fbpx

নভেম্বর ২, ২০২৪

Taare Zameen Par: ভ্রমণ ভারতে

প্রথম পর্ব

(১)  

মুভির নাম “Stardust”। রূপকথার গল্প। গল্প শুরু ছোট একটা গ্রামকে ঘিরে। গ্রামটির চারদিকে পাথরের দেয়াল। দেয়ালের বাইরে আছে এক জাদুর রাজ্য, নাম স্টর্মহোল্ড। সেই জাদুর রাজ্যে যাওয়া নিষিদ্ধ। একদিকে দেয়ালের একটা অংশ ভাঙ্গা, জাদুর রাজ্যে যাওয়ার একমাত্র পথ। সেখানে আছে  একজন প্রহরী।    

দেয়াল ঘেরা জীবন বদ্ধ জীবন। ট্রিস্টান সে দেয়াল পার হতে চায়। যেতে চায় জাদুর রাজ্যে। সেই রাজ্য আকাশ থেকে একটা তারা নেমে এসেছে মাটিতে। ভালবাসার মানুষ ভিক্টোরিয়াকে পেতে হলে সে তারা এনে দিতে হবে তার হাতে। কিন্তু প্রহরীকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। সুযোগ বুঝে একদিন সেই দুঃসাধ্য সাধন করে ফেলে। চলে যায় জাদুর রাজ্যে, তারার খোঁজে। অবশেষে দেখা পায় সে তারার। কিন্তু তারা দেখার পর ট্রিস্টান পড়ে যায় তারার প্রেমে।     

আমাদের ক্লাসের মোটামুটি সবাই তারার প্রেমে পড়ে আছে। বেলাল স্যার একবার ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছেন, সেটা নিয়ে অনেকবার গল্প করলেন। ইন্ডিয়াতে দেখার আছে অনেক কিছুই, প্রত্যেকবারই করলেন কেবল তারার গল্প। আকাশের তারা নয়। সে তারা মাটির। রূপকথার রাজ্যে সে তারা নেমে এসেছে মাটিতে। সেখানে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘরগুলো যখন রাতের আলো জ্বেলে দেয়, মনে হয় সমস্ত পাহাড় জুড়ে মিটমিট করে জ্বলছে হাজার হাজার তারা। পাহাড়ের নিচ থেকে চূড়া পর্যন্ত। আস্তে আস্তে মিশে গেছে আকাশের তারার সাথে।

এই গল্প যখন স্যার করছিলেন তখন আমাদের চতুর্থ বর্ষের Excursion Tour নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সবাই দেশের বাইরে ট্যুর দিতে চাই। পরিসংখ্যান ডিপার্টমেন্ট থেকে দেশের বাইরে যাওয়া এক মহা দুঃসাধ্য কাজ। তবুও আমরা যেতে চাই, দেখতে চাই তারার রাজ্য, যে রাজ্যে “Taare Zameen Par”।

(২)

সন্ধ্যা ৭টা, নভেম্বর মাসের ৬ তারিখ, সাল ২০১৮। শীত কেবল পড়তে শুরু করছে। দুজন শিক্ষকসহ মোট ৪০ জন বাসে উঠলাম। অসম্ভব এক ভাল লাগা আজ করছে। অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে অবশেষেে রওনা দিচ্ছি। চেয়ারম্যান ড. লুৎফর রহমান স্যার আমাদের বিদায় জানাতে এসেছেন। এই ট্যুর আয়োজনের পিছনে স্যারের অবদান অসামান্য। শুধু ট্যুর না আমাদের ব্যাচ আরও  অনেক কারণে স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ।

বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছাতে সকাল হয়ে গেল। আমার মনে বদ্ধমূল ধারণা বর্ডার পার হওয়ার সাথে সাথে ঐ পারের দুনিয়াটা সম্পূর্ণ পাল্টে যাবে। দেখবো এক অন্য রকম জগত।

 কিন্তু না পার হয়ে দেখি একই রকম সব। মনটা একটু খারাপ হলো। মোবাইলে এখনো দেশের নেট কাজ করছে। মোবাইলের উচিৎ ছিল বর্ডার পার হবার সাথে সাথে নেট অফ করে দেয়া। বিদেশে গিয়েও দেশের নেট পাওয়া গেলে তো বিদেশ বিদেশ ভাব আসে না।    

 আমার থেকে আরেক জনের মন খারাপ মনে হলো। ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

 গরগর করে বলতে শুরু করলো, ”ড্রেস নিয়ে আসছি ১১টা। আমাদের থাকতে হবে ১২ দিন। কি করা যায় বলতো?”
বললাম, “বুঝলাম না। ড্রেস নিয়ে কী হয়েছে?”

-আরে ড্রেস কম নিয়ে আসছি। এক ড্রেস পরে কি দুই জায়গায় ছবি তোলা যায়? মানুষজন কী বলবে? আর জায়গার সাথে মিলিয়ে ড্রেস আনতে চেয়েছিলাম তাও হলো না।

শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম, ইন্ডিয়ায় কত কি দেখবো সেটা ভাবা বাদ দিয়ে সে ড্রেস নিয়ে পরে আছে। যুক্তি দেখিয়ে বললাম, ”কে কবে কোন ড্রেস পরেছে সেটা দেখার জন্য কে খেয়াল করে বসে আছে?”  

চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম অন্যায় করে ফেলেছি। এই মেয়েকে যুক্তি দেখানো ঠিক হয়নি। রেগে গেছে সে। ধমকের সুরে বলল, ”কী বলিস তুই? মানুষ দেখবে নাহ! তোর কোন ধারণা আছে?”   

সত্যিই কোন ধারণা নেই যে মানুষ এত কিছু খেয়াল করে। আর যুক্তি দেখানোর সাহস হলো না। বললাম, “কী করবি তাইলে?”  

-কী আর করবো? এইভাবে ট্যুরে এসে মজা আছে? মনটাই খারাপ হয়ে গেল।


আরো কত জনের মন খারাপ আছে কে জানে? আমরা মন খারাপ নিয়ে বিকাল তিনটার দিকে কলকাতায় পৌছলাম। হোটেলে উঠে খাওয়া দাওয়া সেরেই সবাই ঘুরতে গেল নিউমার্কেটে। সবার আগে শপিং। এত সাধনা করে ট্যুরে এসে কোন কিছু না ঘুরেই শুরুতেই শপিং। ট্যুরের মজা বুঝলাম। আশা করি ড্রেসওয়ালীর মন এখন ভালো হয়েছে।

ইন্ডিয়া ঘুরে এসে একটা চিন্তা মাথায় এসেছে। ঢাকায়ও নিউমার্কেট, কলকাতায়ও নিউমার্কেট – তাহলে কোন নিউমার্কেটটা আসল নিউমার্কেট? কিন্তু দিল্লি ঘুরে এসে জানলাম নিউমার্কেট আরো আছে। শুধু তাই না, ঢাকার মত প্রত্যেক নিউমার্কেটের পাশে একটা চাঁদনী-চক মার্কেটও আছে। এই সব নামকরণের অভিনব পদ্ধতি কাদের মাথা থেকে এসেছিল?     

এই কলকাতাতে শপিং করার জন্য ট্যুরের শেষ দিনটা পুরোপুরি বরাদ্দ। তারপরও সবার মনোভাব, না কিনি দেখে তো রাখি! দেখলাম, মার্কেট বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত দেখলাম। কিছুই কিনলাম না। হোটেলে এসে দেখি ওমা! প্রভাতী আপু ট্যুরের প্রভাতেই ছোট খাটো বস্তার সাইজের এক ব্যাগ শপিং করে ফেলেছে। এবং এই বস্তা সে পুরো ১২ দিনের ট্যুর জুড়ে সারা ভারত ঘুরিয়ে এনেছে।  

(৩)

পরদিন সকালই রওনা দিলাম আগ্রার উদ্দেশ্যে। ট্রেনে প্রায় ২৪ ঘণ্টার পথ। প্রথম দিকে স্টেশন ঘন ঘন। ট্রেন থেমে আবার চলতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর শুনি আমাদের এক ফ্রেন্ড রুমি নেই। স্টেশনে নেমেছিল, কিন্তু উঠতে পারেনি। পুরো ট্রেন খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যাচ্ছে না। সবার গায়ে জ্বর উঠে গেল। যদি না উঠতে পারলে আমাদের ট্যুর মাটি।

নামার সময় খালি হাতেই নেমেছিল। যোগাযোগ করার ব্যবস্থা নেই। শাহরুখ খান নায়িকাদের হাত ধরে ট্রেনে তোলেন। কিন্তু তিনি মনে হয় এই কাজ কলকাতার লাইনে কখনো করেননি। আমাদের বন্ধু আকাশ তাই শাহরুখ খানের ভূমিকায় রুমিকে টেনে তুলতে গিয়েছিল। কিন্তু পারে নি। তাই সে নিজে নেমে উঠানোর চেষ্টা করে। তাও পারেনি। ট্রেনের গতি বেড়েই চলেছে। রুমি কে তোলার আর কোনো সম্ভাবনা না দেখে সে লাফ দিয়ে উঠে যায় ট্রেনে। কিন্তু না শাহরুখ খান ট্রেনের ভিতরেই ছিল। সে চেন টানে। আবার ট্রেন থামে। রুমিকে উঠানো হয়। আকাশ ছেলেটা অনেক খানি ঝুঁকি নিয়ে রুমিকে তুলতে গিয়েছিল। তারপরও তার কথা শুনতে হয়েছিল কেন সে নিজে ট্রেনে উঠে এলো?

এরশাদ স্যার তো ঘটনা শুনেই আগুন। কার কাছে অনুমতি নিয়ে ট্রেন থেকে নেমেছে? তিনি আর ট্যুরে যাবেন না। ট্যুর এখানেই সমাপ্ত। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে স্যার বললেন এরপর তার অনুমতি ছাড়া যদি কেউ কোথাও যায় ট্যুর সেখানেই সমাপ্ত। তিনি তখন আর কারো কথা শুনবেন না। স্যারের কথায় কাজ হয়েছিল। সারা ট্যুরে তাই এইরকম আর কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমাদের।

প্রত্যেক ট্যুরেই কিছু ছোট-খাটো বালা-মসিবত থাকে। আমাদের সেই মসিবত কেটে গিয়েছে। রাতের দিকে শীত পড়ে ট্রেনে। দেশ থেকে কম্বল নিয়ে যেতে হয়েছে সাথে করে। ট্রেনে ঘুমানোর প্রথম রাত। ঘুম ভালই হয়েছে। এখন আবার ঘন ঘন স্টেশন। লোক নামছে, উঠছে। তবে মনে হয় উঠেছেই বেশী। কম্বল মুড়ি থেকে মাথাটা বের করে শুয়ে আছি।  

মাঝ বয়সী এক ভদ্র মহিলা ভদ্র ভাষায় এসে বলল,”বাবা, তুম তো একলা হো, হামেন ইয়ে সিট ছোড় দো।  হামারি সাথ এক লারকা হে।”

কী যন্ত্রণা!  সীট ছেড়ে কোথায় যাব? মহিলাকে কিছু বলতে গিয়ে খেয়াল হলো, হিন্দি টুকটাক বুঝতে পারলেও বলতে তো পারিনা মোটেই। কোথাও শিখছিলাম বাংলা শব্দের সাথে ‘হ’ অনুসর্গ যোগ করলে হিন্দি হয়। বুদ্ধি কাজে লাগালাম।

হাসি মুখে বললাম, “হামারা সব লোকই একলা হে।”  

 ভবের দুনিয়াতে তো আমরা সবাই একা, তাই বললাম আরকি। পাশের সীট থেকে নবনীতা আপু আমার হিন্দি শুনে হেসে ফেলছে। তার হাসি কোনমতেই থামছে না। পুরো ট্যুর জুড়ে এই লাইনটা সে সহ বাকিদের কাছে থেকে অন্তত পঞ্চাশবার শুনতে হয়েছে, “হামারা সব লোকই একলা হে।”   

এরপর আর হিন্দি বলার সাহস পাইনি। যারা হিন্দি পারে তাদের থেকে আগে তালিম নিয়ে নিতে হতো  দোকানে কিভাবে কেনাকাটা করবো। “ভাইসাব, কিতনে” এই একটি মাত্র হিন্দি শব্দ সম্বল করে বন্ধু নঈমুল জয়পুর, দিল্লি, মানালি সব মার্কেট থেকেই শপিং করেছে, অন্যদেরও করে দিয়েছে।

 মহিলাকে সীট ছেড়ে দিলাম। আগ্রা কাছাকাছিই। ট্রেন যমুনা সেতু পার হবে। সেতুর উপর থেকেই তাজমহল দেখা যাবে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তাজমলের সৌন্দর্য দেখে ‘তাজমহল’ নামে একটা গল্প লেখেন, কিন্তু তার কাছে এই ট্রেন থেকে তাজমহল দেখে চুনকাম করা সাদা মসজিদ মনে হয়েছে।

 কিন্তু আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমার কাছে ভালই লেগেছে। হয়ত ভিন্ন এক দেশের হাজার মাইল দূরের তাজমহলের এত কাছাকাছি এসে পড়েছি, তাই এতটা ভাল লাগছে। যমুনার পানি প্রায় শুকিয়ে এসেছে। দেখে  মনে হচ্ছে মরে গেছে নদী। এই নদী কি সবসময়ই এরকম মরা ছিল নাকি তেজ ছিল এক কালে? একদম নদীর কিনারায় হয়েও তাজমহল এত দিন টিকে রইলো কিভাবে? এ নদী কি কখনো ভাঙ্গে নি?  

(৪)

উত্তর প্রদেশের রাজধানী আগ্রা। আগ্রা স্টেশনে নামলাম হয়ত দশটা বাজে। স্টেশন থেকে তাজমহল খুব বেশি দূরে নয়। এসি বাস নিতে এসেছে আমাদের। দিনে এখনও প্রচণ্ড  গরম। তাজমহলে আজকে আর ঢুকার সুযোগ নেই। তাজমহলে ঢুকতে খুব সকাল থেকে লাইন ধরতে হয়। তাই আজকের দিনের প্ল্যান আগ্রা ফোর্ট ঘুরাঘুরি।  

ফোর্ট থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরেই তাজমহল। ফোর্টের ভিতর থেকেই দেখা যায়। শাজাহান বন্দী জীবনের শেষ কটা দিন এখান থেকেই তাজমহল দেখে কাটিয়েছেন। এটাই ছিল তখনকার রাজধানী।

এই ফোর্টেরও অনেক স্থাপনা তার তৈরি। শাহজাহানের ছিল সাদা প্রীতি। ফোর্টের লাল দেয়ালের ভিতরেও আছে তার কিছু সাদা বিল্ডিং।  

এই ফোর্টের ইতিহাস হাজার বছরের। এটাই সবচেয়ে পুরনো দুর্গ। এর আছে দীর্ঘ ইতিহাস। ইতিহাসে খুঁজে যেটা পাওয়া যায়না সেটা বলি। স্থাপনাগুলো তৈরিতে আলো বাতাসের ব্যবহার করা হয়েছে চমৎকারভাবে, অবাক হতে না চাইলেও হতে হয়। আমি আভিভূত হয়েছি সমাবেশ চত্বর দেখে। নাম “দেওয়ান -ই -আম” বা “Audience Hall”।

 Audience Hall এর তিন দিকে খোলা পেছনের দিকের দেয়াল ছাড়া, প্রকাণ্ড  চত্বরের । সেটা এমনভাবে বানানো যে সেখান থেকে খালি গলায় কথা বললেই পুরো চত্বর জুড়ে শোনা যায়।

গাইড পরীক্ষা করে দেখালো। সে ভিতরে দাড়িয়ে হাতে তুড়ি দিচ্ছে আর আমরা ধীরে ধীরে পেছাচ্ছি। চত্বরের শেষ মাথায় চলে এসেছি। এতো দূরে তো শুনতে পাওয়ার কথা না। এটা করলো কিভাবে? তাদের স্থাপত্যে আলো বাতাসের পাশাপাশি শব্দের ধর্মকেও কাজে লাগিয়েছে।

শুধু ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকায় আরোও অনেক কিছুই দেখা হয়নি। একজন অপরিচিত মেয়েও দেখি আমাদের দলের মধ্যে ঢুকে ছবি তুলতে শুরু করে দিয়েছে। ইন্ডিয়ানদের মতই দেখতে। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে বাকিদের বেশ পরিচিত।  

স্পষ্ট বাংলা আর বাচনভঙ্গি শুনে বুঝলাম বাংলাদেশী। আমারও পরিচিত। একে আমরা সাথে করেই নিয়ে এসেছি। বোরকা সোনিয়া। আমাদের সাথেই চার বছর পড়ছে, কিন্তু বোরকা ছাড়া দেখিনি কখনো। হঠাৎ এই পরিবর্তনে চিনে উঠতে পারিনি। কোন ছেলেই চিনতে পারবে না।

