মে ১৯, ২০২৫

সরণ

দূরত্ব নিয়ে ভাবনা আমার ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলার সব থেকে ভয়ের কাজগুলোর দুটি হচ্ছে ঘরে একলা ঘুমানো আর রাতের বেলা প্রকৃতির ডাক সাড়তে যাওয়া। আমি ছোট মানুষ- আটটা বাজতেই চোখে ঘুম ঢুলুঢুলু করতো। মা খাইয়ে দাইয়ে বলতেন, “শুয়ে পড়ো গে যাও, আমি এক্ষুনি আসছি।” আমি চাইতাম মা-ও তখন আমার সাথে যাক। বারান্দা থেকে শোবার ঘর তখন আমার কাছে ঠেকতো যেন শত যোজন দূরত্বে অবস্থিত। আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ মহাশয়ের কৃপাদৃষ্টি পড়েনি তখনো। বারান্দায় পিতলের কুপি; ঘরে মিটমিটে করে হারিকেন জ্বালানো। বাড়ির চারপাশে বাঁশঝাড়। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মেশানো কত পরিচিত-অপরিচিত ধ্বনি। উপায় নেই, যেতেই হতো। মা’র তখনো অনেক কাজ বাকি আর আমার বসে থাকবার মতো অবস্থা নেই। রাতে পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলে বাবাই একমাত্র ভরসা। আরেক ভরসা বাঁশঝাড়ের মধ্যেকার আধাপাকা টয়লেটটা। বাবা জানতেন ছেলে ভয় পায়। বলতেন, ছেলে মানুষের ভয় কী রে! আমি কথা বলতে থাকব, তুমি যাও। সেসব দিন কবেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখন টয়লেট মহাশয় ঘরের এক কোণে জায়গা দখল করে সগর্বে দন্ডায়মান। এলইডি আর ফ্লুরিসেন্ট টিউবের আলোর আধিক্যে রজনীকে দিবস বলে ভ্রম হয়। এই দূরত্বের জ্বালা তাই অদ্য ঘুচে গেছে।

নবম শ্রেণিতে উঠবার পর দূরত্ব পুনরায় নতুন নামে আমার জীবনে আবির্ভূত হলো। দুবছর দুমাস কত যে অংক কষে এর মান বের করলাম তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের জন্য কত মানুষ বাস চাপা হতে বেঁচে গেল, আর কত বিড়াল ইঁদুরকে না ধরতে পেরে, কত ব্যাঘ্র হরিণকে না শিকার করতে পেরে অভ্যুক্ত রয়ে গেল তার আর হিসেব রইলো না। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে চলে এলাম শহরে। মা কাতুরে একটা ছেলে তখন মা থেকে বায়ান্ন কিলোমিটার দূরে রাত্রিযাপন করতে লাগল। মাসে-দুমাসে একবার দেখা পেতে লাগলো মায়ের। মনের মধ্যে মহা এক আন্দোলন শুরু হলো যে, গিয়ে বাড়ির পাশের কলেজটিতে ট্রান্সফার নেব নেব অবস্থা। বেশিদিন লাগল না- মাস তিনেকের মধ্যেই মন শান্ত হয়ে আসলো আর সেই সাথে আরেকটু উচ্চতর দূরত্ব বের করবার সুযোগ এসে হাতে ধরা দিল। সেথায় এই এইটুকুনির জন্য কত গোল মিস হয়ে গেল; আবার কেউ ক্যাচ মিস করে খেলাটাকে মাটি করে দিল তার হিসেবেও আর টুকে রাখা হলো না। বারেক চাচার কাছে দশ টাকা কেজি দরে সেসব গুরুত্বপূর্ণ নথি বেচে দেওয়া হলো ভর্তি পরীক্ষার পর পর। ভাবলাম, যাক এবার অন্তঃত দূরত্বের যন্ত্রণা ঘুচলো। ঘুচেও ঘুচলো না শেষ পর্যন্ত- বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কপালে জুটলো পরিসংখ্যান। এখন হিসেব করি গড় মান থেকে গড় দূরত্ব, মধ্যক মান থেকে গড় দূরত্ব, প্রচুরক মান থেকে গড় দূরত্ব!

