fbpx

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হলো দুই দিনব্যাপী ‘গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হলো দুই দিনব্যাপী 'গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা'

গত ২২ ও ২৩শে অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয়েছে ‘গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা’। শনিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে দুই দিনব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন হয় যা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত ছিলো।

২২ তারিখ সকাল সাড়ে ১০টায় মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। এছাড়া অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য (শিক্ষা) এ এস এম মাকসুদ কামাল, সহ–উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ ও কোষাধ্যক্ষ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। তাঁদের সবার বক্তব্যে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো ও শিল্প-একাডেমিয়া সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি উঠে আসে। আলোচনা পর্ব শেষে বেলুন উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করা হয়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আগামী দিনের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে অ্যালামনাইসহ সবার সহযোগিতা থাকা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সব অর্থনৈতিক সংগতি কর্তৃপক্ষের একার নেই। এখানে সরকারেরও দায়িত্ব আছে, শিল্প মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব আছে। সবার প্রতি আহ্বান, আমরা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল হই, সরকারের বাইরেও যেন আমরা তাঁদের প্রতি হাত বাড়াই। আমার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইন্টার্নসহ যেকোনো গবেষণাকাজে সুযোগ করে দেওয়া হবে।”

গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদ্‌যাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মন্তব্য করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।

বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতার চরম ঘাটতি আছে বলে মন্তব্য করেন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কমিউনিটি এনগেজমেন্টের সংস্কৃতি বাংলাদেশে নেই। বেশ কয়েক বছর আগে এ বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। এর ফলে শতবর্ষ উদ্‌যাপনে নানা উদ্যোগ নিতে গিয়ে কমিউনিটি এনেগেজমেন্টের বিষয়টি আমরা যুক্ত করি। প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণাকে উৎসাহ দেওয়া খুব জরুরি। এ ধরনের মেলার মধ্য দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি বা সমাজ কী চায়, সেই নিরীখে আমাদের পাঠ্যসূচি পুনর্গঠিত হবে। এ ধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি গবেষণা-সংস্কৃতি তৈরি হবে।”

দুই দিনব্যাপী গবেষণা ও প্রকাশনা মেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ-ইনস্টিটিউট ও গবেষণাকেন্দ্র তাদের উদ্ভাবন, গবেষণা ও প্রকাশনা তুলে ধরে। মেলায় অনুষদগুলোর জন্য ১০টি, ইনস্টিটিউটগুলোর জন্য ১টি, প্রকাশনা সংস্থার জন্য ১টি এবং গবেষণা কেন্দ্রগুলোর জন্য ১টিসহ মোট ১৩টি প্যাভিলিয়ন তৈরি করা হয়। এছাড়া মেলায় ছিল ১টি কেন্দ্রীয় মঞ্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রকাশনাসহ উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলো এ মেলায় প্রদর্শন ও উপস্থাপন করা হয়। মেলায় ৫৫টি গ্রন্থ, ২৬টি বিশেষ জার্নাল, ২১৬টি গবেষণা প্রকল্প, ৬২৪টি পোস্টার এবং ৮৬টি ফ্লাইয়ার-ব্রুশিয়ার প্রদর্শিত ও উপস্থাপন করা হয়। এই আয়োজনে প্রত্যেক অনুষদের প্যাভিলিয়নের সঙ্গে অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর ১টি করে স্টল এবং ইনস্টিটিউটের প্যাভিলিয়নের সঙ্গে প্রত্যেক ইনস্টিটিউটের ১টি করে স্টল ছিলো।

বাস্তব জীবনে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং শিক্ষার্থীদেরকে পরিসংখ্যান নিয়ে গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে পরিসংখ্যান বিভাগও উক্ত মেলায় অংশগ্রহণ করে। অধ্যাপক মুরশীদা খানম ম্যাডামের পরিচালনায় এবং তিনজন বিভাগীয় শিক্ষক- ড. মোঃ জিল্লুর রহমান সবুজ স্যার, তাসমিয়াহ সাদ সুতপা ম্যাডাম ও বিকাশ পাল স্যারের সহযোগিতায় পরিসংখ্যান বিভাগ দুই দিনব্যাপী এই মেলা সফলভাবে সম্পন্ন করে। এসময় পরিসংখ্যান বিভাগের প্রায় ১১০০ টি ফ্লাইয়ার বিতরণ করা হয় এবং স্টলে পরিসংখ্যান বিভাগকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়, যার মাধ্যমে এই বিভাগের পরিচিতি, ফ্যাকাল্টিগণ ও উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার সাথে সকলকে পরিচয় করানো হয়। 

