আমার কাছে শীতকাল এতো আবেগ-আবেশের মনে হয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আমার অবচেতনে শীতকাল মানেই অলস সময়, সীমাহীন নিস্তব্ধতা আর একাডেমিক প্রেশার থেকে মুক্তি। ছোটবেলায় এই সময়টাতে বার্ষিক পরীক্ষা (ক্ষেত্রবিশেষে শেষ) হত। অর্ধমাসব্যাপী অক্লান্ত সে পরীক্ষা শেষ হওয়ার আনন্দ ছিল নিরেট এবং বিশুদ্ধ। আমার গল্পের বই পড়ার মতো আভিজাত্যপূর্ণ অভ্যাসটার শুরু এই সময়টাতেই। পাঞ্জেরীর সচিত্র কিশোর সিরিজের বইগুলো কিনে সারা বছরই লুকিয়ে রাখতাম, মাঝে মাঝে স্পর্ধা দেখিয়ে একাডেমিক বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে পড়তাম, যাতে মা দেখে না ফেলে। একমাত্র এই সময়টাতেই গল্পের বইগুলো আমার টেবিলে সগৌরবে শোভা পেত। একেকটা রাত একেক লেখকের সাথে পাড়ি জমাতাম কখনও পৃথিবীর কেন্দ্রে, কখনও মঙ্গলের বুকে। প্রতি সন্ধ্যায় আমার ছোট্ট শরীরটা বিছানা কম্বলের উষ্ণ ওমে সিক্ত হতো, আর মস্তিষ্কের অগণিত নিউরণ অনুরণিত হয়ে আমাকে পৌঁছে দিত উত্তাল আটলান্টিকে হারিয়ে যাওয়া কোনো জাহাজ থেকে পূর্ব আফ্রিকার কোনো এক নিস্তব্ধ গ্রামে। কি উদ্যম আর রোমাঞ্চ ভরা ছিল সেই ভ্রমণ!
আমাদের ছোট্ট বন্ধুসমাজে সময়ে সময়ে ছোটখাটো কিছু হুজুগ পড়ে যেত। পোকেমন কার্ড, স্টিকার, বেব্লেইড, পান্ডা, সাইকেল এমনকি রুবিক্স কিউব (কিউব কিনেই আমরা নিজেদের কিউবার ভাবতাম) নিয়ে ইনফিরিওরিটি ও সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতাম খুব। এগুলো তখন আমাদের কাছে নিছক খেলনা ছিলো না, নিজের আইডেন্টিটির অংশ ছিলো এগুলো। শীতকালের এই অলস সময়টা এলেই নিজের আইডেন্টিটি প্রদর্শনের হুজুগ পড়ে যেত। সেসময় একটা বেব্লেইড ম্যাচে গো-হারা হেরে এসে সারাদিন মুখ কালো করে ছিলাম। কি অসীম আনন্দ আর তীক্ষ্ণ বেদনায় (তখনকার বেদনা এখন আবার আনন্দের উৎপাদক, কি অদ্ভুত!) জর্জরিত হতাম সেসময়! লেখাটা শীতকাল কেন্দ্রিক না হয়ে স্মৃতি রোমন্থন বিষয়ক হয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য অনেকটা সেটাই। স্মৃতির একটা বিশাল আনন্দের অংশের ধারক ও বাহকের কৃতিত্ব যে এই শীতকালের তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বলা।
তারপর একদিন বড় (বেশি বড় না, হালকা বড়) হলাম। এখন শীতকাল বলতে আবছা সকালে চোখ মুছতে মুছতে ভার্সিটির ক্লাসের জন্য বের হওয়া আর খুব বড়জোর হলে লালচে লাইট জ্বালিয়ে চারজন মিলে ব্যাডমিন্টন খেলা ছাড়া আর কিছুই চোখে ভাসে না।
How time does fly!
- This author does not have any more posts.