fbpx

তরঙ্গিণী

বয়স কেবল দেড় বা দুই বছর হইবে। ইহা আমার নয়, আমার ফেইসবুক আইডির বয়স। আমার বয়স? সে আর কত হবে, কুড়ির আশে পাশে,,,। সংবিধান মতে, আমি কেবল শিশু জীবন পার করিয়াছি। এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের শিশু জীবনে অর্জিত জ্ঞান হইতে ফেইসবুক সম্বন্ধে যতটুকু আন্দাজ করিতে পারিলাম তাহা হইলো : ফেইসবুক এমন এক যন্ত্র, যে কিনা জীবনের মূল্যবান সময়ের দীর্ঘ ফিতাকে প্রতিনয়ত কাটিয়া কাটিয়া খাটো করিয়া ফেলিতেছে। তবু ইহার এক বিশেষ মূল্য আছে। ইহা এক সাদা কাঠগোলাপের উপর বসিয়া দুলিতে থাকা কোনো প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোকে কাজে লাগাইয়া আমার হৃদয়ে ভিন্ন রকমের টর্নেডোর আবির্ভাব ঘটাইয়াছে। এ যেন এক ভিন্ন রকম বাটার ফ্লাই ইফেক্ট।

ইহা এক অসমাপ্ত ইতিহাস, কারন ইহা এখনো পূর্নতা পায়নি। অপূর্নতাকে যাঁহারা তুচ্ছ বলিয়া অবহেলা করিবেন না তাঁহারা ইহাতে ঐ বাণীটির প্রমান খুঁজিয়া পাইবেন। ” অপূর্নতায়ও সুখ পাওয়া যায়”।

কলেজে যতগুলো পরীক্ষায় পাশ করিবার সব আমি চুকাইয়াছি। ছেলেবেলায় যখন মায়ের হাত ধরিয়া পন্ডিতমশাইয়ের বাড়িতে যাইতাম, তখন তিনি আমাকে আমার উচ্চতা দেখিয়া এরূপ কৌশলে বিদ্রুপ করিতেন যে, ” আর কত কাল মাকে মা বলিয়া ডাকিতে হইবে, তোমার? “।  তখন বুঝিতে পারিনি। ভাবিতাম, আমি মাকে অনেক সম্মান করি তাই প্রশংসা করিতেছে আমাকে নিয়া। আর লজ্জার মায়ের পিছনে গিয়া দাঁড়াইতাম। কিন্তু বয়স হইয়া একথা ভাবিয়াছি, যদি নসিবে থাকে তবে তাঁহার পাশে কোনো একসময় নামাজের জামাতে দাঁড়াইয়া সৎ উত্তর দিয়া দিবো; কিছু বলিতে হইবে না, নিশ্চুপ হইয়া তাঁহার কাঁধের সমান্তরালে আমার কাঁধ রাখিয়া কাতার সোজা করিলেই হইবে। নিরবতা তো অনেক কিছু বলিয়া দেয়।

আমার পিতা গরিব ঘরের সন্তান। কিন্তু তিনি বোধয় ছেলেবেলায় টাইম ট্রাভেল করিয়া কিংবা স্বপ্নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে আসিয়া কোনো ভাবে বিল গেটস এর সহিত  সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। বিল গেটস তাঁহাকে শুনাইয়া ছিলো: If you are born poor it’s not your mistake but if you die poor it’s your mistake. আমার পিতা তো গরিব ছিলো,  সেকালে গরিবের আবার পড়ালেখা? পড়ালেখা তো এক রকমের বিলাসিতা, যাহা ধনীদের জন্য তৈয়ার করা হইয়াছে। তাহলে পিতা কি করিয়া ওমন ইংরেজি বুঝিয়া ছিলো? এরকম হইতে পারে: সে হয়তো স্বপ্নের মাধ্যমেই ভবিষ্যতে আসিয়াছিলেন; আর স্বপ্ন তো সেভাবেই তৈরি হয়, আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে বুঝিতে পারিবে। যাইহোক, বিল গেটস এর বাণী থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বোধয় সে কোটিপতি  হইবার জন্য প্রানপন চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু নসিবের কারনে হয়তো প্রতিবার ব্যবসা করিতে আসিয়া প্রতিবারই  অকৃতকার্য হইয়া হাঁফ ছাড়েন। হয়তোবা আদু ভাইয়ের মতো পন করিয়াছে পাশ আমাকে করিতেই হইবে। তবে তাঁহার বুবু মানে আমার ফুফু সবসময়ই আমাদের পাশে আসিয়া দাঁড়ায়। 

তাই এই ক্ষুদ্র জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছি মায়ের আদরে। মা ধার্মিক এবং ভদ্র ঘরের মেয়ে। তাঁহার আচরনের মাধ্যমে ইহা আজ অবধি বজায় রাখিয়াছে আর আমাকেও একথা কভু ভুলিতে দেন নি। ছোট বেলা থেকেই আদর আর শাসন দিয়ে নম্র হিসেবে বড় করিয়াছে, সাথে ধার্মিকও। তাই বাহিরের জগৎটা আমার কাছে একটু বেশিই অচেনা রইয়া গেল। আজ আমাকে দেখিলে মনে হইবে, অপরিচিতা গল্পের অনুপম বাস্তবে রূপ ধরিয়া ধরায় আসিয়াছে।

আমাদের ঘরের অন্যতম প্রধান অবিভাবক আমার ছোট ভাই। আমার থেকে নূন্যতম বছর আটেক ছোট।  আমাদের পরিবারটাকে সে যেন একটা বোতল বানাইয়া, নিজে ছিপি হইয়া বসিয়া আছে। ওর অনুমতি ব্যতিত বোতলের এক ফোঁটা পানিও এদিক সেদিক হইবার সুযোগ নাই। এ কারনে কোনো কিছুর জন্যই আমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতে হয়না।

পরিচিত,অপরিচিত যাদের সাথেই আমার দু একটা আলাপ হইয়াছে সকলেই স্বীকার করিবেন, আমি সৎছেলে। কোনো রমণীর সহিত দু চার পাও হাঁটি নি। ভালোমানুষ যেই পথে চলে সেই পথে ভিড় কম, তাই নিতান্তই আমি ভালোমানুষ। আমি মায়ের বাধ্য ছেলে, আমার রাজ্যে তাঁহার আইনই চলে। আইন অমান্য করার সাধ্য আমার নাই। আমি উক্ত রাজ্যে একজন আদর্শ নাগরীক, যদি কোনো বীরাঙ্গনা আমার রাজ্যে প্রবেশ করে তবে এই সুলক্ষনটি স্মরন রাখিবেন। 

বড় বড় কলেজ, ভার্সিটির সুন্দর সুন্দর মেয়েদের আইডি হইতে বন্ধু হবার অনুরোধ আসিয়াছিলো। কিন্তু ছোট ভাই, যে আমার ফেইসবুক আইডির প্রধান  দারওয়ান। মেয়ে বন্ধু সম্বন্ধে তাহার বিশেষ মত রইয়াছে, বাকপটু মেয়ে তাহার পছন্দ নহে। যে মেয়ে তাঁহার ভাইকে কেবল লেখা পড়ায় সাহায্য করিবে সে মেয়েকে বন্ধু বানালে তাঁহার আপত্তি নাই। ওর মতে ফোন কেবল পড়াশুনার জন্য, সময় নষ্টের জন্য নহে। তাই যেসব মেয়ে বাকপটু তাহাদিককে বন্ধু বানানোর অনুমতি দিতে সে নাকোজ। নাকোজ মানে, সে মাকে আমার নামে অন্য কিছু বলিয়া মেগাবাইট বা গিগাবাইট ক্রয় করিবার সকল পথ বন্ধ করিয়া দিবে ।

আমার বন্ধু জুনায়েত, আমাদের কলেজেই পড়ে। করোনার কারনে ওরা নাকি অনলাইনে প্রাইভেট পড়িবে। এই খবর দিয়া ও আমার মনের মধ্যে এক অন্যরকম আশার আলো জ্বালাইয়া দিলো। অনলাইনে ক্লাস হইলে অনেক মেয়ের সহিত এমনেতেই পরিচয় হইবে। সে বলিল, ” এই, পড়বি নাকি?” 

