fbpx

ঋণ

প্রতিদিনের মতো সেদিনও হুড়মুড় করে বের হচ্ছি কলেজ থেকে। আমি একটা নতুন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের নতুন লেকচারার। এটাই প্রথম চাকরি। তাই সবসময় চেষ্টা থাকে আমার টিউটোরিয়াল ক্লাসে যেন ছাত্র ছাত্রীদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারি। ওরা কার্ডে যাতে ভালো করে সে জন্য আইটেমে কখনো ছাড় দেই না। কিন্তু মাঝে মাঝে এখন ছাড়তে হচ্ছে একজনের জন্য! আমি যথাসম্ভব শুক্রবারকেই বেছে নেই দেখা করার জন্য। কিন্তু মাঝে মাঝে সাহেবের মাথায় ভূত চাপে! না তার কাজের দিনেই দেখা করতে হবে!

আমি বলি, বিয়ের পর এমন প্রেম থাকবে তো?

তার সাফ সাফ উত্তর, বিয়ে মানেই প্রেমের ইতি, যুদ্ধের শুরু!

আমি বলি, যুদ্ধ ময়দানেও কিন্তু প্রেমের ইতিহাস আছে অনেক।

ইস! এই দিবাস্বপ্ন দেখতে গিয়ে দেরি হলে মহাশয় আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন না। কিন্তু আমাকে দাঁড়াতেই হল।

ম্যাডাম ম্যাডাম একটু শুনেন! একটা কচি কণ্ঠের আহ্বান। আরে এ তো সেই আচারওয়ালা পিচ্চি। চোখ মুখ ফোলা। চোখে পানি। একটু দূরে আপাদমস্তক কালো বোরকা পরা মহিলা ফুটপাথে বসে পড়েছেন। আমি এদের আগেও দেখেছি। ছোট ছোট বয়েমে অনেক রকমের আচার বিক্রি করে। দাম দোকানের চেয়ে বেশি হলেও কোন প্রিজার্ভেটিভ দেয় না এই বিশ্বাসে কিনেছিলাম একবার। আমি আচার খাই না। দাতের টকে সেনসিটিভিটি এতই বেশি যে সব বিজ্ঞাপনের পেস্ট ফেল! কিন্তু মা একবার খেয়ে একদম প্রেমে পড়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝেই কিনতে হত। মহিলা কোন কথা বলত না। যা দরদাম এই পিচ্চি করত। আজ কী হল? কাঁদছে কেন?

হাহাকার করে বলল, —আমার মায়ের জানি কী হইছে। একটু দেহেন।

সিকিউরিটি গার্ড কাছেই ছিল। বলল,

— আপা বাসায় যান। এরা ঘন্টা দুয়েক হল এই ঢং করছে। সকালে তো দিব্যি আচার বিক্রি করছিল।

আমি বললাম, —আপনিও আসুন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি দেখি কী হয়েছে।

—আরে ঝামেলায় যাইয়েন না তো! এরা সবসময় নাটক করে!

আমি এগিয়ে গেলাম, মহিলার নেকাব সরিয়ে কপালে হাত দিতেই মনে হল গরম কিছুতে হাত দিয়েছি, হাতে ছ্যাকা দিয়ে উঠল।

