেটা কোন জায়গা দিয়ে নেমেছে তা জানার দরকার কী  বুঝলাম না। “সে কোথা দিয়ে নেমেছে তা তো বলতে পারব না। কিন্তু ঐ যে ঐখানে তার জুতো আর সানগ্লাস দেখা যাচ্ছে। হয়ত ঐ  জায়গা…”

লোকটা আমাকে কথা শেষ করার সু্যোগ দিল না। এক দৌড়ে জুতা আর রোদচশমা তুলে নিয়ে ভেগে গেল।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চোর-বাটপারে দেশ ভরে গেছে। একটা ছেলে মারা যাচ্ছে, সে সময়ও সবাই নিজের ধান্দায় ব্যস্ত। ছেলেটার দিকে আবার তাকালাম। বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল। সে উধাও। পরের ঢেউয়ের মাথায় তাকে আবার দেখা গেল। এখন আর সে চেঁচাচ্ছে না। কাউকে ডাকার আর সময় নেই। যা করার নিজেই করতে হবে।

চুপচাপ নিজের পথ ধরব কি না ভাবলাম। খুব কি খারাপ হবে? একে বাঁচাতে গিয়ে নিজে শহীদ হওয়াটা হয়ত খুব মহৎ একটা ব্যাপার। কিন্তু মহত্ত্ব তো আর আমার পরিবার না। আমার বন্ধু-বান্ধব না। কাশেম ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে দেয়া আড্ডা না। মহত্ত্বের লোভে পড়ে এসব বিসর্জন দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। নিজেকে আমি বুদ্ধিমান ভাবতে পছন্দ করি। সাগরের দিকে পিঠ দিয়ে পকেটে হাত গুজে হাঁটা শুরু করলাম।

ছেলেটা মারা যাবে। দুঃখজনক। সব স্মৃতি একসময় ধূসর হয়ে মিলিয়ে যায়। এটা কি মিলিয়ে যাবে? নাকি আজ থেকে বিশ বছর পরও রাতের গভীরে ঘামে ভিজে জেগে উঠব আজকের দুঃস্বপ্ন দেখে? প্রতি মুহূর্তে এই স্মৃতিটা কি আমার মনের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধবে না? সুরেলা কোন গানের আওয়াজে কি ছেলেটার চিৎকার চাপা দিতে পারব? ছেলেটার অদেখা চেহারা কি প্রতিদিন ভেসে উঠবে না আয়নাতে?

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এভাবে একটা ছেলেকে মৃত্যুমুখে ফেলে চলে গেলে সারাজীবন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগব। হয়ত আসলে তেমন কিছু হবে না। কিন্তু ঝুঁকি নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ না। নিজেকে আমি বুদ্ধিমান ভাবতে পছন্দ করি।

লম্বা শ্বাস নিলাম।

ঘুরে ছোটা শুরু করলাম ডুবন্ত মানুষটার দিকে।

(সমাপ্ত)

শাহেদ খান
প্রভাষক | বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি , কুমিল্লা
Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp