fbpx

যমকুলি

লেখাটি গত শতকের আশির দশকের প্রেক্ষাপটে লেখা। সাধুভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। নিতান্তই অপরিপক্কতার জন্য বহু ভুল চোখে পড়তে পারে, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

বেলা পড়িয়া আসিতেছে। পৈঠায় বসিয়া সর্দার পত্নী হাতে আলস্য ও আয়েসি ভঙ্গিতে সরতায় সুপারি কাটিতেছে। উত্তর ঘরের পৈঠায় গালে হাত ঠেসে বসিয়া ইসুবের নতুন বৌ আসমানের দিকে তাকাইয়া লাল আভায় ঘনিয়ে আসা গোধূলি দর্শন করিতেছে। দেখিল, সুপারি গাছের মাথা ছাড়াইয়া জমাট বাধিয়া মশার দল ধোয়ার মত লহরী তুলিয়া আসমানে মিশিতেছে। তাহাদের উর্ধ্বগামী তরঙ্গিত প্রবাহ ইসুবের বৌয়ের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হইয়া তাহার যৌবনবতী চঞ্চলপ্রানের উপর উপরিপাতিত হইয়া তাহাকে বিষাদিত করিয়া তুলিল। বিষাদের ঘোরে আক্রান্ত হইয়া সে তাহার ফেলিয়া আসা পিতৃগৃহের প্রতি বিশেষ টান অনুভব করিতে লাগিল। আবুর বাড়ির মতালির মা ভাতের মাড় সংগ্রহ করিতে আসিয়া ইসুবের বৌকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘কিতা গো নতুন বেডি, সইন্ধ্যাবেলা গালে হাত দিয়া বইয়া থাহন বালা নি? মা বাপে কিচ্ছু হিয়াইছে না?’ বলিতে বলিতে সে প্রস্থান করিবার পূর্বেই সর্দার পত্নী তাহাকে বসিবার আহ্বান করিলে সে বাড়িতে গিয়ে সন্ধ্যার কাজ সারিবার তাড়া রহিয়াছে হেতু বসিতে পারিবেনা বলিয়া অগোচর হয়ল। জানুমোল্লা দুয়ারে বসিয়া হারিকেনের চিমনি ছাই ভিজাইয়া ঘষিতেছে। কচ কচ আওয়াজ হয়তেছে। এলাহি গরু লইয়া ঘরে ফিরিবার কালে সন্ধ্যার কাপড়গুলো এখনো কেন বাহিরে ঝুলিয়া আছে তাহার জন্যে পায়চারি করিতেছে। ওহাবের বউ আসিয়া কাপড়গুলো তুলিয়া লইতে লইতে তাহার পুত্র বড় বাবুরে ডাকিতে লাগিল। এখনো ঘরে ফিরিল না। ছোটবাবুরে নতুন জুতা কিনিয়া দেওয়া হইয়াছে। সে আজ খেলা হইতে ফিরিতে বিলম্ব করিল না। কোনরকম হাত-পা ধুইয়া নতুন জুতায় পা দ্বারা কচকচ শব্দ করিতে করিতে বাড়িতে প্রবেশ করিতেছে। 

এমনি করিয়া সায়ংকালীন নানান ব্যস্ততা আর কোলাহলে কালুরবাড়ির কর্মযজ্ঞ যখন চলিতেছে তখন ধরনীর নিস্তেজ হইয়া আসা রূপ কাহাকে কোথাও হয়ত নিঃসঙ্গতা আর বিষণ্ণতায় চাপিয়া ধরিতেছে। দিবাভাগে সূর্যকর পৃথিবীবাসীকে যেমন করিয়া চঞ্চল করিয়া তোলে তেমনি করিয়া তাহাদের এক কাল অন্ধকারে ঠেলিয়া ফেলিয়া যায়। পৃথিবীবাসী তাহার প্রতিবাদ করিতে পারেনা। সারাদিন এমন সজীব রাখিয়া বেলা পড়িবারকালে এমন নিঃসঙ্গ করিয়া বিষণ্ণতা চাপিয়া লয়তে বাধ্য করিবে কোন দোষে তাহা জিজ্ঞেস করিবার সাহস পৃথিবীবাসী কোনদিন দেখাইল না। তাঁহাদের এই একাকীত্ব দূর করিতে কর্তা অবশ্য নিশীথে পূর্ণিমার ব্যবস্থা করিয়াছেন। তবে তাহা মাসব্যাপিয়া নহে। পূর্ণিমার বিপরীতে তিনি আমাবস্যাও রাখিয়াছেন। পূর্ণিমার মোহ কাটিতে না কাটিতেই আমাবস্যা আসিয়া হাজির হইলে দরিদ্র গৃহস্থের পত্নীগন সন্তানকে কোলে লইয়া বাহিরে আসিয়া জ্যোৎস্না দেখাইয়া ক্রন্দন নিবৃত করিতে পারেন না। নিস্পন্দ কোলাহলহীন অন্ধকারে অদূরে যমকুলি ডাকিবার সুরেসুরে শিশুর এহেন কান্নার ঐকতান বড় বিভীষিকাময়। কোনোদিন আবার শিশুর কান্না থামিয়া যায়, কাঁদিতে শুরু করে তাহার পরিজনেরা।

.

রউফের ছোটকন্যা জেসমিন আসিয়া দেখিলো তাহার চটিজোড়ার একখানা ছিঁড়িয়া আছে। ইহা বাঁধিতে কুপির আগুনে গুনা তাপ দিতে হইবে। কুপির সলতে যতটুকু  বাহিরে ছিল তাহার আগুনে গুনা লাল হইবে না। জেসমিন সলতে আরেকটু বাহির করিতে পুরোটাই ভেতরে ফেলিয়া দিল। জুতা কি জন্যে ছিঁড়িলো, সন্ধ্যা করিয়া গৃহাগমন আর এখন সলতে ভেতরে ফেলিয়া দেওয়া— এই ত্রিবিধ অপরাধ হেতু তাহার ব্যতিব্যস্ত মা আসিয়া তাহার পিঠে ’দুড়ুম’ করিয়া একখানা বজ্রের মত ঘুষি চাপাইলে জেসমিন আচমকা বিদ্যুতের মত প্রস্থান করিলো। রউফের স্ত্রী সলতে টানিয়া বাহির করিতে করিতে প্রলাপোক্তি নিবেদন করিতেছে,’তোর কোন বাফে লো কেরাসিন আইন্না দিবো? দেখছছনি তাইয়ের আলামতটা, তাইয়ে কেম্নে সইলতাডা ফালায়া দিলো। আমিনি ইডা বাইর করতারুম? কতলা কেরাসিন পরতাছে দেকছনি?’ জেসমিন জননী সন্তান-সংসারের সংগ্রামে যন্ত্রণাগ্রস্ত এবং এহেন যন্ত্রণার দায় জন্মদাতা রউফের উপর বর্তায়ে ক্ষোভ ও দুঃখের মিশেলে বলিতেছে, ‘হের ঝি-পুতাইতের জ্বালা বিতরটা এহেকবার বিছকানি মারে’।

.

ডোবার পাড় হয়তে হাক-ডাক  আসিতেছে—

‘কইরে পোলাপুরি? কেডা কই আছ? আরে আয়ছ না রে।’ থামিয়া থামিয়া আবার ডাক আসিতেছে, ‘কইরে বাবুইল্লার বাফ?’, ‘ও বুড়াবিডির জামাই, আয়ছ নারে’। ডাকিতেছে জামেলা বেগম। তাহার হাঁকডাকের  চরিত্রগুলো এখন ধীরে ধীরে মাতৃসদনে প্রবেশ করিতেছে, সুতরাং জামেলা বেগম ডাকিতেছে তাহা কানে শুনিলেও কিসের জন্য ডাকিতেছে তাহা অনুসন্ধান করা এই মুহূর্তে তাহাদের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার হইয়া দাড়াইল। তবে সদ্য পলায়নকৃত জেসমিন আসিয়া জবাব দিল— ‘কিতা বড়ঝি?আফনে হিয়ানো কিতা করুইন?’ কন্ঠ শুনিয়া ভাটিতে দাঁড়ানো জামেলা বেগম উপরে তাকাইলেন। হাঁস নিয়ে বেকায়দায় থাকা জামেলা তাহার বয়োকনিষ্ঠ অনুরাগী জেসমিনের উদার প্রত্যুত্তর ক্ষুদ্র বলিয়া ভাবিল না। বলিল— ‘কয়গো মা, আছো? আমার লগে ইডা দও আয়া।’

.

জামেলা বেগমের হাঁসের কপাল সুপ্রসন্ন নহে। একটি মাত্র হাঁস তাহার খোঁয়াড়গৃহ অধিকার করিত । তবে ইহা কদাচিৎই স্বগৃহে ফিরিত। ইহার আণ্ডা সে খুব কম দিনই উদরসাৎ করিতে পারিয়াছিল। ঝোপঝাড়েই আণ্ডা প্রসব করিয়াছে বয়স হইবার পরের দিনগুলিতে। দক্ষিন বাড়ির জমশু ভাইসাবের পুত্র আলম কিংবা মাইঝের বাড়ির  হারুন ভাইয়ের পুত্র মঙ্গল আসিয়া ডিমগুলো রোজ কুড়াইয়া লইয়া যায়। বাবুইল্লার বাফ, বুড়াবিডির জামাই বা জেসমিনদের মত যাহারা জামেলা বেগমের অনুগত রহিয়াছে তাহারা পাইলে জামেলার কপালে নিজের ডিমের ভাগ জুটিত আর তাহারাও ভাগ পাইত। এমন বাউণ্ডুলে, ছন্নছাড়া হাঁস লইয়া জামেলা বেগম একটু বেসামাল অবস্থাতেই রহিয়াছে বটে। সে একদিন পণ করিলেন ইহা মেয়ের জামাকে খাওয়াইবেন। আজ জামেলা আর জেসমিন মিলিয়া সেই হাঁসই ধরিতেছে। তাহার বড় কন্যা আঙ্গুরা আজ স্বামী সহিত পিতৃগৃহে অতিথি হইবে। নিয়মিতই তাহারা পৌঁছাইতে গোধূলি অতিক্রম করিয়া থাকে। আজকে সন্ধ্যা অতিক্রম করিবে সে সন্দেহ বাকি রহিল না। সুতরাং হংসভোজ রাত্রিতে সম্পন্ন হইবে।

.

এদিকে হাসের গতি নির্ধারণ করিতে জামেলা বেগম আর জেসমিন পাথর নিক্ষেপ করিতেই থাকিল। কখনো ডান নির্দেশ করিতে, কখনো বাম নির্দেশ করিতে। আবার নিশ্চল হয়ে পড়া হাসের গতি ফিরাইতে ঢিল নিক্ষেপ চলিতেই থাকিল। বিশেষ আবেদনের সহিত ‘আয়, আয়’ বলিয়া ক্রমাগতই  ডাকিল। কিন্তু হাঁস নির্বিকার— ভ্রুক্ষেপও করিতেছে না তাহাদের প্রতি। উপায়ন্তর না দেখিয়া জেসমিন বলিল, ‘বড়ঝি, আমি নামি?’ জামেলা নিরুপায়, এই মুহুর্তে সাহায্যের যেকোন অনুরোধ সফলতার সম্ভাবনা নিরীক্ষণ ব্যতিরেকেই সম্মতি প্রদান করিতে সে বিলম্ব করিল না, বলিল— তুমি পারবানিগো মা? জেসমিন ডোবায় নামিয়া হাস উদ্ধার করিবার কাজকে বড় তুচ্ছজ্ঞান করিয়া বলিল— ‘আফনে কিতা কইন, পারতাম না কেরে!’ জামেলা জেসমিনের মায়ের খোঁটা-গঞ্জনা করিবার বিষয়ে শংকিত হইয়া জেসমিনকে ডোবায় নামিতে নামমাত্র নিরর্থক বারন করিলেন। জেসমিন সেই শংকাকে সন্ধ্যার নিস্তব্ধ-নিরব আবহে মিশিয়ে দিয়ে তাহার ভগ্নস্বাস্থ্যে লজ্জা যাইবে বলিয়া কোনরকম কটিদেশ আকরাইয়া থাকা হাফপ্যান্টখানা** খুলিয়া ডোবায় ঝাঁপ দিল।

.

