বই: সেই সময়
লেখক: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৭০৯
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর টাইম ট্রিওলজির প্রথম বই ‘সেই সময়’।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হল “সময়”। কোন সময়? ঘড়ির সময়? না! এটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এই সময় এক জীবন্ত সময়। বাংলা সাহিত্যের নবযূগের উত্থানের সময়, বাংলার বিশেষ করে কলকাতায় নতুন করে শিক্ষিত সমাজের উত্থান হওয়ার সময়, সমাজের অন্ধকারে নিমজ্জিত সময়, একই সঙ্গে নতুন আলোর দিগন্ত উন্মোচনের সময় ।
বইটির কালপর্ব: ১৮৪০-১৮৭০।
‘সেই সময়’ উপন্যাসের এক খেয়ালি, বিচিত্র, জেদী কিন্তু হৃদয়বান ও আদর্শবান জমিদারপুত্রকে মূলত সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে ধরে নিয়ে গল্পটি সামনে এগিয়েছে। নাম তার নবীনকুমার। তার সমগ্র জীবন, পাগলাটে খেয়াল, কোমল হৃদয়, তীক্ষ্ণ জেদ আর পূর্ণাঙ্গ জীবনের মধ্যে দিয়ে আমরা গল্পটিতে এগিয়ে যেতে পারি। গল্পের আরও একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র, জমিদারের পালিত পুত্র গঙ্গানারায়ণ। যার হৃদয় জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে মমতা আর ভালোবাসা, রয়েছে নিপীড়িত শ্রেণির প্রতি সমব্যথীতা। গল্পে আরও প্রকাশ পেয়েছে বালিকা বয়সে বিধবা হওয়ার পর একা থাকার কথা, সমাজের চাপে বারবনিতা হয়ে যাওয়ার কথা। স্বামীর অপরাধ মুখ বুঝে সহ্য করার গল্প যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে নতুনভাবে শুরু করে সুখী হওয়ার গল্প, রয়েছে বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বামীকে খুন করার আখ্যান। কিন্তু উপন্যাসজুড়ে শুধুই কি সমাজের এই সাধারণ ও জমিদার প্রতীকশ্রেণির উল্লেখ? সেটা তো আর লেখক সুনীল এর স্বভাবে নেই। ‘বাংলার রেনেসাঁস’ নামে পরিচিত বাংলা সাহিত্যের এবং সমাজ সংস্কার এর সূচনার যুগে যাদের নাম সবার আগে আসে, তাদের মধ্যে রয়েছেন; বিখ্যাত ডেভিড হেয়ার সাহেব, রিচার্ডসন, বীটন (প্রথম স্বীকৃত নারীদের স্কুল বেথুন কলেজ এর প্রতিষ্ঠাতা), লর্ড বেন্টিক, লর্ড ক্যানিং ডিরোজিও, রিচার্ডসনসহ আরও অনেকেই। লেখক সুনীল তাঁর এই কালজয়ী উপন্যাসে তখনকার ইতিহাস এর উল্লেখযোগ্য এসকল বিখ্যাত মানুষদেরকে নিয়ে সামনে এগিয়েছেন।
আর বাঙ্গালিদের মধ্যে রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসের রচয়িতা প্যারীচাদ মিত্র, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, নীলদর্পন এর রচিতা দীনবন্ধু মিত্র, এভারেস্ট এর উচ্চতা পরিমাপ করা রাধানাথ শিকদার, রাজা রামমোহন রায়, শিশু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং যুবক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই প্রতিটি চরিত্রই প্রাণ পেয়েছে ঔপন্যাসিকের সুনিপুণ লেখনীতে।
বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের সকল উজ্বল নক্ষত্র যেই সময়টিতে, সেই সময় তো গল্পের নায়ক হবেই।