আমি গার্ডকে বললাম, তাড়াতাড়ি ইমার্জেন্সিতে নিতে হবে মহিলার ভয়ানক জ্বর। এই ভয়ানক জ্বরেও সে এই পোশাক পরে আছে। গার্ডের সাহায্য নেবে না তারা। না পেরে দুজন খালাকে ডেকে আনলাম হাসপাতাল বিল্ডিং থেকে। ধরাধরি করে ইমার্জেন্সিতে নিতেই ভর্তি লিখে দিল। সব ফর্মালিটিজ শেষ করে মহিলাকে ওয়ার্ডে একবার দেখতে যাব এমন সময় দেখি ফোনে পনেরোটা মিসড কল। আমি ভয়ে ভয়ে কল ব্যাক করলাম রিসিভ করল না। বোধহয় রাগ হয়েছে সাহেবের। আচ্ছা ও বোধহয় অপেক্ষা করে করে বাসায় ফিরে গেছে। আমি ততক্ষণে ওদের অবস্থা দেখে আসি। অবশ্যই ওষুধ কিনতে পারবে না। পুওর ফান্ড থেকে ম্যানেজ করতে হবে। অবাক হয়ে গেলাম ওয়ার্ডে গিয়ে একটা ওষুধ বাদে সব কিনে ফেলেছে পিচ্চি। একটা কেনার টাকা ম্যানেজ করতে পারেনি। আমি তাকে পুওর ফান্ডের কথা বললাম। সে কিছুতেই নেবে না। অদ্ভুত জেদ! উল্টে আমার কাছে টাকা ধার চাইছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। আমি আর তর্ক না করে ব্যাগে যা ছিল রিক্সা ভাড়া বাদ দিয়ে ধার দিয়ে দিলাম। দেখলাম খুব মনোযোগ দিয়ে গুনতে গুনতে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে পিচ্চি। আমি বললাম, লিফটে চল। তার জবাব, সিঁড়িতে যেতে পারব।

রাস্তায় আরো দুইবার ফোন করে দেখি ফোন বন্ধ। বোধহয় চার্জ নেই। বাসায় গিয়ে খেয়ে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠলাম। কফি বানিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখি মহাশয়ের তিনটা মিসড কল। মিটিমিটি হেসে কল ব্যাক করে বললাম,

— কী? স্যারের রাগ পড়েছে তাহলে!

—ভাবী আমি নিলয়। আবীর হাসপাতালে ভর্তি।

—কী? কোন হাসপাতাল?

ঘরের পোশাকেই দৌড়ে নামলাম। এখন আর লিফটের দরকার পড়ল না।

সিএনজি নিয়ে যথাসম্ভব দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়। বোধহয় আমার জন্যই। আবীরের কেবিনে ওর মা আর ছোট বোন বসা। আমাকে দেখা মাত্র আন্টি উঠে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।

মনে পড়ে গেল, ইনিই পাত্রী দেখার দিন আমাকে অপছন্দ করেছিলেন। ছেলের পছন্দ শুনে পরে নিমরাজি ছিলেন। আকদের সময় একটা কথাও বলেননি। অথচ আজ আমরা যেন একাত্মা। দুজনেরই আপনজনের আজ বিপদ। কী হয়েছিল?

জানতে পারলাম, আমার সাথে দেখা করার জায়গাতে পৌঁছানোর আগেই বাইক এক্সিডেন্টে মাথায় আঘাত পেয়ে চেতনা হারায় আবীর। যথারীতি কালপ্রিট গাড়ি দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনা দেখে একজন পথচারী। সেইই আমাকে এত বার ফোন করেছিল। আমার নম্বর লগলিস্টে পেয়ে। সেই অচেনা ভদ্রলোক ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাসায় যোগাযোগ করে, কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। দেবদূত বলতে হবে ভদ্রলোককে। একবার দেখা করতে মন চাইছিল। মা বললেন, রাতে একবার আসবে বলে গেছে।

আটচল্লিশ ঘণ্টা পর ডাক্তার ঘোষণা করল এখন সে নিরাপদ । যদিও জ্ঞান ফেরেনি। মা জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। আমি গোসল, খাওয়া সেরে আবার গেলাম মাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফেরার লক্ষণ দেখছি। দেখলাম একজন অচেনা ভদ্রলোক দাড়িয়ে কেবিনের বাহিরে। আমি একটু অবাক হয়ে বের হলাম। ভদ্রলোক হেসে বললেন, —আপনি বোধহয় বৌ!

—মানে?

—ঐ ফোনে সেভ করা ছিল এই নামে!

—ওহ! আপনি! কী বলে যে ধন্যবাদ দেব।

—আমি কিন্তু আপনার ধন্যবাদ নিতে আসিনি বরং আপনাকে কিছু বলতে এসেছি।

—প্লিজ ভিতরে এসে বসে বলুন।

—না রোগীর সামনে বলবো না। আপনি বরং বারান্দায় আসুন।

—জি আসছি। কেবিনের দরজা ভেজিয়ে বারান্দায় গেলাম।

—বলুন? কী বলবেন?