জামেলা বেগম হাঁসের পাখনা ছিঁড়িতেছে। জেসমিন গালে হাত রাখিয়া তাহার কর্মকাণ্ডে অপলক চোখ পাতিয়া পাশে বসিয়া রহিয়াছে। চুল অল্প ভিজিয়াছিল, তাহা হইতে পানি ঝরিতেছে। ঘরে ফিরিবার উপায় নেই। কিছুকাল পূর্বেই ঠ্যাঙানি খাইলো, উপরন্তু এই সন্ধ্যায় ডোবায় নামিল যাহা গ্রামীন মাতৃশাসন আইনের তীব্র লঙ্গন! এতবড় অপরাধ সংগঠন করিয়া বঙ্গীয় আসামিরা হাকিমের দ্বারস্থ হইবে তাহা কল্পনাতীত। জেল জরিমানা হইতে পলায়ন করিতে তাহারা সাধু-সন্ন্যাসী সাজিয়া দূর-দূরান্তের কোন অচেনা গাঁয়ের খেত নিড়ানি দেওয়া কৃষকের পাশে বসিয়া কম গুরত্বের ছোটখাটো প্রশ্নবাণে বেলা কাটাইবে। 

    জেসমিনও কর্মব্যস্ত জামেলার নিকটে বসিয়া ছোটখাটো বাক্যবিনিময়ে সময় ব্যয় করিতেছে— ‘বড়ঝি, কারে কারে দাওয়াত দিছুইন?’ 

জামেলা বেগম হাঁস গরম পানিতে চুবাইতেছে। অল্পবিস্তর মনোনিবেশ করিয়া জেমসিনকে জবাব দিল—

‘তোমার মিলিটারি কাহা আর মছিদের হুজুররে কয়ছি চাইট্টা ভাত হাইত।’

মিলিটারি কাকার সহিত তাহার বাপকে নিমন্ত্রণ করা হইবে কিনা জিজ্ঞেস করিল। প্রত্যুত্তরে জামেলা বিনয়ের সহিত পরামর্শকমূলক প্রশ্ন ছুড়িয়া কহিল— ‘না গো মা, অতলা মাইনষের অইবো এ আশটা দিয়া?’।

জেসমিন অন্যমনস্ক হইয়া রহিল। নজর পড়িয়া আছে হাঁসের পাখনা ছাড়ানোর দিকে। ছোট করিয়া জবাব দিল, ‘না অইত না।’  মুহূর্তেই আবার মনস্ক হইয়া কিছুটা আগ্রহ লইয়া জিজ্ঞেস করিল—‘আমারে দাওয়াত দিতাইন না?’ জেসমিনের চোখে-মূখে অনুকূল উত্তর পাইবার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। জামেলা কহিলেন, ‘হ হ, তুমিও তোমার মিলিটারি কাহার সাথে হাইয়ো’। জেসমিন মনে মনেই তুষ্ট হইল। নিমন্ত্রনের প্রফুল্লিত প্রত্যুত্তর করিল না। জামেলাও প্রত্যুত্তর শুনিবার ঝোঁকে নেই। তবে জেসমিনের নিজের নিমন্ত্রণ পাইবার অনুরোধ অবচেতনে জামেলা বেগমের মনে কোথাও স্থান করিয়া লইয়াছে ঠিকি। তাহার এই অনুরোধ হয়ত আগামীকাল সই, ননদ আর দেবরপত্নীদের সহিত হাস্য-পরিহাসের খোঁড়াক হইবে। আপাতত তাহার মনোনিবেশ হাঁসের দিকেই রহিল। হাঁসের পাখনা ছাড়ানো শেষ হইয়াছে, এখন কাটাকুটি চলিতেছে। জেসমিন অপলক দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিল। মৃদ্যু চেতন হারাইলো। অবচেতনে আবার জিজ্ঞাসা করিলো,‘বড় আফা অহনো আইয়ে না কেরে?’ 

জেসমিনের প্রশ্ন শুনিয়া কর্মব্যস্ত জামেলার মনে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্নতার জন্ম হইল। শঙ্কার সহিত জেসমিনকে জবাব দিল— ‘আল্লাই জানে , মুগরিবের আযান দেলাইছে, অহনো আইয়ে না কেরে!’

জেসমিন পথপানে চাহিবার আগ্রহ জানাইল,

—আমি আজ্ঞাইয়া যাই?

—যাও মনে চাইলে

.

পশ্চিমে সূর্যদেব ডুবিয়া যাই যাই করিতেছে। আকাশ লাল করিয়া এখন পৃথিবীবাসীর নিঃসঙ্গতা ও আগমনী মহাকালরাতের অপেক্ষাকে ক্রমশই ভারী করিয়া তুলিতেছে। এই রক্তিম ব্যবস্থা আজকের কুটুম্ব আসিবার পথে বড়ই নিয়ামক হইল বটে। তবে আলো সময়ের সমানুপাতে কমিয়া যাইতেছে ঠিকই। কুটুম্ব আসিবার পথ ম্লান থেকে ম্লানতর হইতেছে। পাঘাচং হইতে এরি ক্ষেতের আইল দিয়া মাইলখানেক পথ হাটিয়া সর্দার বাড়ির কুটুমেরা আসিয়া থাকে। মালগাড়ির মতন ধীর কিন্তু বিরামহীন পদচালনা করিয়া তাহারা হাটে। প্রতি চলনে দুলিয়া দুলিয়া তাহারা হাটে। সরু, ইষৎ কর্দমাক্ত আইল দিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া হাটিবার ফাঁকে কেহ একজন হেলিয়া ধানক্ষেতে পড়িয়া যায়। নাবালকেরা খিলখিল হাসি জুড়িয়া দেয়। অন্যরা মুখ চাপিয়া হাসে। যাত্রাপথে খানিক বিরাম হয় । সেচের পানিতে কোনোরকমে পা ধুইতে গিয়া কেহ হয়ত দেখিল তাহার দেড়শ টাকা দামের বাটা জুতাটাই ভিজিয়া গিয়াছে। আক্ষেপ করিয়া, ঝাড়িয়া আবার হাটে সবাই । এই মাইলখানেক পথের নানান কাহিনী কারবারে কুটুম্বদের আগমন একটা পরিলক্ষণীয় ব্যাপার হইয়া থাকে। বয়োজ্যেষ্ঠগণ ধন মিয়া ভাইসাবের বাড়ির ঘাটায় গালে হাত চাপিয়া বসিয়া আগমনী দৃশ্য পরিদর্শণ করেন। আর নাবালেকরা ভো দৌড়ে আগাইয়া যায়।

.

জেসমিস ঝিম ধরিয়া বসিয়া আছে। আগাইয়া গিয়ে আতিথ্য প্রদান করিবার কথা কথার কথায় বলিয়াছিল। বলিতে যেমন অতি আগ্রহ ছিল না তেমনি আগাইয়া যাইবার মত ক্ষুদ্রতম আগ্রহও তাহার চোখে মুখে দেখা যাইতেছে না। জামেলা বেগম হাস কাটাকাটি শেষের দিকে লইয়া আসিলেন। জামেলা বেগম সব গোছাইয়া উঠিতে যাইবেন এমন সময় ‘আঙ্গুরা আফা আইছে, আইছে’, ‘আইছে’, ‘আইছে’ রব শুনা যাইতেছে। জেসমিন চকিত নজর ঘুরাইলো। জামেলা বেগম হাঁসের গোস্তের হাঁড়িখানা মাটিতে রাখিয়া আগাইয়া গেল। 

-কিতাগো আম্মা, বালা আছোনি?

-হ ঝি, বালোই। তরার অত দেরি অইলো কেরে?

-দেরি ত অইব অই। এ পতটা কি সামাইন্য কতা?

আংগুরার পিছু পিছু জামাই আসিলো। জামেলা বেগম জামাইর খোঁজখবর লইলেন। তাহার পিতামাতার খোঁজ লইলেন। জেসমিন আসিয়া পর্যায়ক্রমে আংগুরা এবং তাহার জামাইকে ‘আফা বালা আছুইন্নি’ এবং ‘দুলাবাই বালা আছুইন্নি’ জিজ্ঞেস করিলো। দুজনের সীমিত পরিসরে জবাব দিল ‘হ বালোই’। বাড়ির পোলা-বুড়া সকলেই উল্লাসিত হইয়া আছে। আঙ্গুরা বাড়ির প্রথম কন্যা, তাহার বিবাহ হইয়াছে প্রায় বছর খানেক হইবে। জামাই এখনো নতুন রহিয়াছে। কুটুম্বদের ঘিরিয়া সকলেই গিজগিজ করিতেছে। শুধু দুর্বল দেখাইতেছে জেসমিনকে। তাহার চেহারায় আনন্দ নেই, খুশির আভাস নেই। ঠোঁটে-চিবুকে মৃদু হাসির ভাঁজটুকুও নেই। যেন না পারিতে এখানে দাঁড়াইয়া আছে। কতক্ষনে ঘরে গেলেই বাঁচিবে। 

.