গল্পে স্থান পেয়েছে তখনকার মদ-নারীতে আকৃষ্ট বাবুসমাজ, নিপীড়িত প্রজা শ্রেণি, তেমনি আছে সমাজ সংস্কারকগণ। সমান্তরালে প্রকাশ পেয়েছে নবজাগরণের তরুণ সমাজ- যাদের এক শ্রেণি ইংরেজ অনুকরণে মত্ত, আরেক শ্রেণি সমাজে শিক্ষার আলোয় দীক্ষিত হয়ে ধারণ করে দেশাত্মবোধ ও ছুঁটে চলে জাগরণের সন্ধানে। এছাড়াও, মেঘনাদবধ কাব্যে প্রেমে পড়ে যাওয়া মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিস্তারিত জীবন বিবরণ পাওয়া যায় এই বইয়ে।
বইটি পড়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে যেন নতুন করে জানলাম। বিধবাবিবাহ ও পরোপকারে আত্মত্যাগী এই মহান পুরুষ যে নিজ জাতি থেকেই কত বাধার সম্মুখীন হয়েছে তা দেখলাম। দেখলাম মাইকেল মধুসূদন এর সংগ্রাম। “পড়লাম” এর পরিবর্তে “দেখলাম” বলেছি এই কারণে যে লেখক যেন প্রতিটি চরিত্র প্রতিটি ঘটনা আমাদের সামনে জীবন্ত করে সিনেমার মতই দেখিয়েছেন।
কেবল মহাপুরুষদের উল্লেখই নয়, সেই সাথে বইয়ে রয়েছে ১৮৫৭ এর ‘সিপাহী বিপ্লব’ ও ‘নীল বিদ্রোহ’, আছে মেয়েদের নিয়ে স্কুল খোলার জন্য বেথুন সাহেবের সংগ্রাম।
এধরনের ভারী আকারের বই গুলো পড়ার সময় প্রায় সর্বদাই আমি বারবার খেয়াল করি যে আর কতদিন লাগবে শেষ হতে, আর কত পৃষ্ঠা বাকি আছে? কিন্তু সুনীল এর ‘সেই সময়’ একে তো শেষও হয়ে গেছে দ্রুত আবার বারবার মনে হচ্ছিল যেন শেষ না হয়, শেষ না হয়। এমনই জাদুকরী মোহ আছে বইটিতে।
আড়াই বছরের টানা গবেষণার সাথে এই লিখা চালিয়ে খুব যত্ন করেই লেখক রচনা করেছেন উপন্যাসটি। তার পরিশ্রম বোঝা যায় বইয়ের শেষে প্রায় সাড়ে ৩ পৃষ্ঠা জুড়ে রেফারেন্স বই এর উল্লেখ দেখেই। অথচ এত গবেষণার পরেও উপন্যাসটি পড়লে মনে হবে সব জীবন্ত চরিত্রই, এ যেন অন্যরকম প্রাণ। গবেষণার বইয়ের কাঠখোট্টা তথ্যের বদলে এতটা জীবন্ত ও বাস্তবসম্মত ভাবে বাংলায় আদৌ কোনো লেখক তুলে ধরতে পেরেছেন কিনা আর বর্তমান প্রজন্মকে ইতিহাস নিয়ে আকৃষ্ট করার এর চেয়ে কোনো ভালো উপায় আছে কিনা তা নিয়ে তর্ক করাই যায়। বইটি সবার ভালো লাগবে এই বিশ্বাস, পছন্দের দুই উক্তি দিয়ে শেষ করি_
“কৃতজ্ঞতা একটা বিষম বোঝা। অনেকেই সারাজীবন এ বোঝা বহনে অক্ষম। তাই এই বোঝা ঝেড়ে ফেলে উপকারী ব্যক্তির শত্রুতা করে তারা স্বস্তি বোধ করে।”
“ইংরেজের এই ন্যায়বিচারের প্রতীক ঐ সুপ্রিম কোর্টের চূড়া। লোকে এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ভক্তিভরে সেদিকে তাকায়। এখনো কেউ জানে না যে বিচার ব্যবস্থার এই আড়ম্বর ইংরেজ জাতির একটি বিলাসিতা মাত্র। প্রয়োজনের সময় এইসব বিলাসিতা ছেঁটে ফেলতে তারা একটুও দ্বিধা করে না।”
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৩
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, মে ১১, ২০২৩
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/সোমবার, আগস্ট ১২, ২০২৪
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