মে ১৯, ২০২৫

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক দর্শন — ১ম পর্ব

হাওয়া বড় চঞ্চল
বাংলার অঞ্চল
পাখিসব ওড়ে মনঃসুখে।
সুবাস ছড়ায় ফুল
আনন্দে মশগুল
বসন্ত দেখ এসে গ্যাছে!

             শতবর্ষ পূর্বের এমনি এক বসন্তে টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া এক বালক আগাগোড়া পাল্টে দিল বাংলার ইতিহাসকে। সগর্বে, সদম্ভে বিচরণ করল এই ধরিত্রীতে। বিরাজিত হলো ইতিহাসের রাজসিংহাসনে বাঙালি জাতির পিতারূপে। কিছুদিন পরপরই চারদিকে যখন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা তাদের উপস্থিতি নির্লজ্জভাবে জানান দিচ্ছে, জাতির জনকের এই জন্মমাসে আসুন কথা বলা যাক তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের দিকটি নিয়ে। বলে রাখা ভালো, হিমালয়সম এ মানুষটির অসাম্প্রদায়িক দর্শন নিয়ে আলোচনা বেশ দীর্ঘ এবং একইসাথে দুঃসাহসিক একটি আলাপের বিষয়। আমার এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে চেষ্টা করব তাঁর জীবনের কিছু ঘটনাবলি উল্লেখ করবার, যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতার দিকটি ফুটে উঠেছে এই মাত্র।

         মূল আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। বোঝাই যাচ্ছে, ‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ শব্দটির উৎপত্তি ‘সম্প্রদায়’ শব্দটি থেকে। জীব মাত্রই কোনো না কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। ক্ষুদ্র অর্থে, সাম্প্রদায়িকতা হলো সম্প্রদায় ভিত্তিক চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড। স্বভাবতই প্রত্যেক মানুষই চায় নিজ সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ঘটাতে, নিজ সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে। সেই অর্থে সাম্প্রদায়িকতা মন্দ কিছু নয় বটে। কিন্তু বিপত্তিটা বাধছে অন্য জায়গায়। সাম্প্রদায়িকতার একটি বিশেষ সংজ্ঞা রয়েছে। সে সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা হলো এমন এক ধরনের মনোভাব যার ফলে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত গোষ্ঠী অন্য সকল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে। এমনকি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের ক্ষতিসাধন করতেও শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে।

ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে বিতর্কের শেষ নেই। যুগে যুগে এ উপমহাদেশ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা হাড়েমজ্জায় টের পেয়েছে। তিয়াত্তর বছর পূর্বেই ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত হয়েছি আমরা। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের বলি যে কত মানুষ তা অনুমান করা কষ্টসাধ্য। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধে সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে লিখেছেন এভাবে—

“একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন, “দ্যাখো, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?”

হিন্দু-মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারেবারে গুরুদেবের ওই কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে, যে এ-ন্যাজ গজালো কী করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? ওই সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায়– তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক- তারাই হয়ে ওঠে পশু। যে সব ন্যাজওয়ালা পশুর হিংস্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে– শৃঙ্গরূপে, তাদের তত ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে– যাদের হিংস্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি! শিংওয়ালা গোরু-মহিষের চেয়ে শৃঙ্গহীন ব্যাঘ্র-ভল্লুকজাতীয় পশুগুলো বেশি হিংস্র– বেশি ভীষণ। এ হিসেবে মানুষও পড়ে ওই শৃঙ্গহীন বাঘ-ভালুকের দলে। কিন্তু বাঘ-ভালুকের তবু ন্যাজটা বাইরে, তাই হয়তো রক্ষে। কেননা, ন্যাজ আর শিং দুই-ই ভেতরে থাকলে কীরকম হিংস্র হয়ে উঠতে হয়, তা হিন্দু-মুসলমানের ছোরামারা না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।”

এছাড়া কাল্পনিক আরেককটি গল্প প্রচলিত আছে এ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নিয়ে যা থেকে এর ভয়াবহতা সহজেই আন্দাজ করা যায়। গল্পটি এরকম—