বন্ধু আব্দুলল্লাহ আল মামুনের ইন্ডিয়া দেখার পাশাপাশি আরেকটা সুপ্ত টার্গেট ছিল সোনিয়াকে অন্তত একবার বোরকা ছাড়া দেখা। তার সে ইচ্ছা আজ পূরণ হতে চলেছে। আমাদের ‘আব্দুলল্লাহ আল মামুন’ দুজন। আলাদা করে চেনার জন্য একজনকে ডাকা হয় চিকনা মামুন, আরেকজনকে মোটা মামুন। চিকনা মামুনকে ‘চিকনা’ বলে ডাকার কারণে কোন প্রতিবাদ না করলেও মোটা মামুনকে ‘মোটা’ বললে ব্যাপক কষ্ট পায়। তাই ছেলেটা জিম করে চিকন হয়ে গেছে। কিন্তু নাম এখনো ঘোচাতে পারেনি, এখনো মোটা মামুনই ডাকে সবাই।

প্রশ্ন- বোরকা সোনিয়ার পিছনে ঘোরা কোন মামুনের কাজ হতে পারে?

ভাঙ্গা তাজমহল

(৫)

সারাদিন আগ্রা ফোর্ট ঘুরাঘুরি শেষে সবাই বেশ ক্লান্ত। বিশ্রাম দরকার। আমাদের বিশ্রাম মানে হচ্ছে শপিং। সারাদিন কিছু খাওয়া দাওয়া হয়নি। খাওয়া দাওয়া সেরেই আমাদের বিশ্রাম নিতে চলে গেলাম সদর বাজার। যত জায়গায় গিয়েছি সবখানেই মার্কেটের খোঁজ নিয়েছি সবার আগে।   

খাওয়া দাওয়া শেষ হতে সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছিল। অটো ভাড়া করে দলে দলে রওনা দিলাম সদর বাজারে। অটোওয়ালাকে যদি বলেন যা যা দেখার জিনিস আছে ঘুরে দেখাবেন তাহলে তারা প্রথমেই নিয়ে যাবে মিনি তাজমহল দেখাতে।

মিনি তাজের আকারে অর্ধেক মানুষ সমান হবে। পরে জানলাম এটা একটা দোকান। দোকানদার তাজমলের বিভিন্ন রুপ বর্ণনা করতে লাগলেন। চাঁদের আলোয়ে দেখতে কেমন, সূর্য থাকলে কেমন, কুয়াশা থাকলে কেমন বিভিন্ন কালারের লাইট জ্বালিয়ে তা দেখালেন।    

মিনি তাজমহলের পর এলো মাইক্রো তাজমহল দেখাতে। এটা হাতে নিয়ে দেখা যায়। দোকান ঘুরিয়ে বিভিন্ন রকম তাজ দেখাতে লাগলেন। দাম শুনে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলো না। এই গ্রুপের কেউ না কিনলেও অন্যরা অনেকেই কিনেছে।

হুমায়ূন আহমেদের এর ভ্রমন কাহিনীতে পড়েছিলাম, “তাজমহল দর্শনার্থীরা সরাসারি তাজ দেখতে পারে না। তাদের কে মিনি তাজ বলে এক বস্তু দেখতে হয়। সেখানকার লোকজন সবাই কথাশিল্পী। তাদের কথার জালে মুগ্ধ হয়ে মিনি তাজ কিনতে হয়। সেই মিনি তাজ আজ পর্যন্ত কেউ অক্ষত অবস্থায় বাংলাদেশে আনতে পারেন নি। বর্ডার পার হওয়ার আগেই অবধারিতভাবে সেই তাজ ভেঙে কয়েক টুকরো হবেই।” আমাদের কেউও অক্ষত রাখতে পারে নি। কেউ কি তাজমহল না ভাঙ্গার রেকর্ড আজ পর্যন্ত ভাঙতে পেরেছে?

আমি একজনের নাম জানতাম যিনি আসল তাজমহল বিক্রি করতেন। আসল মানে একদম আসল। শাহজাহানের বানানো তাজমহল। আসল তাজমহল তো একটাই? হ্যাঁ, সেই একটাকেই তিনি তিন বার বিক্রি করছেন। তার নাম নটবরলাল। তিনি ইন্ডিয়ার আরো অনেক কিছু বিক্রি করতেন যেমন সংসদভবন, লালকেল্লা, রাষ্ট্রপতিভবন ইত্যাদি। তিনি কত বড় কথা শিল্পী ছিলেন যে পর্যাটকের কাছে আসল তাজমহলই বিক্রি করে দিয়েছেন?