কিছু দিন পূর্বে ফোন কিনিয়াছি। সারা দিন ফেইবুকে থাকি, হাসি তামশা দেখি, ভাইরাল ভিডিও কি তাও জানি, ফেইবুকের মানুষ দেখি, কত রকমের মানুষ, কত চিন্তা ধারার। কোনো কাজ নাই, পড়ালেখার তেমন কোন চাপও নাই। রাজ্য জুড়িয়া থাকার মধ্যে আমি বাদে আর মাত্র তাঁহারা দুজন আছে।  

এই নির্জন রাজ্যের মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপে অলীক কল্পনা করিতেছে- 

“পাথার পাড়ে পদচিহ্ন, তরঙ্গে তাহার দৃষ্টি, 

হাসিতে তাহার লুকিয়ে আছে হৃদয়ের যত কৃষ্টি।”

এমন সময় জুনায়েতের কল আসিলো, ” পড়বি? একটা ভালো ব্যাচ আছে, অনেক মেধাবি সে ব্যাচে…।” বসেন্তের হাওয়ার মতো ভাসিয়া দুটো ভবিষ্যত তরঙ্গ আমার হৃদয়ের পর্দার উপর আসিয়া পড়িল। তরঙ্গদ্বয়ের সৃষ্ট ব্যাতিচারে উজ্জল অন্ধকার ডোরাগুলো যেন আমার হার্টবিটের সাথে তাল মিলাইয়া ঝালর তৈয়ার করিয়াছে।

আমি জুনায়েতকে বলিলাম, ” একবার মায়ের সাথে আলাপ পাড়িয়া দেখো।” 

জুনায়েত কথার কারসাজিতে পটু। কি উপায় অন্যের মুখ হইতে ‘হ্যাঁ’ বলাইতে হয়, সে কৌশল সে ভালো করেই জানে। সালামের জবাব দিয়ে জুনায়েতের সহিত মায়ের আলাপ শুরু হইলো। কি পড়িব তাহা হইতে কাহাদের সহিত পড়িব সে বিষয়টাই তাঁহার নিকট অধিক গুরুতর। শিক্ষক মা যেমন চান তেমনই আছে; শহরে নামকরা। এককালে তাঁহাদের হাত ধরেই হাজারো ছাত্র বুয়েট,ঢাবি,মেডিকেলের পথে হাঁটিবার সুযোগ পাইতো। সেই সুনাম ধরিয়া রাখিবার জন্য তাঁহারা যথেস্ট চেষ্টা করিতেছে; অনলাইনে ক্লাস, এমনকি পরীক্ষার ব্যবস্থাও করিয়াছে। ছেলে যাহাদের সহিত পড়িবে তাহারাও কম মেধাবি নয়; পড়িলে উপকার ছাড়া অপকার হইবে না। সঙ্গদোষে যে লোহা ভাসে।

এসব ভালো কথা। কিন্তু মেয়েরাও যে সেখানে পড়িবে, তাই শুনিয়া মায়ের মন ভার হইলো।  মেয়েদের মেধায় তো কমতি নাই, তাই মেয়েদের জন্য এই ব্যাচ ছাড়া অন্যকোনো উপযুক্ত ব্যাচ শিক্ষক খুঁজিয়া পান না। একে তো করোনার দুর্যোগে আয়ের খাতে সমস্যা দেখা দিয়াছে। অন্যদিকে অনলাইনে পড়িবার মতো পড়ুয়া ছাত্র খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। শিক্ষক যদিও মেয়েদের জন্য ভিন্ন ব্যাচ খুলিবার জন্য সবুর করিতেছেন, তবু শিক্ষার্থীদের তো কলেজ জীবনের ঘড়ির কাটার সবুর করিতেছে না।

যাইহোক, জুনায়েতের কথায় জাদু আছে। মায়ের মন নরম হইলো। অনলাইনে প্রাইভেট পড়িবার সূচনা সম্মতিটা আদায় করাইয়া নিলো জুনায়েত। ছোট ভাই, ছোট হইলেও ঘরের কাজের দরকারে সে বাহিরের জগৎটা মোটামুটি ভালোভাবেই চিনে। মুরুব্বিদের সহিত তাহার ভালোই ওঠা-বসা। পাড়ার ছেলে-মেয়েদেও খবর রাখে। সে যদি কভু গ্রামের ছোট খাটো মেম্বার পদে বসিতে পারিত,  তাহলে বোধয় গ্রামে আর কোনো ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা তো দূরের কথা, কেহ কাহারো দিকে ঠিক মতো তাকাইতেই পারিত না। মনের মধ্যে ইচ্ছে ছিলো, প্রথম দিনই কল্যানীর মতো কাহারো সাথে অনুপম হইয়া আলাপ জামাইবো। কিন্তু সাহস করিয়া মাকে বলিতে পরলাম না যে, আমার ক্লাস চলিবার সময়, ছোটভাইকে দাড়য়ানের মতো পাশে বসাইয়া রাখিবার দরকার কিসে?

প্রথম দিনে প্রাইভেট পড়িবার পুরোটা সময় জুড়িয়া ছোট ভাই আমার পাশেই দাড়াঁইয়া ছিলো। তৃতীয় পক্ষের কোনো ব্যক্তি আমাদিগকে এভাবে দেখিলে নিশ্চয়ই বলিতেন, ” দেখো দেখো, ভাইয়ের প্রতি কি ভালোবাসা! ছোট ভাই ক্লাস দেখিতেছে ; আর বড় ভাই নিজ হাতে ফোন ধরিয়া বসিয়া আছে যাহাতে ছোট ভাইয়ের কষ্ট কম হয়।” যাইহোক, ক্লাস শেষে মায়ের নিকট ছোট ভাইয়ের রিপোর্ট, ” মেয়েগুলো যেমন ভদ্র,তেমন মেধাবি; তবে সবগুলোর বাড়ির পিছনের বড় কোনো গাছে বোধয় বক পাখির বাসা রইয়াছে। ” গ্রামের মুরুব্বিদের সহিত থাকিয়া সে এমন খোঁচ মারা কথা শিখিয়াছে। ছোটর উপর মায়ের অঢেল আস্তা। তাই এই রিপোর্ট শুনিয়া মা আমাকে অনুমতি দিয়াছে একা একা ক্লাস করিবার।   

ছাত্র হিসেবে আমাকে বেশ পছন্দ হইছে স্যারের নিকট। আমাকে তো ‘অতিবনম্র ছেলে’ বলিয়া উপাধি দিয়ে দিলেন। ক্লাস ভালোই চলিতেছিলো। কিন্তু আমি খুঁজেতিছি আমার কল্যানীকে। সে আর হচ্ছে না, ক্লাসে নিয়ম হইলো কথা কম, ক্যামেরা বন্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। কেমনে কেমনে জানি, ইন্টার পরীক্ষা দরজায় বেল বাজাইলো। আর হইলো না, অনলাই ক্লাস বন্ধ ; সবাই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমিও তাহাদের সাথে তাল মিলাইয়া প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ত হইয়া পরিলাম। ইন্টারে মোটামুটি ভালোই রেজাল্ট হলো। 

কলেজের এক বিশেষ বড় ভাই বিশেষ ভার্সিটিতে বিশেষ অবস্থান অর্জন করিয়াছে। অনুপ্রানীত হইয়া তাঁহার অনুসরন করিবার চেষ্টা করিলাম। অর্থাৎ,  লক্ষ ছিলো স্টেশন ‘এ’ হইতে ‘বি’ নামক ট্রেন ধরিবো। প্রায় ধরিয়া ফেলেছিলাম, কিন্তু দরজার সমানে গিয়া পিছলে পড়ে গেলাম। সেই আঘাত সারিতে গিয়ে ট্রেন ‘সি’ এর টিকিটটাই কিনিতে পারিলাম না। অতপর, ট্রেন ‘ডি’ এর টিকিট কিনিয়া মন ভার করিয়া বসিয়া আছি। ট্রেনটা আসিলো আর কোনো মতে একটু জায়গা পাইলাম। মানে, কোনো মতে ঢাবিতে একটু আশার আলো দেখতে পাইলাম। তাই আবার পড়াশুনা ছাড়িয়া ফেইসবুক নিয়া বসিলাম, মূল্যবান সময় নষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে। 

হঠাৎ,  ফেইসবুকে ভ্রমন করিতে করিতে একদিন আমার হৃদয়ে এক ভিন্ন রকমের টর্নেটো সৃষ্ট হইলো, ঠিক টেক্সাসের টার্নেডোর অনুরূপ! প্রজাপতি? সেটাও আছে। প্রজাপতি না থাকিলে তো টেক্সাসের অনুরূপ হইতো না। আচ্ছা প্রজাপতির পরিচায় দেই। 

ফেইসবুকে আমার এ যাবত কিছু মেয়ে বন্ধুও হইছে, সবার মুখ চিনি না। যাহাদের হইতে মায়ের অনুমতিক্রমে কেবল পড়ালেখা বিষয়  আলাপ করি। এরকম এক বন্ধু হইলো ‘তাইয়েবা’। কিছুদিন আগে সে তাহার কিছু সইদের সহিত ঘুড়িতে গিয়াছিলো। ভ্রমন ব্যতিত জীবন পুরোপরি উপভোগ করা যায় না। পড়ালেখা শেষে অন্তত প্রতি মাসে ১ বার ভ্রমন করবোই ; হয়তো মানুষের সহিত মিশিয়া যাইবো নয়তো প্রকৃতির সহিত। একদিনে ভ্রমন মানুষকে যাহা শিক্ষা দেয় এক মাসের বই তাহা দেয় না। যাইহোক, তাইয়েবা তাহার সইদের সহিত কিছু দৃশ্য মুঠোফোনের নয়ন যন্ত্রে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলো। পরে ইহা তাহার স্টোরিতে দিলো। আমি ফেইসবুকে ভ্রমন করিতেছিলাম,  হঠাৎ দেখতে পাইলাম সেই স্টোরি। এক অপূর্বা রমনী, সে যেন এক সাদাগোলাপ স্থির হইয়া আছে। তাহার হাসি দেখিয়া মনে হইছিলো, সাদা গোলাপের উপর কোনো নীল প্রজাপতি পাখা ঝাপটাইতেছে। কি অপরূপ সেই দৃশ্য। সেই প্রজাপতির পাখায় সৃষ্ট তরঙ্গ আমার হৃদয়ে প্রেমের টার্নেটো সৃষ্ট করিয়াছিলো। এর মানে বাটার ফ্লাই ইফেক্টে প্রেমও হইতে পারে, ইহা আজ আমি প্রমান করিয়া দিলাম। 

আমি খুঁজিয়া পাইছি আমার কল্যানীকে। আহা! তাহারে আমি কল্যানী কেন ডাকিতেছি? তাহাকে আমি তরঙ্গিণী বলিয়াই ডাকিব। তাহার তরঙ্গই যে আমার হৃদয়ে কম্পন তৈয়ার করে। তরঙ্গিণীর পরিচয় জানিবার জন্য আমি উন্মনা হইয়া গেলাম। কিন্তু তাইয়েবা তখন লাইনে ছিলো না। ‘কি করিব, কি করিব?’ এই ভাবিয়া অস্থির হইয়া গেলাম। ঝটপট করিয়া আমার অন্য এক মেয়ে বন্ধুকে তরঙ্গিণীর চিত্রখানা দেখাইয়া বলিলাম, চিনো তাহাকে? জবাব দিলো,  ” ক (নাম) আপু”।

আমি ঐ উত্তেজিত অবস্থায় তেমন কিছু ভাবিতে পারি নি। তাই আবার প্রশ্ন করিলাম, 

-” সিনিয়র নাকি?” 

-” হুম, মাস্টার্স শেষ।” 

-“কোন ভার্সিটি? কোন ইয়ার? ফেইসবুক আইডি?  কোনো কিছু জানো?” 

সহজ একটা রিপ্লাই আসিলো, ” জানি না কিছু।” বলিলাম, “তাইয়েবা জানে?” 

– ওর সহিত যেহেতু ছবি তুলিয়াছে, তাহলে তো ওর জানিবার কথা।

– তাহা ঠিক। তবে ওতো লাইনে নাই।

– এখন দেখ আসিয়াছে।

– সত্যইতো!  দাঁড়া জিগাইয়া আসি।  

এইবার অতি আগ্রহ নিয়া তাইয়েবাকে প্রশ্ন করিলাম,

– তোর সহিত এটা কাহার ছবি?

– কেন?

– ভালো লাগছে অনেক। 

– প্রেম করবি?

– না, না। প্রেম করা পাপ।

– তাহলে?

– সোজা বিয়ে করিবো। 

– কবে?

– ভার্সিটি শেষ করিয়া। আচ্ছা তোকে এসব কেন বলিতেছি? তুই বল আগে কে সে?

– আমাদের কলেজের।

– কি কস! পড়ে কিসে?

– আমাদের সাথে।

হুট করে আবার ক’ কে নক করিলাম।

– কিরে? সে নাকি আমাদের সহিত পড়ে? তাইয়েবা বলিলো। কিন্তু তুই বললি যে সিনিয়র?

– হুম। তাবে হয়তো ফেল টেল করিয়াছে। তাই আমাদের একই ব্যাচে বোধয়।

– ফেল করুক আর যাহাই করুক, আমার ভালো লাগছে মানে ভালো লাগছে। তুই যেমন করিয়া বলিতেছো,  তাহার মানে তুই তাহাকে চিনোস না ঠিক মতো।

– না, চিনি না।

আমি আবার তাইয়েবাকে নক করিলাম,

– থাকে কোথায়? ফেইসবুক আইডি, হটস এ্যাপ, ইমু কোনো কিছু আছে,  যোগাযোগ করিবার মতো? 

– থাকলেও তোকে দিবো কেন? কাচ্চি খাওয়াবি?

– খাওয়াবো,  আগে তুই আইডি দে।

– কবে খাওয়াবি?

– আচ্ছা ঢাবিতে আসিস, তখন খাওয়াবো।

– তাহলে আইডিটাও তখন দিবো,,,,

– এটা কোনো কথা? 

– আচ্ছা আগে ওরে বলে দেখি রাজি হয় কিনা। তারপর জানাবো নে।

এরপর থেকে আমার তরঙ্গিণীর জবাবের অপেক্ষায় রইলাম। রাত ঘুম হইতেছে না। বার বার তাহার ছবিটা দেখিতেছি আর কত যুগ ভবিষ্যত কল্পনা করিতেছি।  কল্পনা করিতে করিত আমি ঘুমাইয়া পরি। 

সকালে আবার ফোন হাতে লইলাম। কোন এক বিশেষ সূত্রে জানিতে পারিলাম: যে আমাকে প্রতিউত্তরে বলিয়াছিল, ” ক আপু ; মাস্টার্স পাশ; সিনিয়র আপু;,,” ইত্যাদি সে’ই হইলো আমার তরঙ্গিণী। তাহলে আমার সহিত ওরকম রসিকতা করিয়া কথা প্যাচাইবার কি দরকার ছিলো! আমি ঝটপট করিয়া তরঙ্গিণীকে নক করিলাম, ” কিরে কাল তুই,,,” আর কিছু বলিতে পারিলাম না। কারন ইতমধ্যে তাইয়েবা মেসেজ করিয়াছে যে, ” তুই যখন আমাকে আর তাহাকে মেসেজ দিছিলি তখন আমরা দুজন পাশাপাশি ছিলাম।” আমি বলিলাম,” এটা কোনো কাজ হইলো, আমার তো প্রচুর ভয় করিতেছে। যদি কখনো দেখা হয় তবে কি বলিবো?” ও বলিল,” আরে বোকা ইহাতে আরো ভালো হইছে, তুই তোর মনের কথা সরাসরি বলিয়া দিছো।” যাইহোক তারপর হইতে তরঙ্গিণীর সহিত ভাবিয়া চিন্তা করিয়া কথা বলি।  

কয়েকদিন ধরিয়া সে আমার মেসেজের কোনো প্রতিউত্তর দিতেছেনা। মনটা খুবই খারাপ। তাই, তাইয়েবাকে জানাইলাম। তাইয়েবা বলিল,” সামনে তাহার পরীক্ষা, তাই পড়িবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। ফল মন্দ হইলে তো তাহার দিকে ফিরিয়াও তাকাইবি না।”

ওহে তরঙ্গিণী, তাহারা তো বুঝে না যে তোমার প্রেমের তরঙ্গে আমি দুলিতেছি। প্রেম বা ভালোবাসা যে পরীক্ষার ফলের উপর নির্ভর করে না; ইহা একান্তই মনের ব্যাপার। হুমায়ুন স্যার বলেছিলো: ” মন হলো ফ্রিজের মতো। ফ্রিজের ঠান্ডায় যেমন সবজি ভালো থাকে; তেমনি যাহার মন যত ঠান্ডা তাহার মনে ভালোবাসা তত সতেজ থাকে।” আমার মন কতটা ঠান্ডা তাহা তুমি ছাড়া আর কেহ অনুভব করিতে পারিবে না। আর তোমার মন?? সেটা আমার বোঝার বাকি নেই।  তোমার  ঐ “আহারে” প্রতিউত্তর আমাকে তোমার প্রেম সাগরে আরো প্রবলভাবে দুলাইতে থাকে। ওহে তরঙ্গিণী, আমি সারা জীবন এভাবেই দুলিতে চাই।