“এক শকুনের বাচ্চা তার বাবার কাছে আবদার করল মানুষের মাংস খাবে বলে। বাবা শকুন বলল, “ঠিক আছে, সন্ধ্যার সময় এনে দেব, খোকা।” এই বলে শকুন উড়ে গেল এবং আসবার সময় মুখে এক টুকরো শুকরের মাংস নিয়ে এসে বাচ্চাকে দিল। বাচ্চা বলল, “বাবা, এটা তো শুকরের মাংস, খাব না। আমি মানুষের মাংস খেতে চাই।” বাবা শকুন আবার উড়ে গেল এবং এইবার আসবার সময় এক টুকরো গরুর মাংস নিয়ে এলো। বাচ্চা শকুন এবার কান্না জুড়ে দিল এবং বলল, “আরে এটা তো গরুর মাংস নিয়ে এসেছ, মানুষের মাংস কোথায়? মানুষের মাংস ছাড়া আমি খাব না।” এইবার শকুনটি দুটো টুকরো একসাথে মুখে নিয়ে উড়ে গিয়ে শুকরের মাংসটি একটি মসজিদের পাশে এবং গরুর মাংসের টুকরোটি একটি মন্দিরের পাশে ফেলে দিয়ে চলে  এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে শুরু হলো দাঙ্গা কয়েকশ মানুষের লাশ পড়ে গেল। তখন গাছের ডাল থেকে নেমে বাপ-ছেলেতে মিলে খুব তৃপ্তি করে মানুষের মাংস খেল! বাচ্চাটা খেতে খেতে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, এত মানুষের মাংস এখানে কী করে এলো?” বাবা শকুন বললো, “এই মানুষ জাতটাই এরকম। সৃষ্টিকর্তা এদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব বানিয়ে জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু ধর্মের নামে এদেরকে আমাদের থেকেও হিংস্র বানানো যেতে পারে!”  শকুন বাচ্চা বললো, “তোমার অনেক বুদ্ধি, বাবা!” শকুন উত্তর দিল, “আরে, এটা তো আমি মানুষের কাছ থেকেই শিখেছি রে খোকা। এদের একটা অংশ যখনই কোন অনিষ্ঠ করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় তখনই সহজ রাস্তা হিসেবে এই ধর্মকেই ব্যবহার করে।”

*****

         এবার মূলপ্রসঙ্গে আসা যাক। বঙ্গবন্ধু তাঁর পঞ্চান্ন বছরের জীবদ্দশার জেলেই কাটিয়েছিলেন প্রায় তের বছর। তাঁর ছত্রিশ বছরের(১৯৩৯-১৯৭৫) দীর্ঘ নাটকীয় রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয়েছিল ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে ঠিকই তবে তার শেষ ইতি ঘটেছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের চেতনার এক অসামান্য স্ফুরন ঘটিয়ে। মুসলিম লীগে যোগদান করায় আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বলে ভ্রম হলেও তিনি এটিকে দেখছিলেন অন্য আঙ্গিকে— প্রভাবশালী, অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের কবল থেকে দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের মুক্তির পথ হিসেবে। অবশ্য পরবর্তীতে মুসলিম লীগ থেকে পৃথক হয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় এবং সবশেষ ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিফলন ঘটানোসহ জনগণকে স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে অধিকতর সম্পৃক্ত করবার লক্ষ্যে ‘মুসলিম’ শব্দটিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ করা হয়।

শেখ মুজিব আগাগোড়া যে একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও লেখক ভবতোষ দত্তের ‘আট দশক’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন:

“তখনকার পরিস্থিতিতে হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক এমন যে ভালো ছিল তা নয়। কিন্তু একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষই যে কীভাবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারেন তার উদাহরণ ছিলেন ইসলামিয়া কলেজের তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।”

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বেশ কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৩৮ সালে যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এবং শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে আসেন শেখ মুজিব তখন স্কুলের ছাত্র। তাঁর ওপর ভার পড়েছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার। সে প্রসঙ্গে তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন:

“আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কী বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ সংবর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। এগজিবিশনে যাতে দোকানপাট না বসে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা আশিটি দোকান হিন্দুদের ছিল। আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান-বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো – সবই চলত।”

আবার ১৯৫২ সালে, যখন গোপালগঞ্জের সমাজকর্মী চন্দ্র ঘোষকে চিকিৎসার জন্যে জেলের বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনকার কথা বঙ্গবন্ধু লিখছেন এভাবে:

“... … … চন্দ্র ঘোষ তাঁকে বললেন, “আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নাই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই, সে আমার ভাইয়ের মত। জীবনে তো আর দেখা হবে না।” সিভিল সার্জন এবং জেলের সুপারিনটেনডেন্ট, তাঁদের নির্দেশে আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল। চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। দেখে মনে হলো, আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, “ভাই, এরা আমাকে সাম্প্রদায়িক বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়! কোনোদিন হিন্দু-মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নাই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বোলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।”

এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার, ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখেই পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, “চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।”

(চলবে)

0504 হরিপদ শীল অব্যক্ত Poem 2nd 1
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬-১৭

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