অটোওয়ালা কাছে ঘুরে দেখতে চেয়ে যে বোকামী করেছি সেটা টের পেতে শুরু করলাম। তিনি আমাদের ঘুরে দেখাচ্ছেন জুতা স্যান্ডেল, কাপড়-চোপড়, ব্যাগের দোকান। বিরক্ত হয়ে বললাম, “এইসব দোকান ছাড়া কি আর কিছু দেখার নেই?”

অটোওয়ালা বললেন, “আছে।“

তারপর যেখানে নিয়ে গেলেন সেটাও দোকান, ‘Petha’ এর দোকান। ‘Petha’ এর উচ্চারণটা ঠিক কি হবে জানিনা। আমার মনে হলো ‘পিঠা’ থেকে ‘Petha’ শব্দ এসেছে।  চালকুমড়া দিয়ে আমাদের দেশে একধরণের মোরব্বা করা হয়। ‘Petha’ দেখতে ওই রকমই। 

প্রথমে সবাইকে ফ্রি খাওয়ালো। ব্যবহার ভাল। খেয়ে কিনতে না চাইলেও সমস্যা নেই। ইন্ডিয়া এসেছেন খান। খেয়ে দু একজনের কাছে ভাল লাগলো, কিনতে রাজি হলো। পরে দেখাদেখি অনেকেই কিনলো। কেনার পরই স্বাদ পাল্টে গেল। ‘Petha’ দেখতে নানান কালারের, নানান ডিজাইনের। এক এক জন এক এক রকম কিনেছে। সবই অখাদ্য।  

শাহজাহান নাকি তাজমহল বানানোর সময় শ্রমিকদের এই ‘Petha’ খেতে দিতেন। এই অখাদ্য খেয়ে তাজমহল বানানো সম্ভব ছিল না। শাহজাহানের খানা খাদ্য নিয়ে একখানা পুস্তক আছে ‘নুশখা-ই-শাজাহানি’ সেখানে অনেক মুঘল আমলের খাবার-দাবার নাম পাওয়া যায়, সেখানে ‘Petha’ এর কোন উল্লেখ নেই ।

হোটেলে ফিরে দেখি হুলস্থূল কান্ড। সবাই করে কি যেন ভাগ বাঁটওয়ারা খাচ্ছে। কাঞ্চন স্যার সবাইকে ‘Petha’ খাওয়াচ্ছেন। বেশ মজা করেই খাচ্ছে। প্যাকেট শেষের পথে। কোন রকমে পেলাম আমরা। মুখে দেয়ার সাথে সাথে সবার হাসি শুরু হয়ে গেল।  

যতগুলো ‘Petha’ খেয়েছি তারমধ্যে এটা সবচেয়ে অখাদ্য। সবাই প্লান করে আমাদের খাইয়েছে। এখন আমরা আবার আশায় থাকলাম, নতুন কোন গ্রুপ আসলে তাদের খাওয়াতে হবে। কিসের প্যাকেট শেষ? স্যারের ব্যাগ ভর্তি সবুজ, গোলাপী, সাদা বিভিন্ন রঙের ‘Petha’। সবই মিলে খেলেও এইগুলো শেষ হবে না। 


নতুন গ্রুপ আসলে তাদেরও খাওয়ানো হল। আরেক দফা হাসাহাসি। কিন্তু তাদের শপিং দেখে হাসি থেমে গেছে। যারা দেরি করে এসছে সবার হাতে শাড়ির ব্যাগ। সদর বাজার খালি করে এসেছে কিনা কে জানে। একে একে বের করলো কে কী কিনেছে। একে একে বের হতে লাগলো বাহারি শাড়ি থরে ও বিথরে।

আমার জানার ইচ্ছা প্রভাতী আপু কী কী  কিনলো। একটু হতাশ হলাম। পরদিন দেখি তার ব্যাগ তিনটি। ব্যাগ আর বাড়েনি। কি কিনলো তাইলে একটা ব্যাগ বাড়লো না!