তোমার “আহারে” প্রতিউত্তর শুনিয়া তাইয়েবা বলেছিলো, তুমি নাকি আমার প্রেমে গলিতেছো। তোমাকে গলানোর জন্য আমি সর্বত্তম দ্রাবক রূপে তৈয়ার হবো। তোমাকে নিয়া তৈয়ার করিবো এক ত্রুটিহীন দ্রবন (সম্পৃক্ত দ্রবন)। সম্পৃক্ত দ্রবন তৈরিতে দ্রাবক হিসেবে আমার যতরকম পরিবর্তন হইতে হবে, ঠিক তেমনই হবো। যখন তুমি মেসেজের উত্তর দিতেছিলা না তখন ওরা বলিতেছিলো, তুমি নাকি অনেক ধারালো। যদি তুমি ধারালো হও তবে আমি নিজেকে তরল পদার্থ রূপে উপস্থাপন করিব। যাহাতে তুমি তোমার ইচ্ছে মতো আমাকে কাটিতে পারো। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তো আমি কাটিব না কারন আমি তরলে রূপান্তর হইবো; যখন তুমি কাটিতে কাটিতে ক্লান্ত হইয়া পরিবা তখন তোমার ক্লান্ত শরীর আমি তরল জলরূপে ভিজাইয়া ঠান্ডা করিয়া তুলিব। 

ওহে তরঙ্গিণী, চলো না আমরা দুজনে হ্যাঁ-না গ্রাফে একটা ধনাত্মক ঢাল বিশিষ্ট সরলরেখা তৈয়ার করি। আনুভূমিক অক্ষে আমার মত আর উলম্ব অক্ষে তোমার মতামত বসাই; যেন একক ধনাত্মক ঢাল বিশিষ্ট রেখা তৈরি করি। যেখানে প্রতিটি বিন্দুর স্থানাঙ্ক হবে ( হ্যাঁx1, হ্যাঁy1), (হ্যাঁx2, হ্যাঁy2),,,,,  এভাবে চলেতেই থাকিবে আমাদের জীবনের সরলরেখা। যদি কেহ উল্ট পন্থায় সরলরেখা তৈয়ার করার কথা বলে; তাহাদিগকে বলিবো ইহা কেবল প্যারালাল ইউনির্ভাসে ঘটিবে হয়তো, যাহা নিয়া তোমাদের না ভাবিলেও হইবে।

ওহে তরঙ্গিণী, আমরা চিলকাল ২২০ আর ২৮৪ এর মতোই নাহয় থাকিবো। যেমন: ২২০ সংখ্যাটির প্রকৃত উৎপাদগুলো হইলো ১, ২, ৪, ৫, ১০, ১১, ২০, ২২, ৪৪, ৫৫, ১১০। এই উৎপাদকগুলোর সমষ্টি হইলো ২৮৪। আর এই ২৮৪ এর প্রকৃত উৎপাদকগুলো হইলো ১,২,৪,৭১,১৪২। এই ২৮৪ এর প্রকৃত উৎপাদকগুলোর সমষ্টি করলে ২২০ হয়। মানে ২২০ এর মধ্যে ২৮৪ লুকিয়ে আছে আবার ২৮৪ এর মধ্যে ২২০ লুকিয়া আছে। তেমনি তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় জুড়িয়া আমি বিরাজ করিব আর আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় জুড়িয়া তুমি। অবশ্য আমি সেদিনই তোমাকে আমাতে মিশাইয়া নিয়াছি। দুই চোখে কেবল তোমার মুখখানাই ভাসিয়া উঠে, কানে কেবল তোমার সেই আওয়াজটুকুই ভাসিয়ে আসে “আহারে!”, আমার নাকেতে কেবল তোমার খোঁপায় ফুটে থাকা গাজর-গোলাপের সুভাসই ভাসিয়া আসে যাহা আমাকে উতলা করিয়া দেয়, আমার জিহ্বায় কেবল বারংবার তোমার নামটাই ফুটিয়া উঠে, স্বপ্নকালে কেবলই তোমার স্পর্শই আমার ত্বক  অনুভব করিয়া থাকে। আমার এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় জুড়িয়া কেবল তুমিই রইয়াছো, ওহে তরঙ্গিণী। ষষ্ঠ্য ইন্দ্রিয়? ‘টপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ’   সেটার কথা না হয় আড়ালেই বলিবো।  

ওহে তরঙ্গিণী, আমি তো সেই কবে হ্যাঁ বলিয়া অপেক্ষা করিতেছি, তুমি কি এখনো না’তে আটকিয়ে আছো? হয়তো বা মাল্টিভার্স থিউরি মতে অন্য ইউনিভার্সে তুমি হ্যাঁ বলিয়া আমার চারিদিকে ইলেকট্রনের মতো ঘুরিতেছো আর আমি বোধহয় সন্দেহ নামক নিউট্রনের সাথে দুর্বল নিউক্লিও বলের ( যেহেতু মাল্টিভার্স, তাই আমাদের ইউনিভার্সে সবল নিউক্লিও বল প্যারালাল ইউনিভার্সে দুর্বল নিউক্লিও বল, (সম্ভাব্য)) কারনে আটকিয়ে আছি। তবু তুমি বিশ্বাস করো, ঐ প্যারালাল ইউনিভার্সে তোমার প্রেমের টানেতে আমি দুর্বল নিউক্লিয় বলকে অতিক্রম করিয়া এতক্ষনে তোমার প্রতি ছন্দ রচনা করিতে বসিয়া গিয়াছি: 

“আমি বুঝিনি, বুঝিতে পারিনি সেদিন তাহার ঐ কাব্যের রসালো ভাষা। বুঝিবার উপায়ই বা কি? সেদিন এ মনতো ছিলো অবুঝ, যদিও বা ছিলো উর্বর! তাই বুঝি হেথায় জন্মানো নব বৃক্ষ কিশলয়ের দোলদোলানির  আঘাতে কাব্যের সে পাতা ফের আলো ফেলিয়াছে নবীনের নয়নে। না, আমিতো নেত্রপল্লব মেলিয়া কভু দেখিতে চাইনি এ পাতা, গা বা গন্ডদেশে বারিপাত করিনি কভু এ বৃক্ষের জীবন বৃহৎ করিবার জন্যে কিংবা বৃক্ষের সজীবতা বজায় রাখিবার জন্যে। হয়তো, তাহার অন্তরের গভীরে গয়ার ঐ জলের মতো ভালোবাসা  বাহিত হইতে ছিলো। যে প্রবাহের অলীক গতি সকল বাধার স্তরকে ছেদন করিয়া কিছু জল প্রতি ক্ষনে ক্ষনে বাষ্প হইয়া মেঘ রূপে নবীনের ঐ উর্বর জমির উপর দিয়া ভাসিতে থাকিতো। যাহা হইতে বর্ষা ঝরিতে থাকিতো। যে বর্ষার জলে দিনে দিনে বৃক্ষের রূপ নেয় তাহার ফেলে আসা ঐ অতীতের বীজ। যে বীজে মিশিয়া ছিলো তাহার করতলের বকুলের গন্ধ। যে গন্ধ আজও ধারন করিয়াছে ওই অচেনা বৃক্ষের সর্ব অঙ্গ। নবীনের উর্বর জমিতে উদয়মান সে বৃক্ষ আজ নিজের শিকড়কে সাজিয়ে বানাইয়াছে তাহার বসিবার আসন। আর পাতা হইতে আকাশে-বাতাসে ফেরোমন নিঃসৃত করিতেছে  অনবরত; তবু যদি, সে পিপীলিকার রূপ ধরিয়া আসিয়া এ আসনে বসিয়া মনের সুখে গুটিকতক ফল আহার করিত! ” 

ওহে তরঙ্গিণী, তুমি কি কল্যানীর মতন ব্রত করিয়াছো? তোমার ঢেউ কি আমার হৃদয়ের পাড়েতে আসিয়া লুটাইয়া পরিবে না, নাকি কুলে আসিবার আগেই ঊর্মিকে নিজের মধ্যে গুটাইয়া নিবা? কিন্তু ভাগ্য আমার ভালো, এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি তোমার চারিধারে; সন্ধ্যা হইয়া সন্ধ্যার তীরে!

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়