চারিদিকে মৃদ্যু ঝিঁঝি পোকার আওয়াজের রেশ বহিতেছে। ইহার বাহিরে আরেকখানা আওয়াজ কলবে অনুরণন তুলিতেছে । কর্ণকুহরে প্রবেশ না করিয়া তাহা কলবে ধাক্কা লাগিতেছে। প্রশান্তিময় মৃদু এই ধ্বনি মুহূর্তে মুহূর্তে কলব হইতে রক্তবাহিকায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করিয়া সমস্ত শরীরে সঞ্চালিত হইলে নিজেকে পরিশুদ্ধ মনে হইতেছে। জীবনের জঞ্জাল, কলহ, কলঙ্ক ও পাপ ঝরিয়া হালকা অনুভব হইতেছে। জামেলা বেগমের ঘর হইতে বাজিতেছে সেই প্রশান্তির ধ্বনি। মৌলভীসাহেব বড় টানটান করিয়া গাহিতেছেন, তাহার সাথে সুরে সুরে সকলেই গাহিতেছে সকলে…

’ইয়া না…বী সালা..মুআলাইকা

ইয়া রাসু…ল সামা…মুআলাইকা

ইয়া হাবি..ব সালা… মুআলাইকা

***

মোস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম।

সমহে ভজমে হেদায়ত পে লাখো সালাম।’

কি মধুর সে ধ্বনি। কোন ঢাক নেই, ঢোল নেই, বাঁশির লহরি নেই, গায়ক নেই, করতাল-মন্দিরা খঞ্জনি কিছুই বাজিল না— তবু কি সুমধুর ঐকতান! আধ্যাত্মিক তেজ টগবগ করিয়া বহিতেছে সকলের দেহ ব্যাপিয়া। গলার জোর কয়েকগুণ বাড়িয়া গিয়াছে। বেসুরা প্রতিটি কণ্ঠ হইতে আজ সুরের ঝংকার উঠিতেছে— তাল-মাত্রা-লয়ের কোন ব্যত্যয় ঘটিতেছে না। নিজের অজান্তেই ক্ষনে ক্ষনে হুংকারি উঠিতেছে সমবেতগন। 

নেমন্তন্নের রাতের খাবার শেষ করিয়া এই দোয়া দুরুদ পড়া হইতেছিল। যাহাদের নিমন্ত্রন করা হইয়াছিলো সকলেই আসিল, খাইল। জেসমিন আসিলো না— ঘুমাইতেছিল। জামেলা বেগম তাহার জন্যে তরকারি বাটিতে তুলিয়া রাখিয়াছে— ঘরের অতিথী সমাদর শেষ হইলে দিয়া আসিবে। 

হুজুর মোনাজাত ধরিলেন। মহান রবের প্রশংসা করিলেন। ভোজের আয়োজক হিসেবে জামেলা বেগমের স্ততি গাইলেন। মালিকের কাছে ক্ষমার দরখাস্ত করিলেন। নাবীর দিদার চাহিয়া কাঁদিলেন। সকলের জন্যে দোজাহানের মঙ্গল কামনা করিলেন। আঙ্গুরার সংসারের সুখ-শান্তি চাহিলেন। মোনাজাতের মাঝে জানুমোল্লার জামাই আসিয়া হুজুরের কানে কি যেন বলিল। সকলেই কিঞ্চিৎ নজর ঘুরাইয়া তাঁহাদের কানাকানি বুঝিতে চেষ্টা করিল। মোনাজাত চলিতেছে। হুজুর সুযোগ করিয়া জানুমোল্লার জামাইর আরজি মোনাজাতে তুলিলেন— ‘আল্লাহ, তোমার বান্দা আব্দুরব্বাইয়ের মেয়ে জেস্মিনের আল্লাহ শরীল খারাপ, আল্লাহ, তুমি তারে শেফায়ে আজেলা, দায়েমা নসীব করে দাও। তার বিমার সুস্থ করে দাও।’  ইত্যাদি আরজি করিতে শুরু করিলেন খোদার দরবারে। মোনাজাতস্থ সকলে এতক্ষন অবচেতনে, অবনত শিরে হুজুরের সেই সকল কথাবার্তা-ই শুনিতেছিল যাহা না বলিলে মোনাজাতের কাঠামো তৈরি হয় না।  সকলে নিয়মিত স্বরেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ‘আমিন’ বলিতেছিল। জেসমিনের কথা উচ্চারিত হইলে সকলেরই আড়মোড়া ভাঙিল। কেহ থতমত খাইয়া উঠিল। বুঝিল আজকে হয়ত মাবুদের সেই নির্মম খেলা দেখিতে হইবে যাহা তিনি নিতান্তই পরিহাসচ্ছোলে তাহাদেরকে গুটি বানাইয়া ‘অনিয়মের’ সহিত গাঁ জুড়িয়া খেলিতেছেন। আপনার ঘরে যমদূতের আগমন হেতু ভয় সকলকেই চাপিয়া ধরিল। সকলেই জোরে জোরে আমিন বলিতে শুরু করিল। কান্নার ভান ধরিল। এ ভান নিছক কোন ধোঁকা নয়— এই কান্নার ভান যে নামে জাগিল সেই নাম বড়ই মধুর, নামধারী এখন কাহ্হার রূপ ধরিয়াছেন। সকলেই কলবে ভয়-ভক্তির মিশ্রণে গাহিতে লাগিল— 

’জলিলু-জ্বব্বার নাম তোমার আল্লাহু, আল্লাহু

রহিমু-রহমান নাম তোমার আল্লাহু, আল্লাহু’

অন্তঃপুরে যাহারা ছিল সকলেই জেসমিনের হঠাৎ কি হইল বলিয়া কানাঘুষা করিতে লাগিল । হুজুর সকলকে লইয়া খোদার দরবারে একেবারে অসহায় হইয়া বসিলেন। নিজেদেরকে নিঃশর্ত সপিয়া বলিতেছেন—

’তুমি বিনে কারো কাছে আল্লা করিবো রোধন?

তুমি বিনে কে বুঝিবে আমরার মনেরো বেদন?’

হুজুর বজ্রসম কন্ঠারোহন করিলেন, অসহায়ের শেষ সম্বল হারানোর মত কাকুতি মিনতি করিয়া খোদার কাছে দাবি রাখিলেন উন্নত শিরে, কন্ঠে ও সমবেতে— ‘আল্লা তুমি জেসমিনের প্রতি নেক নজর দিও, আল্লাহ। তুমি তারে নেক হায়াত দান করো, আল্লাহ। তুমি তারে কলেরা দিয়া মাইরো না আল্লাহ…’। হুজুর কাঁদিতে শুরু করিলেন। বাকিদেরও বুঝিতে বিলম্ব হইল না জেসমিনের কলেরা হইয়াছে। সকলেই হুজুরের সাথে বিলাপের সহিত ‘আমিন’, ‘আল্লাহ’ বলিতে লাগিলেন

.