(৬)


এত শপিং দেখতে ভাল লাগলো না। রাতের খাবার হতে দেরি হবে। তাই একটু হাটতে বের হলাম তাজমহলের রোডে। রোডে নেমেই মনটা ভরে গেল। প্রশস্ত রাস্তা। চমৎকার পরিষ্কার। চৌকোনা লম্বা বাক্সের ভেতর থেকে মিটিমিটি সোনালী আলো বের হচ্ছে। আধো আলো আধো ছায়া আবহ। মনে হলো শুধু এই রোডটা দেখার জন্য আরেকবার আগ্রা আসা যেতে পারে। ছবি তোলার বৃথা চেষ্টা করলাম। এই নিস্তব্ধ চারিপাশ ও হালকা শীতল আবহাওয়ার সাথে মনের অনুভূতি ক্যামেরায় ধরা সম্ভব না।

হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া শেষে একটু টিভি দেখতে বসলাম। রব্বানি রুমে ঢুকেই বলল, “টিভি বন্ধ কর।“

জিজ্ঞেস করলাম, “কেন, কী  হয়েছে?”


বলল, “সারাদিন ক্লান্ত এখন নেব বিশ্রাম। আর তুই রুমে ঢুকেই সব জায়গায় টিভি ছেড়ে দিস কেন? টিভিতে কি কিছু হয় যে সব জায়গায় টিভি ছাড়তে হবে?”

আমি বললাম, “না দেখলে বুঝবো কিভাবে কিছু হয় কিনা?”

রাব্বানি বলল, “দেখতে হবে না। তুই টিভি বন্ধ কর।”

খাওয়া দাওয়া শেষে পায়ের উপর পা তুলে টিভি দেখা একটা আয়েশ। রাব্বানি এর বুঝবে কি? রাব্বানির চিন্তা রুম নিয়ে। ওর মেজাজ খারাপ। রুম পড়েছে নিচ তলার কর্নারে। রাব্বানি বুঝে গেছে রুম নিয়ে একটা পলিটিক্স চলে। মাহাদী, শায়েখ হচ্ছে নাটের গুরু। ওরা সব সময় ভাল রুম নেয়, আর আমাদের দেয় নরমাল রুমগুলো।

এই সব আমার নিয়ে মাথা ব্যথা নেই, রুমের টিভি ঠিকঠাক চললেই হলো। আমাদের আরেক জন রুমমেট আছে শাফকাত। তার মাথা ব্যথা আরো কম, রুমে শুধু একটা বেড থাকলেই ওর চলে। রুমে ঢোকার পর তার ঘুমাতে লাগে সর্বোচ্চ দের মিনিট। ৩০ সেকেন্ড ঘুমিয়ে পড়ার রেকর্ডও ওর আছে। 

পরদিন দিনের আলোতে সে রাস্তা অতি সাধারণ রাস্তা হয়ে গেলো। লোকজন গিজগিজ করতে লাগলো। সকাল আটটার দিকে তাজমহলে ঢুকা শুরু। কুয়াশা আছে এখনো। ছেলেরা বেশির ভাগই পাঞ্জাবী পরেছে। মেয়েদেরও প্লান ছিল তাজমহলকে ঘিরে। সবচেয়ে পছন্দের পোশাকটা রেখেছিল তাজমহলের জন্য।

তাজমহলের সৌন্দর্য বর্ণনা করার কিছু নেই। সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে সৌন্দর্যের মুখোমুখি দাড়াতে হয়। তবে আমি তাজমহল যতটা বড় ভেবেছি তার থেকেও বড়। কুয়াশা ভেদ করে দেখতে হয়েছে প্রথম দর্শন। কুয়াশা না থাকলে এতটা ভাল লাগত কি না জানিনা। 

ছবি তোলা কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেছে। সবাইকেই চ্যাম্পিয়ন ঘোষনা করা যায়। এরশাদ স্যার কম্পিটিশনের বাঁধা হয়ে দাড়ালেন। এখন সবাইকে গ্রুপ ছবি তুলতে হবে। “এই সবাইকে ডাক দাও, আগে গ্রুপ ছবি তুলতে হবে।“

যে ডাকতে যায় সেও হারিয়ে যায়। তাকে ডাকতে আবার আরেকজন যেতে হয়। তারপরও স্যার গ্রুপ ছবি তুলতে পেরেছিলেন। সেই ছবি স্যারের রুমে টাঙানো আছে।   

আচ্ছা একটা প্রশ্ন, তাজমহল কে বানিয়েছে? না এটা প্রশ্ন না, প্রশ্ন হচ্ছে, তাজমহলের স্থাপতির নাম কি?

মোঃ আজমির হোসেন

রোল- শহ-৩৪
সেশন-২০১৪-১৫
ড। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল