fbpx

বৃথা

১)

মানবজাতির সবচেয়ে বড় হন্তারক কে? মানুষ নিজে? সাপ, কুমির, হাঙর, বাঘ, সিংহ বা ভাল্লুক?

না!

মানুষের সবচেয়ে বড় খুনি হচ্ছে তুচ্ছ মশা। আসলে মোটেও তুচ্ছ না, মানুষ মনে করে তুচ্ছ। প্রতিবছর মশাবাহিত রোগে সাত লাখের উপর মানুষ মারা যায়। সেই জায়গায় মানুষের হাতে মানুষ মারা যায় পাঁচ লাখের কম। যেসব প্রাণী লোকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় তাদের শিকার হয়ে মারা পড়ে খুব অল্প কয়েকজন।

এই তথ্যগুলো স্যাল এই মাত্র জানতে পারলো। কারণ সে কানে হেডসেট লাগিয়ে মশাবিষয়ক একটা পডকাস্ট শুনছে। সে বসে আছে নিউ ইয়র্ক শহরের উত্তরে ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টির একটা বাড়ির তালাবদ্ধ দরজার সামনের সিঁড়িতে।

ঘড়িতে সময় বিকাল ৩ঃ১০। অক্টোবর মাসের প্রথম শনিবার। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী উত্তর-পূর্ব আমেরিকার গাছপালার পাতার রঙ বদলে গেছে। কোথাও হলুদ,কোথাও লাল, কোথায় আবার কমলা বা মেরুন। আমেরিকায় এই ঋতুর নাম ফলস। গাছপালায় ছাওয়া ওয়েস্টচেস্টারে এত এত রঙ যে স্যালের মনে হচ্ছে সে কোনও পেইন্টিং-এর ভিতর ঢুকে বসে আছে।  

বড়লোকদের এলাকা এটা। নীরব ঘোরানো-প্যাঁচানো রাস্তা, নিখুঁত সাইডওয়াক, বাড়িগুলো আকারে বড় এবং দৃষ্টিনন্দন ল্যান্ডস্কেইপিং করা। স্যাল পেশায় একজন রিয়েল এস্টেট এজেন্ট। পেছনের তালা দেয়া বাড়িটা ওর লিস্টিং-এর অন্তর্ভুক্ত।

সে ক্লায়েন্টের জন্য অপেক্ষা করছে। ক্লায়েন্টের তিনটায় আসার কথা। ওরা যে তিনটায় আসবে না সে ব্যাপারে স্যাল মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো। এ নিয়ে এই ক্লায়েন্টের সাথে আটবারের মতো এপয়েন্টমেন্ট। প্রতিবার তারা আধাঘণ্টা থেকে একঘণ্টা দেরিতে এসেছে। স্যাল একবার ভেবেছিলো যে সেও সাড়ে তিনটায় মিটিং পয়েন্টে আসবে। কিন্তু খুব টনটনে পেশাদারিত্বের কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা করা ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই আধা শোনা পডকাস্টটা থাকায় সময়টা একেবারে অপচয় হচ্ছে না।

৩ঃ৩৫-এ একটা কালো রঙের মার্সিডিজ ফোরম্যাটিক এসইউভি বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে থামলো। গাড়ির ড্রাইভার সীট থেকে নামলো একহারা গড়নের তরুণ বয়সী ছেলে, অন্যদিক থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক। ছেলেটার নাম শাকিল। ওর সাথে স্যালের আগের এপয়েন্টমেন্টগুলোতে দেখা হয়েছে। লোকটা নিশ্চিত আফজাল হোসেন হবেন, শাকিলের বাবা। এর সাথে আজকেই প্রথম দেখা।

আফজাল সাহেব শুধুমাত্র নিজের উপস্থিতির জোরে এতক্ষণের শিল্পসুন্দর পরিবেশটা বাস্তবে নামিয়ে আনলেন। দুই সাইজ বড় মেরুন পারকা জ্যাকেট, পায়ে ধবধবে সাদা স্নিকারস আর সম্পূর্ণ দেশি কায়দায় মাথা আর গলা নিয়ে প্যাঁচানো উলের সবুজ স্কার্ফ। নিখুঁত গোলাকার ভুঁড়িটা জ্যাকেট ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সুন্দর সবুজ ঘাসের মাঠের ঠিক মাঝখানটায় একটা পলিথিন ব্যাগ পড়ে থাকলে যেমন দেখায়, ওয়েস্টচেস্টারের এই রাস্তায় আফজাল সাহেবকে ঠিক সেরকম চক্ষুশূলের মতো দেখাচ্ছে। এইরকম একটা তুলনা কল্পনায় আসায় স্যাল নিজের উপর কিছুটা লজ্জিত হলো।