আজ আমাবস্যার রাত্রী। বাহিরে একটি হারিকেনের কোনরকম আলোতে বাড়ির কয়েকজন পুরুষলোক জেসমিন মৃত্যুর মুখোমুখোমুখি হইতে চলিল— এমন সংবাদ শুনিয়া উঠানে চেয়ার পাতিয়া বসিল। তাহাদের কেহ বসিয়া ঝিমাইতেছে, কেহ নিজেদের মধ্যে কথা কহিতেছে, কেহ পায়চারি করিতেছে। নিরব মূখে রউফ বসিয়া পাতার বিড়ি টানিতেছিল, তৈয়বের গমের গোছা কে বা কাহার গরুর মাড়াইয়া ব্যাপক ক্ষতিসাধন করিয়াছে তাহা নিয়ে ক্ষোভ গাহিতেছিল, আব্দুল হাকিম কহিতেছিল সে নাকি আজ বেলা এগারোটায় কড়া রোদে কাঠখড় কুড়াইতে দেখিলে তাহাকে ধমকের সহিত— ‘এই পুরি, বাড়িত যা। এই রইদে লাকড়ি টুক্কান লাগতো না’ বলিয়া চান্দপুর বাজারে চলিয়া গিয়াছিল। ওহাব আসিয়া সকলকে দোয়াদরুদ পড়িতে সজাগ করিলে লোকজনের পায়চারি কমিয়া দোয়ার বিড়বিড় ক্রমশ বাড়িল। আংগুরার জামাইও সকলের সহিত আসিয়া বসিল। মৌলভী আসিয়া জিকিরে মাহফিলের এন্তেজাম করিতেছে। বেশি আলো থাকিলে কোরআন খতমের ব্যবস্থা করা হইত। মৌলভী সাহেব যাহাকে দেখিতেছেন তাহাকেই নানাবিধ কাজের ফরমায়েশ করিতেছেন। কাহাকে বলিতেছেন চাটাই আনিতে, কাহাকে বলিতেছেন উঠান ঝাড়ু দিতে। একজনকে বলিয়া একখানা কেরোসিনের বড় বাতিও জোগাড়  করিলেন। চারিধারে আগরবাতির ধোয়া লাগানো হইয়াছে। মানুষের শোরগোল ও বিশৃঙ্খলা কমাইয়া একটা রুহানি পরিবেশ তৈরি করিলেন। সকলকে লইয়া জিকিরের লহরি তুলিলেন। ঘর হয়তেও গুনগুনায়া দোয়াদরুদের আওয়াজ হয়তেছিল। তবে সমস্ত ছাপাইয়াও একজনের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাইতেছিল। এ কান্না কোনকিছুর সহিত তুলনা করিয়া ব্যক্ত করিতে পারিতেছি না। ইহা বেদনার্তের প্রতি সমব্যথীর কান্না নহে। ইহা মৃত্যুপথযাথী সন্তানের সামনে বসিয়া মায়ের কান্না। সন্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা আপন করিয়া লইবার প্রয়াসে মাতা কাঁদিতেছেন— ‘মা, তোমার কিতা অইছে আম্মার কাছে কওনা, কওনা মা’। সন্তানের যে কি হইয়াছে তাহা রউফের বউ ভালো করিয়া জানেন। তাহার পরিনতি কি হইবে তাহাও জানেন। শুধু বিশ্বাস করিতে জানেন না। বিশ্বাস করিতে চাহেন ইহা কোন জীবনঘাতি ব্যাধি নহে, ইহা অল্পতেই সারিবে। শুধু সন্তান মুখ ফুটিয়া একবার ব্যাধির বর্ণনা করিলে মাতা পথ্যের ব্যবস্থা নিমিষেই করিতে পারিবেন। কিন্তু রউফের বউ বিধাতাকে চিনিল না। সকলেই যে তাহার শতরঞ্জের গুটি তাহা বুঝিল না। সেখানে পথ্যের ব্যবস্থা থাকিলেও শত ব্যাধির আবির্ভাবে বিলম্ব হয় না। এই শতরঞ্জের মঞ্চে সৈন্য, সামন্ত কি সেনাপতি কাহাকে কখন কি করিয়া মারিতে হইবে তাহা খোদা ভালো করিয়াই খেলিতে জানেন। আর যদি বিধাতার স্বেচ্ছাচারিতার স্বভাব থাকে তবে গনমৃত্যুর উৎসব বাধিয়া যায়। গ্রাম জুড়িয়া সেই উৎসব চলিতেছে।

জেসমিনের মায়ের চক্ষু হইতে অঝোর ধারায় জলনিকাশ করিতেছেন। জলের ধারা থামিবার কোন আভাস মিলিল না। মায়ের কান্নার আওয়াজ ক্রমশই সকলকে আচ্ছন্ন করিয়া তুলিল। প্রতিবেশীরাও মৃদুমন্দ কাঁদিতেছেন। বাহিরের পুরুষেরা উৎসুকভাবে অন্তঃপুরে তাকাইয়া রহিয়াছেন।  জিকির-আসকারে নাবালেক কয়েকজন ছাড়া কাহারও আর মন নেই। পঁচা-বাসি কিছু খাইয়াছে কিনা কেহ কেহ তাহা নিরিক্ষন করিতে লাগিল। কেহ বসিয়া বনৌজি পথ্য প্রয়োগের পরামর্শ দিতে লাগিল। কেহ আশ্বাস দিল, কেহ বলিল— ‘কত কলেরা হইল জীবনে, কত মরা রোগী বাইচ্চা গেল!’

একসময় সকল কথা থামিয়া গেল। জেসমিনের মায়ের কান্নার ধ্বনি আকাশে ছড়াইয়া পড়িল। অন্ধকারে যমকুলির ডাকের আওয়াজ প্রচ্ছন্ন হইয়া একজন মায়ের কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট হইয়া উঠিল।

.

জামেলা বেগম পরদিন পরিহাস করিতে পারিলেন না। তিনি কেবল জেসমিনের মায়ের বিলাপের সহিত নিজের বেদনার বিবরণ আর আক্ষেপ করিতে পারিলেন। সেই আক্ষেপ আর বেদনার রেশ এখনো প্রজন্মান্তরে বহিয়া চলিতেছে। পয়ত্রিশ বৎসর পর আজ সেই কাহিনী আমাকে শুনাইলেন।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়