—সেদিন সবচেয়ে বেশি ফোন করেছি আপনাকে। আপনি কী এমন রাজকার্য করছিলেন যে একটা বার রিসিভ করতে পারলেন না? আপনজনের প্রতি এত অবহেলা কেন? উনি নিশ্চয়ই ভালোবেসেই আপনার নম্বর বৌ লিখে সেভ করেছেন।

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললাম,

 —আমি আসলে তখন একটা রোগী ভর্তি করছিলাম হাসপাতালে। গরীব রোগী, ভীষণ জ্বর। সাথে একটা বাচ্চা ছেলে ছাড়া কেউ ছিল না।

—সত্যি বলছেন?

—চাইলে আপনি হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পারেন।

—বেশ। তাহলে এ আপনার প্রাপ্য।

—কী প্রাপ্য?

—এই যে আমার সাহায্য।

—না তা না….

—অবশ্যই তাই। প্রকৃতি ঋণ পছন্দ করে না। দেরি হোক, তাড়াতাড়ি হোক শোধ করে দেয়। আপনি সৌভাগ্যবতী প্রকৃতি আপনার প্রয়োজনের দিনেই ঋণ শোধ করেছে। রোগী এখন কেমন আছেন?

—ভালো আছেন। সম্ভবত আজই জ্ঞান ফিরবে।

—খুব ভালো।

—আপনি দেখা করে যান।

—না থাক। আপনি বরং তাকে বলবেন কোন পথচারী বিপদে পড়তে দেখলে যেন ফেলে চলে না যান। অবশ্যই সাহায্য করেন।

—বলব, অবশ্যই বলব। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

—করুন।

—আপনিও তো বাকি সবার মত এড়িয়ে যেতে পারতেন।

—এড়িয়ে গেলে আমার মায়ের মত আপনিও বিধবা হতে পারতেন।

—কী বলছেন? শিউরে উঠলাম আমি।

—আমার বাবাকে এক্সিডেন্টের বারো ঘণ্টা পর পুলিশ মৃত পেয়েছে রাস্তার পাশে। ওয়ালেট, ফোন কিছুই ছিল না সাথে সব চুরি গেছিল। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল মর্গে। আশেপাশের সব হাসপাতালে খোঁজ করে কিছু না পেয়ে যখন পুলিশের কাছে গেলাম। তারা জিজ্ঞাসা করল মর্গে গেছি কিনা। মর্গে না পেলে মিসিং ডায়েরি লিখবে। অগত্যা মর্গে গেলাম। গিয়ে দেখলাম…

আমার চোখে পানি দেখেই বোধহয় ভদ্রলোক দ্রুত চলে গেলেন।

জ্ঞান ফিরতেই মা, বোনকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কান্না। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছি। আমার চোখেও পানি। অবশেষে স্বস্তি পেলাম।

এত ভয়াবহ কেটেছে দিনগুলো যে ঐ আচার ওয়ালা পিচ্চির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তিন দিন পর দেখি বড় এক বয়েম আচার নিয়ে দাড়িয়ে আছে হাসপাতালের সামনে। দেখতেই সব মনে পড়ে গেল।

—কিরে? তোর মা কেমন আছে?

—জি ম্যাডাম ভালো। বাসায় নিয়ে গেছি। আর রোদে পুড়ে আচার বেচতে দেই না। আমিই বেচি।

—খুব ভালো।

—তয় আপনেরে একবার দেখতে চায় মা। সেইদিন তো জ্বরের ঘোরে বোঝেনাই। আর তারপর তো আপনেরে আর পাইলাম না। রোজ খাড়ায়া থাকি।

—আরে এমন বিপদে পড়েছিলাম… নাহলে অবশ্যই দেখতে যেতাম।

—আপনের বিপদ কাটছে?

—হ্যাঁ, আল্লাহর রহমতে কেটে গেছে।

—যাক আলহামদুলিল্লাহ। এইডা লন।

—এত বড় বয়েমের আচার কে খাবে? আমি তো খাই না। আর মাকে এত আচার দেয়া যাবে না। বরং ছোট দুই বয়েম দিয়ে যাস।

—ঐ টাকার আচার ম্যাডাম।

—কোন টাকা?

—ঐ যে ধার দিছিলেন। আরো এক বয়েম পাবেন।

—ধুর বোকা। ঐ টাকা এমনি দিয়েছি।

—না না। আমি ভিক্ষা নেই না।

বেশ। এই আচার ছোট ছোট বয়েমে ভরে কাল নিয়ে এসো। আমার পরিচিত দোকানে যদি বিক্রি করা যায় তাহলে টাকা নেব।

—আচ্ছা। ছেলেটা খুশিমনে চলে গেল।

পরদিন ছুটির সময় দেখি ঠিক হাজির।

—বাহ! এসে গেছিস?

—হ! চলেন!

—দুইটা সমস্যা আছে।

—কী ম্যাডাম?

—এক আমাকে ম্যাডাম ডাকবি না আপা ডাকবি। দুই ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।

—তাইলে আমি খাড়ায়া থাকি। আপনে খাইয়া আসেন।

—পাগল নাকি? তোকেও খেতে হবে আমার সাথে।

—ছেলেটা কিছুক্ষণ ভাবলো। বোধহয় নিমন্ত্রণ রক্ষা করার বিষয়ে কিছু একটা ভেবেই রাজি হল।

ওর সুবিধার জন্য সাধারণ মানের খাবার হোটেলে গেলাম। খুব আগ্রহ নিয়ে খেতে শুরু করে মাঝপথে থেমে গেল।

—কিরে? রান্না ভালো হয়নি?

—একটা পলিথিন পাওয়া যাবে?

—কেন? কী করবি?

—একটা পলিথিনে ভাত উঠাবো।

—এটো ভাত উঠিয়ে কী করবি?

—মা বোনটার জন্য নিতাম।

—আচ্ছা, সে ব্যবস্থা হবে। এখন খেয়ে নে। চুপচাপ পুরো ভাতটুকু খেল। এক দানা ভাতও লেগে নেই প্লেটে।

খাওয়া শেষে দোকানে গেলাম। আমার বান্ধবীর বাবার শেয়ার আছে দোকানে। কর্মচারীরা সবাই জানে। তাই বলতেই আচার গুলো রেখে। টাকা দিয়ে দিল। এখানে অবশ্য দাম নিয়ে কোন জেদ করেনি পিচ্চি।

—কিরে খুশি? পিচ্চির চেয়ে আমিই বেশি খুশি।

—যা বাড়ি যা। যাওয়ার পথে চাল, ডাল, ডিম কিনবি।

—কিন্তু টাকাটা?

—আবার ধার দিলাম। এখানেও আচার দিয়ে যাবি এখন থেকে। তাহলে বিক্রি বাড়বে। আমি ঐখানেই চাকরি করি পালিয়ে যাচ্ছি না। যখন পেট পুরে ভাত খাওয়ার পর বাড়তি টাকা থাকবে তখন দিয়ে যাবি পুরোটাই একসাথে। কেমন?

—জি আচ্ছা। মাথা নিচু করে বাড়ির পথ ধরল।

—ওকে যেতে দেখছি হঠাৎ পিছু ডাকলাম।

—এই তোর নাম তো জানি না।

—আমার নাম আবু বকর সিদ্দিক।

—বাহ! এজন্যই তুই এত ভালো। শোন মন খারাপ করিস না। আল্লাহ তোকে পরীক্ষা করছে দারিদ্র্য দিয়ে। আমাকে পরীক্ষা করছেন টাকা দিয়ে। সাহায্য নেওয়াতে লজ্জার কিছু নেই। বরং কারো বিপদে সাহায্যের হাত না বাড়ানোতেই লজ্জা। বুঝলি?

—জি। আমি খুব তাড়াতাড়ি টাকা শোধ করে দেব।

—আচ্ছা বলে হেসে চলে এলাম।

আবু বকর সিদ্দিক আবার তার মাদ্রাসাতে পড়তে যায় ছোট বোনের হাত ধরে। ওর মায়ের বানানো আচার দিয়ে ছেয়ে গেছে সুপার শপগুলো।

না এখনো হয়নি এসব। তবে স্বপ্ন দেখতে দোষ কী?