স্যাল এগিয়ে যেতে যেতে বললো “হাউ আর ইউ ডুইং, শাকিল?”। তারপর লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো “হাই, আই’ম স্যাল মো। প্লেজার টু ফাইনালি মিট ইউ।“

শাকিল উত্তরে একটু হাসলো। শাকিলের বাবা স্যালকে আপাদমস্তক দেখলো একবার “আমনে নাকি আধা বাংগালি? চেহারা দেইখা কিন্তু বুঝা যায় না।“

“আব্বা, উনি বাংলা বুঝেনা।“ শাকিল একটু বিব্রত। স্যালের দিকে ঘুরে বললো “স্যাল, দিস ইজ মাই ফাদার আফজাল হোসেন।“

মুখে হাসি ধরে রেখে স্যাল বললো “শ্যাল উই গো ইন?”

স্যাল বাংলা বোঝে না কথাটা সত্য না। এটা শাকিল শুরুতেই ধরে নিয়েছিলো। স্যাল ভুলটা ভাঙিয়ে দেয়নি। সত্যটা হচ্ছে সে বাংলা বুঝে, বলতে পারে, এমনকি পড়তে এবং লিখতেও পারে। এটা সে তার বাঙালি বাবার কাছ থেকে শিখেছে। মোরশেদুল হক নিজ ভাষা-সংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী এবং সেটা তিনি তার দুই সন্তান মিতা আর স্যালের মধ্যেও প্রতিষ্ঠা করেছেন।

স্যাল মো নামটাও ওর আসল নাম না। তবে নকল নাম বললেও ভুল হবে। এটা ওর সংক্ষিপ্ত, জাতি-নিরপেক্ষ নাম। ওর আসল নাম সালেহ মোরশেদ। রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের খুব দ্রুত ক্লায়েন্টের আস্থা অর্জন করতে হয়। মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে অন্য সংস্কৃতির মানুষকে সহজে বিশ্বাস করে না। এটা স্যালের নিজস্ব ধারণা না। এর উপর বিস্তর গবেষণা হয়েছে। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে আমেরিকায় চাকরির জন্য একই আবেদনপত্রে এমিলি বা গ্রেগ নাম ব্যবহার করলে সেটা লাকিশা বা জামাল নামের তুলনায় ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক পায় ঢের বেশি।

আধা বাঙালি হলেও স্যালের চেহারা আরেমেনিয়ান মায়ের সাথেই মিল বেশি। যে ধরনের চেহারাকে আমেরিকায় রেশিয়ালি এমবিগিউয়াস বলা হয়, স্যালের চেহারা ওইরকম। দেখে বোঝার উপায় নেই সে আসলে কোন জাতির মানুষ।

২)

স্যাল নয় বরং শাকিল তার বাবাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দেখাচ্ছে। এমনটাই কথা ছিলো। সতেরোটা বাড়ি দেখার পর শাকিল আর তার মা মিলে এই বাড়িটা পছন্দ করেছে। আফজাল সাহেব বলেছিলেন কিনে ফেলতে কিন্তু শাকিলের মা স্বামীকে বাড়ি না দেখিয়ে কিনবেন না। তাই তড়িঘড়ি করে আফজাল সাহেব ঢাকা থেকে নিউ ইয়র্ক এসেছেন।

আফজাল সাহেব দেশে থাকলেও তার পরিবার থাকে কানাডার টরোন্টোতে। সেখানে উনার স্ত্রীর নামে কেনা তিনটা বাড়ি আছে। শাকিল ছয় মাসের একটা ইন্টার্নশিপ করবে আইবিএম-এর হেডকোয়ার্টারে। অফিসটা ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টির আরমংক নামের টাউনে। মা ছেলেকে একা ছাড়তে চাচ্ছে না, আর ইন্টার্নশিপ শেষে শাকিল আমেরিকাতেই চাকরিবাকরি করতে পারে ভেবে আফজাল সাহেব নিউ ইয়র্কে আরেকটা বাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেন।

“আব্বা, সানরুমটা দেখো। কত্ত আলো আসে দেখছো? সকালে এই জায়গাটা দেখলে বুঝবা।“

“ওইসব তুমি আর তুমার মা বুইঝো, তুমরা যদি এইখান থিকা চইলা যাও তাইলে বেইচা কেমন দাম পাইবা সেইটা জানো?”

“বেচতে হবে না। নিউ ইয়র্কে বাড়ি থাক না একটা। না লাগলে ভাড়া দিয়ে দিব। চলো, তোমারে বেইজমেন্টটা দেখাই। অনেক উঁচা সিলিং।“

সিঁড়ি দিয়ে গ্রাউন্ড লেভেল থেকে বেইজমেন্টে যাওয়ার মধ্যে আফজাল হোসেনের ফোন বেজে উঠলো। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েই ফোন ধরলেন। সিঁড়ির গোড়ায় শাকিল আর উপর থেকে চার নম্বর ধাপে দাঁড়ানো স্যাল। আফজাল হোসেন এই মানবজট সৃষ্টি করে বেশ ভাবলেশহীন।

“হ, কও।”

মিনিট তিনেক ওই প্রান্তের কথা শুনে বেশ গলা চড়িয়ে বললেন “তোমারে কইছি ওই ব্যাটারে বুঝায় কাম না হইলে হার্ডলাইনে যাও। ঠান্ডায় না মানলে ডান্ডা! অর চারপাশের চাইর বিঘা লইয়া লইছি। অর ৬ কাঠার ভিটার লাইগা কি আমার পোজেক্ট আটকায় থাকব? তুমি না পারলে কও। আরও লোক আছে আমার। ওসির লগেও লাইন আছে। আগের মাসে বাজারে একটা ডাকাতি হইছিলো না? ওহানে নাম ঢুকায় দিমু।”

আবারও দুই মিনিটের জন্য আফজাল হোসেন শ্রোতা। শাকিল বারবার স্যালের দিকে তাকিয়ে বিব্রতভাবে হাসছে। শাকিলের হাসির জবাব দেয়া ছাড়া স্যাল চেহারা সম্পূর্ণ অভিব্যক্তিহীন করে রেখেছে।

“আইচ্ছা আমারে কাইলকে জানাইবা। অর জমি এমনেও যাইব ওমনেও যাইব। টেকা সাধতেছি অর কপাল। বুঝায়া কইয়ো।”

আফজাল হোসেন ফোন রাখলেন এবং আবার সিঁড়ি ভাংতে শুরু করলেন।

এইমাত্র যা ঘটলো সেটা দেড়বছর আগে ঘটলে স্যাল চমকে যেত। এখন সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আফজাল হোসেন স্যালের সাত নম্বর বাংলাদেশি ক্লায়েন্ট। দেড়বছর আগে কলেজের আরেক বাঙালি বন্ধুর মারফত স্যাল তার প্রথম বাংলাদেশি ক্লায়েন্ট পায়। বাংলাদেশি মানে আমেরিকান-বাংলাদেশি না, বাংলাদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক। এরপর সেই সূত্র ধরে এই ক্লায়েন্টসহ আরও ছয়জন।

আফজাল হোসেন সম্পর্কে স্যাল যথাসম্ভব খোঁজখবর নিয়েছে। তার ফেসবুক প্রোফাইল অনুযায়ী সে বাংলাদেশের একটা অখ্যাত পৌরসভার সরকারী দলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক না কি যেন। তিনি একজন মন্ত্রীর ঘনিষ্ট লোক অথবা তার ফেসবুক পোস্টে তেমনটা দাবি করা হয়। পেশা বলতে তার দুইটা যাত্রীবাহী লঞ্চ আছে। অবশ্য এই আয় দিয়ে তিনি কিভাবে নর্থ আমেরিকায় তিনটা বাড়ি কিনে চতুর্থটা খুঁজছেন সেটা ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।

স্যালের সাতজন বাংলাদেশি ক্লায়েন্টের পাঁচজনেরই বৃত্তান্ত এইরকম। বাকি দুইজন ছিলেন সরকারি আমলা।

বাড়ি দেখা শেষ করে আফজাল হোসেন তার ছেলেকে সিদ্ধান্ত জানালেন এইভাবে “আগেই তো কইছিলাম কিনা ফালাও, আমি টাকা পাঠানের ব্যবস্থা কইরা দিমুনে। তোমার আম্মা আমারে খামাখা টাইনা আনলো। এখন উনার সাথে ফাইনাল করো।“ তিনি স্যালের দিকে নির্দেশ করলেন।

৩)

স্যাল রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখলো আয়িশা আগে থেকেই এসে বসে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে মেন্যুটা পড়ছে সে। স্যাল হেসে ফেললো। মেয়েটা প্রতিবার একই কাজ করে। মেন্যু আদ্যোপান্ত পড়ে শেষে ওই একই খাবার অর্ডার করে।

“অনেকক্ষণ হলো এসেছো?” স্যাল গায়ের জ্যাকেটটা চেয়ারে পরিয়ে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো।

“নাহ। দশ মিনিট হবে। ভাবলাম আজকে তোমার আগে আসি। মানে নতুন কিছু করি, হাঃ হাঃ।“

“আচ্ছা! খাবারও কি নতুন কিছু খাবে? আমি রেকমেন্ড করি?” স্যাল ভ্রূ কুচকে খুব সিরিয়াসলি মেন্যু পড়ার অভিনয় করলো, “এটা কেমন হয় – তিবস উইথ ইঞ্জেরা ব্রেড এন্ড মিট্মিটা সস?”

“ফাজলামো করছো?” আয়িশা প্রতিবার এই খাবারটাই অর্ডার করে।

“ভাবলাম ফাজলামি যা করার করে নেই। বিয়ের পর তোমাকে ইংল্যান্ডের রাণী জ্ঞান করে আচরণ করা হবে।“

আয়িশার সাথে ওর বাগদান হয়েছে মাসদুয়েক হলো। সামনের বছর এপ্রিলে বিয়ে হবে ঠিক করা হয়েছে।

আয়িশা জাতিতে তাঞ্জানিয়ান। জাঞ্জিবারের পুরনো ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। ওর পরিবারটা শিক্ষিত হলেও সেকেলে। ভিনদেশি ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে তারা কোনমতেই রাজি ছিলো না।

এই সামারে একদিন স্যালের বাবা আয়িশার কাছে পুরো ব্যাপারটা শুনে ওর বাবার নাম্বারটা চেয়ে নিলেন। তারপর টাইমজোন দেখে নিয়ে তখনি ফোন করলেন। আধাঘণ্টার আলাপ শেষ হলো আয়িশার বাবার পক্ষ থেকে স্যালের বাবা-মাকে নিমন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে।

সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে মোরশেদুল হক সস্ত্রীক জাঞ্জিবারে হাজির। আয়িশা তার কয়েকদিন আগেই চলে গিয়েছিলো। হোয়াটসএপে পুরো ব্যাপারটার মোটামুটি একটা লাইভ সম্প্রচার সে স্যালকে জানিয়ে যাচ্ছিলো। স্যালের বাবা-মা বাসায় প্রবেশ করার সময়েও নাকি আয়িশার বাবা কিছুটা গম্ভীর ছিলেন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর তাকে স্যালের বাবার হাত ধরে প্রশস্ত হাসিসমেত বসে থাকতে দেখা গেছে।

এমনটাই যে হবে সে ব্যাপারে অবশ্য স্যালের কোনও সন্দেহ ছিলো না। মোরশেদুল হক মানুষটাই এমন। তার উপর পাহাড় সরানোর দায়িত্ব দিয়েও নিশ্চিন্ত থাকা যায়। অনেক দুরূহ কাজ করতে তাকে কোনও বেগ পেতে হয় না। তার ব্যক্তিত্বের ক্যারিশমার জোরে অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়।

মোরশেদুল হককে প্রথমবার দেখলে তার তিনটা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে – গভীর, প্রশান্তিময় দৃষ্টি; ইংরেজিতে যেটাকে বলে ডিজআর্মিং স্মাইল, অর্থাৎ মন গলানো হাসি; আর তার আংশিক অকেজো বাম পা। তার জীবনের যত প্রাপ্তি তার মধ্যে এই অকেজো পা-টাকেই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করেন। এটাকে তিনি মহামূল্যবান অলংকারের মত ধারণ করেন।

আওয়েত নামের ওইট্রেসটা খাবারের অর্ডার নিতে এলো। ম্যানহাটন মিডটাউনের এই ইথিওপিয়ান রেস্টুরেন্টটা ওদের দুইজনেরই খুব পছন্দ। রেস্টুরেন্টের সবাই ওদের চিনে।

“তারপর? কাজ কেমন যাচ্ছে?” আওয়েতকে হেসে বিদায় করে আয়িশা জানতে চাইলো।

“ভালোই। সামনের সপ্তাহে ওয়েস্টচেস্টারের লিস্টিংটার ক্লোজিং হবে।“ বাড়ি বিক্রির শেষ ধাপকে এদেশে ক্লোজিং বলা হয়।

“ওহ তাই! বেশ বড় ডীল, তাইনা?”

“হ্যাঁ। এবছরের সবচেয়ে বড়। দেড় মিলিওনে যাচ্ছে বাড়িটা।“

“ক্লায়েন্ট কারা? আবারও তোমার দেশি লোক?” আয়িশার কথায়, মুখভঙ্গিতে কৌতুক।

“হুম। আচ্ছা, বলো তো, এই নতুন ধরনের ক্লায়েন্টেলের ব্যাপারটা কি আমার বাবাকে জানানো উচিত?“

“তোমার ক্লায়েন্ট, তোমার বাবা। আমার কাছে জানতে চাচ্ছো কেন?”

“কারণ তুমি আমার বাগদত্তা, ভবিষ্যত স্ত্রী, বিদুষী নারী, সংবেদনশীলতার অগ্রদূত…… আরও প্রশংসা শুনতে চাইলে বলো বলে ফেলি। একটা উপদেশ চাইলাম, দিতে সমস্যা কোথায়?”

“ওকে, উপদেশ দিতে পারি। তবে কিছু অপ্রিয় কথা শুনতে হতে পারে।“

“অপ্রিয় কথা শুনতেই তো তোমার কাছে আসি, প্রিয়!”

আয়িশা কিছুক্ষণ চুপ করে স্যালের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর ব্যাগ থেকে একটা হেয়ারব্যান্ড বের করে লম্বা, কোঁকরা চুলগুলো বেঁধে ফেললো। এটা সম্ভবত ওর সিরিয়াস হওয়ার রিচুয়াল। একটা জিনেটিক রিসার্চ ল্যাবে কাজ করে সে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণা উপস্থাপন করা ওর কাজের অংশ। স্যাল দেখেছে যে পোডিয়ামে দাঁড়ানোর আগে ঠিক এইভাবে সে চুল বেঁধে নেয়। আয়িশা বলা শুরু করলো –

“স্যাল, তোমার বাবা হচ্ছেন তোমার হিরো। ওয়েল, তিনি আক্ষরিক অর্থেই একজন বীর। কিন্তু এখানে মূল পয়েন্টটা হচ্ছে যে তিনি তোমার আইডল এবং তুমি সারাজীবন তার মতো হতে চেয়েছো। আমার ধারণা এই জায়গায় তুমি নিজেকে ব্যর্থ মনে করো। তোমার সাম্প্রতিককালের ক্লায়েন্টেল এই ব্যাপারে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তুমি মনে করছো যে তোমার বাবার সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগের জায়গায়টায় তুমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছো। তোমার এরকম মনে করার কোনও কারণ নেই এবং আমার বিশ্বাস তোমার বাবা এসব জানলে কিছুই মনে করবেন না। হয়ত তুমিও সেটা জানো কিন্তু ব্যাপারটা তুমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছো না।

অর্থাৎ, তোমার নতুন ক্লায়েন্টেল সম্পর্কে তোমার বাবার জানার কোনও প্রয়োজন নেই, কিন্তু তোমার নিজের জন্য তাকে জানানোর প্রয়োজন আছে।“

স্যাল হেসে ফেললো। এইজন্যই এই মেয়েটাকে ওর এত ভালো লাগে। অনেকে বলে পুরুষ নাকি নিজের চেয়ে বুদ্ধিমান নারীসঙ্গী পছন্দ করে না। স্যালের ক্ষেত্রে এটা খাটে না। আয়িশার গভীর পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণী ক্ষমতাই তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে।

খাবার চলে এসেছে।

৪)

আয়িশাকে সাবওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে স্যাল বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলো। ওর এপার্ট্মেন্টটা উইলিয়ামসবার্গ ব্রিজ পার হয়ে ব্রুকলিনে। প্রায় ৫০ মিনিটের হাঁটা পথ। এই সময়টা ওর প্রয়োজন। মাথায় অনেক এলোমেলো চিন্তা ঘুরপাক করছে, সেগুলোকে গোছানো দরকার।

স্যালের বাবা মোরশেদুল হক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। যুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালেহ আগরতলা পালিয়ে গিয়ে ট্রেইনিং নেন।

তার আহত হওয়ার দিনটায় কুলাউড়ার কাছে ইন্ডিয়ান আর্মির সাথে একটা যৌথ অপারেশন ছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো একটা চা বাগানের ম্যানেজার বাংলো দখল করা। বাংলোটায় পাকিস্তান আর্মির বালোচ সৈন্যদল ঘাটি গেড়ে বসেছিলো।

মিত্রবাহিনী লড়াইয়ে অপ্রত্যাশিত প্রতি-আক্রমণের মুখে পড়ে। মোরশেদুল হক আর সালেহ মোটামুটি তিরিশ মিটার দূরত্বে পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে শত্রুপক্ষের একটা গুলি এসে সরাসরি সালেহর খুলিতে লাগে। তিনি তৎক্ষণাৎ মৃত্যবরণ করেন।

মোরশেদুল হকের জীবনের পরবর্তী বছরগুলো এই একটা মুহূর্ত প্রভাবে আবর্তিত বললে অত্যুক্তি হবে না। ওই সময়ে তার বন্ধু মারা গেছে এটা তিনি মেনে নেননি। তিনি পজিশন পরিবর্তন করে বন্ধুর পাশে অবস্থান নেন এবং মৃতদেহটা কাভার করে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন।

তার পজিশন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে তবুও তিনি নড়ছেন না এটা বুঝতে পেরে দলের অধিনায়ক এগিয়ে আসেন। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তিনি মোরশেদুল হককে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু ততক্ষণে একটু দেরি হয়ে গেছে। একটা গুলি এসে মোরশেদুল হকের বাম পায়ের ফিবুলা হাড়ের কোণা গুড়িয়ে দিয়ে যায়।

তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা পেলে হয়ত তেমন গুরুতর কিছু হতো না। কিন্তু চিকিৎসায় দেরি হওয়ায় ওই হাড়ের আর তার চারপাশের টিস্যুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। ফলাফল, মোরশেদুল হক চিরকালের জন্য তার বাম হাটু ভাঁজ করার ক্ষমতা হারান।

মোরশেদুল হকের জীবনের বাকিটাকে সফলই বলতে হবে। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় আসেন, তারপর মাস্টার্স শেষে একটা ইনশিওরেন্স কোম্পানীতে এনালিস্ট হিসেবে যোগ দেন। খুব সুন্দরী, শিক্ষিত এক আর্মেনিয়ান নারীকে বিয়ে করে যেটাকে বলে আমেরিকান ড্রীম, সেই জীবনযাপন শুরু করেন।

এক মেয়ের পর যখন ছেলে জন্ম নেয় তখন তিনি ছেলের নাম রাখেন সালেহ মোরশেদ। এইভাবে তিনি দুই বন্ধুর পাশাপাশি অবস্থান আরও বহুবছরের জন্য নিশ্চিত করেন।

পঙ্গুত্বের কারণে মোরশেদুল হক নিজেকে কখনো গুটিয়ে রাখেননি। তিনি এডভেঞ্চারাস মানুষ, প্রকৃতি ভালোবাসেন। মিতা আর স্যাল বাবার হাত ধরে শিখেছে অনেককিছু। একটামাত্র পা ব্যবহার করে তিনি রক ক্লাইম্বিং করতেন। খুব ভালো সাঁতারু ছিলেন। অনেকবার এমন হয়েছে যে মিতা আর স্যাল কায়াক চালিয়েছে আর তিনি কায়াকের পাশে সাঁতার কেটে কেটে বিশাল লেইকে ঘুরে বেড়িয়েছেন। লম্বা হাইকিং-এ যাওয়া, রাতে তাবু খাটিয়ে জংগলেই ঘুমিয়ে পড়া ওদের পরিবারের জন্য খুব নিয়মিত ব্যাপার ছিলো।

চমৎকার গানের গলা তার। লালনের গান গাইতে ভালোবাসেন। দেশ থেকে একটা দোতরা আনিয়ে নিয়েছিলেন। স্যালের স্মৃতিতে স্পষ্ট ভাসে বাবা গ্রীস্মের রাতে ওদের টাউনহাউজের পেছনের সিঁড়িতে বসে “সব লোকে কয় লালন কি জাত” অথবা “আমি অপার হয়ে বসে আছি” গাইছেন। গান শেষ হলে সীমানার ওই প্রান্ত থেকে বুড়ো চাইনীজ প্রতিবেশী মিঃ ঝাং বলে উঠছেন “ব্রাভো, মোরশেদ! ওয়ান্স মোর!”

বছর পাঁচেক হলো তিনি রিটায়ার করে শহর থেকে দূরে ক্যাটসকিল পর্বতের উপত্যকায় একটা ছোট্ট শহরে বাড়ি কিনে থাকা শুরু করেছেন। বাড়ির বিশাল ব্যাকইয়ার্ডে সবজি চাষ করেন, শহরের প্রান্তে পাহাড়ঘেরা লেইকে মাছ ধরেন, সাঁতার কাটেন, কায়াক চালান, ট্রেইল ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটেন।

এতকিছুর পরও গত পঞ্চাশবছর ধরে তিনি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। মাসে দুইবার মনোচিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। এই অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, নির্মূল করা যায় না।

স্যাল জানে তাকে শীঘ্রই বাবার সাথে কথা বলতে হবে।

৫)

বৃহস্পতিবার রাত আটটা। ডিনার শেষ করে স্যাল একটা মেরলো ওয়াইনের বোতল নিয়ে বসে আছে। সে সাধারণত মদপান করে না। কিন্তু আজ মন বেশ বিক্ষিপ্ত। মানুষের এই এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য যে সে বিষণ্ণ হলে মদ খায়। আদতে মদ মানুষকে আরও বিষণ্ণ করে। আয়িশা থাকলে ভালো হত। সে গেছে ম্যারিল্যান্ডে তার ফুপাতো বোনের কাছে।

ওয়েস্টচেস্টারের বাড়িটা আফজাল সাহেব তার স্ত্রীর নামে কিনে নিয়েছেন। বেশ বড়সড় একটা কমিশন ফী স্যালের ব্যাংক একাউন্টে এসে জমা হয়েছে। তার খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু ব্যালান্সের দিকে তাকিয়ে সে অবসাদবোধ করছে।

স্যাল জানে বাবাকে কল করতে হলে এখনই শেষ সুযোগ। মোরশেদুল হক রাত নয়টায় ঘুমাতে যান। স্যাল ডায়াল করলো।

“হ্যালো, সালেহ। কি খবর?” ওই প্রান্ত থেকে মোরশেদুল হকের শান্ত কণ্ঠ ভেসে আসলো।

“ভালো, বাবা। তোমরা কেমন আছো?”

“ভালোই। তোমার মা’র অবশ্য একটু মাথাব্যথা। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আয়িশা কেমন আছে?”

“ভালোই আছে। ও ম্যারিল্যান্ড গেছে ওর কাজিনের কাছে।“

“আচ্ছা। তুমি কি উইকেন্ডে আসছো? মিতার আসার কথা ছিলো। কিন্তু ওর আর রাফায়েলের দুজনেরই কাজ পড়ে গেছে। বলেছি পারলে বাচ্চাদের ড্রপ করে দিতে যেতে।“ স্যালের বোন মিতা পেডিয়াট্রিশিয়ান, স্বামী রাফায়েল আইনজীবি। ছয় আর তিন বছরের দুইবাচ্চাসহ ওরা কানেকটিকাটে থাকে।

“হ্যাঁ আসব। আমার এই উইকেন্ডে কাজ নেই তেমন।“

“আচ্ছা। তো তোমার কাজ কেমন যাচ্ছে।“

“ভালো, বাবা।“ স্যাল একটু বিরতি নেয় “এই সপ্তায় একটা বাড়ি ক্লোজিং হলো।“

“ওহ, বেশ ভালো খবর। কিন্তু তোমার কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?”

“মনটা ভালো নেই, বাবা। তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।“

“হ্যাঁ, বলো।“

স্যাল কিছুটা সময় নিলো।

“বাবা, মনে আছে আমি সেকন্ড গ্রেইডে পড়ার সময় তুমি আমার জন্য নতুন একটা বাইসাইকেল কিনে আনলে? আমি তোমাকে বললাম তখনি ট্রেইনিং হুইল খুলে ফেলতে আর তুমিও তাই করলে। তারপর আমরা পার্কে গিয়ে সেটা চালানোর চেষ্টা শুরু করলাম।“

“মনে আছে। সেটা এতদিন পর তোমার কেন মনে পড়লো।“

“এই একটামাত্র কাজ তুমি আমাকে হাতে ধরে শেখাওনি। কারণ বাইসাইকেলের সাথে সাথে দৌড়ানো তোমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এই ব্যাপারটা আমার মনে গভীর দাগ রেখে গেছে। আমার বাবা কিছু করতে পারেন না, এটা মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

আমি কিছুক্ষণের মধ্যে সাইকেল চালানো শিখে গেলাম। তারপর বাড়ি ফেরার সময় আমি তোমাকে বলেছিলাম যে তুমি যদি যুদ্ধে গিয়ে বাম পা’টা নষ্ট না করতে তাহলে আজকে আমার সাথে সাথে থাকতে পারতে। উত্তরে তুমি কী বলেছিলে মনে আছে?”

“না, মনে নেই। কী বলেছিলাম?”

“তুমি বলেছিলে যে একদিন আমি তোমার অকেজো পায়ের জন্য গর্ববোধ করব। বাবা, আমি সত্যি গর্ববোধ করি।“

কিছুক্ষণ বাবা-ছেলে দুইজনই নীরব থাকলো। নীরবতা ভাঙলেন মোরশেদুল হক।

“সালেহ, তুমি আমাকে শুধু এটা বলার জন্য ফোন করোনি।“

স্যাল হেসে ফেললো। বাবার কাছে কিছু গোপন করা অসম্ভব।

“ঠিক ধরেছো, বাবা। আরেকটা কথা তোমাকে জানানোর ছিলো। বেশকিছুদিন ধরে আমার ক্লায়েন্টেলের একটা বড় অংশ বাংলাদেশ থেকে পাচ্ছি। এরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত আর নয়ত সরকারি আমলা। আমেরিকায় বাড়ি কেনার টাকা যে এরা কেউই বৈধ পথে উপার্জন করেনি সে ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ নেই।“

“সালেহ, তুমি বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন নও। এটা দেখা তোমার কাজ নয়। তুমি তোমার কাজটাই করছো। আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত।“

মোরশেদুল হক কিছুক্ষণ বিরতি নিলেন “তুমি আসলে কী বলতে চাচ্ছো সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি জানি যে আমার বন্ধু সালেহর প্রাণ আর আমার বাম পা’টা একেবারেই বৃথা গেছে। ওসব নিয়ে ভাবতে আর ভালো লাগে না।“

আবারও অস্বস্তিকর বিরতি “আচ্ছা, শোনো। ব্যাকইয়ার্ড থেকে লালশাক তুলেছি। লেইক থেকে ধরা একটা ট্রাউট আছে। তুমি উইকেন্ডে আসলে রান্না করব, কেমন? এখন ঘুমাতে যাই।“

মোরশেদুল হক তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিলেন কিন্তু তার আর্দ্র হয়ে ওঠা কণ্ঠ লুকাতে পারলেন না।

প্রাক্তন শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন: ২০০২ - ২০০৩

হাবিবুর রহমান খান

সেশন: ২০০২ - ২০০৩