কথায় কথা বাড়ে। এক স্মৃতি এনে জড়ো করে আরও সহস্র স্মৃতিকে। সেসব বাড়ন্ত কথা আর স্মৃতির চাপে আর মূল কথাটাই বলা হয়ে ওঠে না কখনও কখনও। লেখার শুরুতে বাক্যগুলোকে হন্যে হয়ে খুঁজতে হয়। এরপর একটা বাক্য আসলে কোথা থেকে আর দশটা বাক্য এসে ভীড় জমায়। সবারই একটা জায়গা চাই। কাকে রেখে কাকে না করি এই নিয়ে দ্বন্দ বেঁধে যায়। আজকের এই লেখায় হলো এ অবস্থা। বলতে এসেছিলাম দুটো সহজ কথা। ভূমিকার ভীড়ে সেই আসল কথাটায় আবার হারিয়ে না যায়! সাধে কী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

“সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।
লেখার কথা মাথায় যদি জোটে
তখন আমি লিখতে পারি হয়তো।
কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে,
যা-তা লেখা তেমন সহজ নয় তো।”

ভূমিকা অংশটুকু এবারের মতো জোর করে ক্ষান্ত দেওয়া যাক। যা বলবার জন্য এত কথার অবতারণা সে কথাটি বলা হোক। দূরত্ব জিনিসটিকে শুধু দিক আর মিটার, কিলোমিটার, মাইল, আলোকবর্ষ এরূপ কয়েকটি এককে সম্পূর্ণরূপে মেপে ফেলা সম্ভব- পদার্থবিজ্ঞানের এ কথাটির আমি ঘোর বিরোধী! বরঞ্চ আমি মনে করি দূরত্বের এককটি হওয়া উচিত আমার অবস্থান থেকে সে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আমাকে কত ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে তার উপর। আমার পক্ষে কি আদৌ সে পথটুকু অতিক্রম করা সম্ভব তার উপর। যদি সে স্থানে পৌঁছানো আমার পক্ষে কোনোদিন সম্ভব না হয় তবে তা ন্যানোমিটার দূরত্বে অবস্থিত হলেও, আমার জন্য কি তা অসীম দূরত্ব নয়? টেবিলের ওপাশে, মাত্র মিটার দেড়েক দূরে কয়েক বছর কাটিয়েও ভালোবাসার কথাটা না জানাতে পারা দুজন ছেলেমেয়ের মধ্যকার প্রকৃত দূরত্ব কি দেড় মিটার নাকি অনন্তকালের, বলুন দেখি? অথবা বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু হয়ে আজিমপুর সরকারি কর্মচারী কলোনির বাইরের ফুটপাতে বসে থাকা হাড়জীর্ণ এক বৃদ্ধার থেকে সত্তর মিটার দূরের এক ভবনের ছাদে বৃষ্টিতে ভিজে পরম তৃপ্তি লাভ করা এক যুবকের মধ্যকার প্রকৃত দূরত্ব কি সত্তর মিটারই? নাকি সেটি মাপবার জন্য আলাদা কোনো এককের প্রয়োজন? শাহবাগে, যেখানটায় কাজী নজরুল ইসলাম, তারপর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কবরখানা- সেইখানটায়  এক বছর ছয়েকের বালক তার বছর তিনেকের ভগিনীকে আপন কোলে লয়ে বসে থাকে মানুষের কৃপাদৃষ্টির আশায়। আচ্ছা, সেখান হতে মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে টিএসসিতে যে কপোত-কপোতীরা বসে তাদের প্রণয় কুঞ্জ রচিত করছে তাদের থেকে কি ঐ বালক-বালিকাদ্বয়ের প্রকৃত দূরত্ব পাঁচশো মিটারই মোটে?

0504 হরিপদ শীল অব্যক্ত Poem 2nd 1
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬-১৭

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