উক্ত মেলায় পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক কর্তৃক প্রকাশিত ২০টিরও অধিক বই প্রদর্শিত হয়, যার মধ্যে বাংলাদেশে পরিসংখ্যানের জনক অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন স্যারের লেখা দুইটি বই ছিল অন্যতম। বিভাগীয় বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রকাশিত ২৬টি আর্টিকেল প্রদর্শিত হয়। উপস্থাপন করা হয় ৮টি পোস্টার।

গবেষণা মেলা প্রসঙ্গে পরিসংখ্যান বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, “মেলায় পরিসংখ্যান বিভাগের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের লেখা বইসমূহ এবং গবেষণাপত্রগুলো দেখে নিজ বিভাগের গবেষণাক্ষেত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছি। সেইসাথে মেলায় অন্যান্য বিভাগের গবেষণাধর্মী কাজের সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া গিয়েছে। সকল ডিপার্টমেন্ট-এর শিক্ষকরা নিজনিজ আইডিয়া সকলের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছেন, যা এই মেলা আয়োজিত না হলে দেখার সুযোগ হতো না।”

মূলত প্রথমবারের মতো গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা আয়োজিত হওয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থীদের মাঝে উচ্ছাস ও উদ্দীপনা কাজ করেছে। অন্য একজন শিক্ষার্থীর মতে, “রিসার্চ ফেয়ার এই প্রথম হচ্ছে বলে শুরু থেকেই অনেক আগ্রহী ছিলাম। মেলায় গিয়ে কোন বিভাগে কী নিয়ে কাজ হয় তা দেখতে পেরেছি। রিসার্চ পেপারের অনেক কিছুই বুঝি নি তবে বোঝার চেষ্টা করেছি প্রথমবারের মতো। এটা না হলে হয়তো সে চেষ্টাটুকুও করা হতো না। এধরনের আয়োজন প্রতিবছর হলে অবশ্যই গবেষণার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে।”

গবেষণা-প্রকাশনা মেলার সমাপনী দিন, রোববার বিকালে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান স্যার জানান, নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রতিবছর গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, “আগামী এক দুই মাসের মধ্যেই আমরা একটি নীতিমালা প্রণয়ন করব, যাতে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘ক্যালেন্ডার ইভেন্টে’ পরিণত হয়। প্রতি বছরই কোনো না কোনো ইনস্টিটিউট বা অনুষদ এ কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।

সমাপনী অনুষ্ঠানে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, “পৃথিবীতে সর্বপ্রথম শক্তিশালী কামান তৈরি হয় এ ভারতবর্ষে। চীন থেকে গান পাউডার এনে, ইউরোপ থেকে লোহা-লঙ্কর ও ইস্পাত এনে। সে সময় বলা হয়েছিল, এটা তৈরি করো, না হয় গর্দান যাবে। আমাদের এই মেলাটা কিন্তু সেটাই। এটার ফরমেট খালি আলাদা। আমরা এই মেলা আয়োজন করেছি এ কারণে যে, আপনারা গবেষণা ও প্রকাশনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমরা আধুনিক কালে তো বলতে পারব না যে, গর্দান যাবে। আমাদের সম্মান যাতে বাড়ে, আপনারা সেই পথে এগিয়ে যাবেন।”

জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এধরনের গবেষণা মেলা উৎসাহ যোগাবে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।

রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকারের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।

মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে কবিতা, রচনা ও ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা এবং শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রত্যেক জার্নালের বিশেষ সংখ্যার শ্রেষ্ঠ আর্টিকেল লেখককে সনদ, ক্রেস্ট ও প্রাইজ মানি দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক অনুষদ, ইনস্টিটিউট ও সেন্টার কর্তৃক উপস্থাপিত পোস্টারের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পোস্টার উপস্থাপনকারীকেও পুরস্কার দেওয়া হয়।

প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গবেষণা ও প্রকাশনা মেলা আয়োজিত হওয়ার ফলে এ বিষয়ে কারও কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। মেলায় স্টল কিভাবে সাজানো হবে, প্রদর্শনী কিভাবে করা হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শঙ্কা থাকা স্বত্ত্বেও অধ্যাপক মুরশীদা খানম ম্যাডামের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিসংখ্যান বিভাগ সুচারুরূপে দুই দিনব্যাপী মেলার আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। বিভাগীয় কমিটির শিক্ষকসহ সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শূন্য থেকে শুরু হওয়া মেলার সকল কার্যক্রম সুসম্পন্ন হয়।

প্রতিবেদক:

মোঃ সাবিত আল-সাবা রিয়ন এবং উম্মে সালমা, পরিসংখ্যান বিভাগ, সেশন: ২০১৯-২০।