জুন ২০, ২০২৫

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক দর্শন — ২য়(শেষ) পর্ব

“সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে, হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে, বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।”
— শেখ মুজিবুর রহমান

               সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সাম্যের পরিবর্তে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ যে চরম একটি রাজনৈতিক ভুল; বঙ্গবন্ধুর ন্যায় প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ অল্পদিনের মধ্যেই তা বুঝতে পেরেছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে তাঁর চোখে ধরা দিচ্ছিল। এটিই তাঁকে শেষ পর্যন্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের দিকে চালিত করে।

বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আমরা শুধুমাত্র একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রই পাইনি, সেইসাথে পেয়েছি দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ একটি শক্তিশালী সংবিধান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই সংবিধানটি জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর; বঙ্গবন্ধু এতে স্বাক্ষর করেন একই বছর ১৪ ডিসেম্বর এবং কার্যকর হয় ১৬ ডিসেম্বর থেকে। রাষ্ট্র পরিচালনার এই সর্বোচ্চ আইন যে চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত তার একটি ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপারটি নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হলে তিনি এ ব্যাপারটিকে স্পষ্ট করতে বলেছিলেন:

“ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে ব্যভিচার— এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে। আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।”

এছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা— এই বিষয়গুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে বাহাত্তরের রচিত সংবিধানের ১২ এবং ৪১ নং অনুচ্ছেদে বলা ছিল:

১২। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য

(ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা,

(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,

(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,

(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার নিপীড়ন,

বিলোপ করা হইবে।

৪১। (১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা —সাপেক্ষে

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যেকোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;

(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।

(২) কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণে কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।

১৯৭৩ সালের ৫-৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উক্ত সম্মেলনে লিবীয় নেতা গাদ্দাফি ও সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সৌদি আরব বা লিবিয়া, কেউই তখনও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। গাদ্দাফি জানান, বাংলাদেশের নাম পাল্টিয়ে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ রাখা হলে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। সৌদি বাদশাও একই ধরনের কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু তৎক্ষনাৎ প্রস্তাবগুলো প্রত্যাখ্যান করেন। বাদশাহ ফয়সালকে দৃঢ়তার সাথে জবাব দেন যে, তাঁর দেশের নামও কিন্তু ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদি আরাবিয়া’ নয়।

                   বঙ্গবন্ধু নিজেই শুধুমাত্র অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার এক হিমালয় ছিলেন না, গড়তে চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি। আগামী প্রজন্মকে দিতে চেয়েছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। তাঁর স্বপ্নের বীজ বপন হলেও, সেই স্বপ্নের গাছটিকে আর ডালপালা মেলতে দেওয়া হয়নি। সমূলে উৎপাটিত করতে না পারলেও গাছটির শাখা-প্রশাখা ছেঁটে, অনেকটাই আঁটসাট করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। ১৫ আগষ্টের মর্মান্তিক সে রাতের পর দেশের অনেক কিছুই পাল্টে গিয়েছিল। যেমনটি হওয়ার কথা ছিল হয়নি তেমনটি। অবৈধভাবে দখলকৃত ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার জন্যই হয়তো বারবার সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বাদ দিতে হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক অনুচ্ছেদগুলি, প্রয়োজন হয়েছিল রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রধর্ম দেওয়ার। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ পালিত হয়েছে, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আনন্দে মেতেছে সমগ্র দেশ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে আমাদের রূপসী বাংলা। তবে অসাম্প্রদায়িকতার দিক থেকে আমাদের অবস্থান এখন কেমন কিংবা জাতির পিতার স্বপ্নের ঠিক কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তা আজও হয়তো দীর্ঘ বিতর্কের বিষয়।

সুখের কথা, পঞ্চদশ সংশোধনীর (২০১১) মধ্য দিয়ে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়েছে। একইসাথে, এই সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অনেক বছর বাদে হলেও বঙ্গবন্ধুর জীবন, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, অসাম্প্রদায়িক দর্শন, সমাজচিন্তা এসব সম্পর্কে বাঙালি জানতে পারছে তাঁর জবানীতেই— কখনও অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে, কখনও কারাগারের রোজনামচায় আবার কখনওবা আমার দেখা নয়াচীন গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। তাঁকে নিয়ে যতই লেখালেখি ও গবেষণা হচ্ছে ততই তার অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার দিকগুলো উদ্ভাসিত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও লেখক ড. আতিউর রহমানকে। এছাড়াও দেশ ও দেশের বাইরে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা হচ্ছে। তাই বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতাসহ সামগ্রিক আদর্শ ধীরে ধীরে আলো প্রকাশ করবে আর সেই আলোতে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দীপ্তি ছড়াবে সকলের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ— এই আশাবাদটুকু আজ ব্যক্ত করাই যায়!

0504 হরিপদ শীল অব্যক্ত Poem 2nd 1
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬-১৭

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp