fbpx

আজ বিশেষ দিন

১.

আজ বিশেষ দিন, ১৪ ই ফেব্রুয়ারী। নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবে। ঘন্টার কাঁটা যতই আগাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের হৃদস্পন্দন ততই বেড়ে চলছে। তবে মজার ব্যাপার হল, শিক্ষার্থীদের থেকে তাদের বাবা-মা এর হৃদস্পন্দন বেশি হারে বাড়ছে। হৃদস্পন্দন বাড়াটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক মানে সরল রৈখিক হতে পারে। কিন্তু এই কয়েক বছর যাবত হয়তো সূচকীয় হারে বাড়ছে।

নেয়ামুল জানে সে পাশ করবে না। তাই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় মিনিট দশের মতো দাঁড়িয়ে, আবার রুমে ফেরত চলে আসে। তার রুমে সে আর মহুয়া ছাড়া অন্য কেউ নাই। ছোট থেকেই মহুয়ার সাথে তার অন্যরকম ভাব। নেয়ামুল অপলক দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মহুয়া এই অপলক দৃষ্টির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। তাই সেও নেয়ামুলের দিকে তাকিয়ে আছে। নেয়ামুল মহুয়ার সেই বিস্মিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,  ‘মহুয়া, আজ তো আমি চলে যাব। আমি চলে যাওয়ার পর মোটেও ভেঙ্গে পড়বি না। কোনোরকম কান্নাকাটিও করবি না। মনে থাকবে? তোকে তো আগেও অনেক বার বলেছি, যেটা যতদ্রুত শুরু হয় সেটা ততদ্রুতই শেষ হয়। তুই তো আমার বন্ধু, আমাকে চিরদিন মনে রাখতে চাস না?’ মহুয়া কোনো শব্দ করছে না, শুধু তাকিয়ে আছে। ‘আর যদি কখনো আমার কথা মনে পড়ে, তাহলে মতিন কাকার কাছে গিয়ে বসিস। খুবই সরল মানুষ। যারা সরল, তারা সরল ভাবেই ভালোবাসে। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। এটা আমি অনুভব করতে পারি। পৃথিবীর সবকিছু প্রমান বা যুক্তি দিয়ে হয় না। কিছু জিনিস অনুভব করতে হয়। তার মধ্যে একটা হল, ভালোবাসা। ভালোবাসা হলো আলোর মতো; যে দৃষ্টিকে প্রসারিত করে আবার সরল পথেও চলে। ‘ এটুকু বলেই সে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

আবার কিছুক্ষন পরই ফেরত চলে আসল। বেশিক্ষন না। বিদ্যুৎ চমকানো দেখতে পাওয়া আর বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পাওয়ার মাঝে যতটুকু সময়, ততটুকুর মতো হবে। এসে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল। হাতে একটা শপিং ব্যাগ আছে। ব্যাগ থেকে কিছু অদ্ভুদ জিনিস পত্র বের করছে আর মহুয়াকে বলছে, ‘যদিওবা আমি ওতো সরল মানুষকে দেখতে পারি না। তুইই বল, ওতো সরল হলে হয়? ক্রিয়েটিভ চিন্তা বা কাজ না করলে হয়? সমাজে তো অন্তত একটা অবস্থান তৈরি করতে হয়। আর তা না হলে বেঁচে থাকায় কোনো মজা আছে বল?’

মহুয়া সোফা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে বসল। জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। বাস, ট্রাক, রিক্সা ছোট বড় সব রকমের যান চলছে। কিন্তু কোনো ধরনের শব্দ আসছে না। কারণ জানালাটা কাঁচের তৈরি। মাধ্যম ছাড়া তো শব্দ একপাশ থেকে অন্যপাশে আসতে পারে না। যেমন দুজনের মাঝে যদি সম্মান প্রদর্শন নামক মাধ্যম না থাকে, তবে একদিকের মানুষের আওয়াজ অপরদিকে যায় না। যেমনটা তর্কের বেলায় দেখা যায়।

এবার নেয়ামুলও জানালার দিকে উঠে এসে মহুয়ার পাশে দাঁড়াল।  ‘গাড়ি দেখছিস? এদের দেখে কি আর হবে? এরা যেমন লোহা-ইস্পাতের তৈরি, এদের চালকদের হৃদয়ও তেমন। এই সমাজের মানুষগুলোর মতো গাড়িগুলোরও একই হাল। প্রতিটা গাড়ির একটাই উদ্দেশ্য, সামনে চলতে হবে। কিন্তু কতটুকু সামনে সেটা স্থির নেই। যদি থাকতো তাহলে কি আমার বন্ধু রাসেদকে ওভাবে পিষে যেতে পারতো? কখনোই না। শোন, তুইও কখনো রাস্তায় বের হবি না। কোনদিন না তোকেই পিষে যাবে! শরীরের উপর দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ সাত টন লেখা ট্রাক চলে গেলে তখন কেমন অনুভূতি তা আমার জানা নেই। ব্যপার না, আজ তো আমি ঐ জগতে যাব। নতুন পরিবেশ। তবুও দুই এক দিনের মাথায় হয়তো রাসেদের সাথে দেখা হবে। তখন জিগ্গেস করে নিব, ট্রাক চাপার অনুভূতি কেমন। ‘  

দরজার বাহির থেকে মতিন মিয়ার আওয়াজ, ‘নেয়ামুল তোমার টেবিলে দুধ রাখা আছে, খেয়ে নিও। আমি বড় সাহেবের সাথে মার্কেটে যাচ্ছি, অনেক কেনা কাটা বাকি। ‘ নেয়ামুল বলল, ‘ চলে যাওয়া আগে পৃথিবীর সম্পদ নষ্ট করতে চাই না। নে, তুই দুধটুকু খেয়ে নে। কী, খাবি না? এরকম হলে হবে? আমি যখন থাকবো না তখন কি করবি? আচ্ছা এই আমি একটু খেয়ে দিচ্ছি। ‘

নেয়ামুল দুধের পাত্রটার উপর থেকে সোয়া কেজি ওজনের ঢাকনা সরিয়ে টেবিলের উপর রাখল। এত ওজনের ঢাকনা দেওয়া হয়েছে জাফর সাহেবের আদেশে। তার কথা হল, ‘বিড়ালের অংশ বিড়াল খাবে, অতিরিক্ত যেন না খায়। সব জায়গায় সাম্য চাই। ‘ তার মতে, সাম্য আর সমান এক জিনিস না। ‘সাম্য’কে যদি ন্যায্য অধিকারের সার্বিক সেট বলি, তবে ‘সমান’ হল ঐ সার্বিক সেটের একটা উপসেট মাত্র। যেখানে প্রতিটি উপদান সদৃশ্য। কিন্তু সাম্য নামক ‘সার্বিক সেটে’র প্রতিটি উপদান একইরকম হোক বা না হোক, তবু তাদের মধ্যে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যাবে।

নেয়ামুল দুধের পাত্র থেকে কিছুটা পরিমান পান করল। কিছুটা পরিমান পান করছে বললেও ভুল হবে। বলা উচিত, সে ঠোঁট ভিজিয়েছে। যাইহোক, বাকিটা পাত্রসমেত টেবিলের উপর রেখে দিল। মহুয়া ভদ্রতার ধার না ধরেই, টিপ-টিপ করে গিয়ে দুধটুকু খেয়ে নিল। সে এই সমাজে থেকে এইটুকু তো বুঝতে পারছে, ভদ্রতা দিয়ে পেটের ক্ষুধা মিটবে না। যদিও বা এভাবে দুধ খাওয়াটা তার স্বভাব; ভদ্রতা বা অভদ্রতার কোনো ব্যাপার না। দুধটুকু খেয়ে আবার নেয়ামুলের পাশে এসে বসল। ওমনি নেয়ামুল তাকে কোলে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মহুয়া নেয়ামুলের প্রতিবিম্বের উপর হাত বুলচ্ছে আর নেয়ামুল মিটমিট করে হাসছে। দুজনের মুখেই দুধ লেগে আছে। আসলে দুধ খেতে যতটা মজা তার থেকেও মজার ব্যাপার হচ্ছে দুধ মাখা ঠোঁট দেখতে। এমন সময় মহুয়া ‘মেও’ বলে নেয়ামুলের কোল থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে পড়ল। ফের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

২.

মতিন মিয়া কোথা থেকে যেন একটা রিক্সা নিয়া এসে বলল, ‘ স্যার, সোয়া নয়টা বাজে। এগারো টার আগে বাসায় ফিরতে হবে। উঠুন, জলদি উঠুন। ‘ জাফর সাহেবের নিকট রিক্সা হলো সব থেকে বিরক্তিকর যান। এর দুটো কারণ। একটা হল, রিক্সায় উঠলেই অজানা কারণে তার শরীর ঘামতে থাকে। আর একটা কারণ হল, ঢাকার শহরের জ্যাম আর রিক্সার গতির জন্য গন্তব্যে পৌছতে বেশি সময় ব্যয় হয়। জাফর সাহেব খুব হিসেবি মানুষ। সে সব সময় জে আই টি রুল অনুসরন করে। জে আই টি মানে হল ‘জাস্ট ইন টাইম’। তার মতে, ” যে দেশের জনগনের নিকট সময় এবং চরিত্র যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সে দেশ তত বেশি উন্নত। ” যে ব্যাক্তির কাছে কেবল সময়টা গুরুত্বপূর্ন তাকে উন্নতমানের প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করে। আর যার কাছে কেবল চরিত্রটা গুরুত্বপূর্ণ তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী অর্থাৎ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে। আর যে ব্যাক্তির কাছে সময় এবং চরিত্র উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ তাকে উন্নত মানুষ বলে মনে করে।

জাফর সাহেবকে ঘামতে দেখে মতিন মিয়া বলে উঠল, ‘সরি, স্যার। কাল রাতে অফিস থেকে গাড়িটা বাসায় এনে রাখা উচিত ছিল। ভুল করে ফেললাম। ‘ জাফর সাহব গরমে অস্থির হয়ে আছে। শীতকাল, তবুও শরীর ঘামছে। জাফর সাহেব বলল, ‘ মতিন ভাই, আপনাকে কতবারর বলেছি যে, আমাকে ‘স্যার’ না, ‘ভাই’ বলে ডাকবেন?’ ‘ সরি, জাফর ভাই। আর ভুল হবে না। ‘ মতিন মিয়া এই বাড়িতে আসার পর থেকে শুদ্ধ বাংলা ভালোই বলতে শিখেছে। তবে হ্যাঁ, ভিনদেশী শব্দ শিখছে কেবল দুটো। ‘সরি’ এবং ‘স্যার’।  শিক্ষক হল, জাফর সাহেবের পাতানো শালা। মোঃ সাঈদ হোসেন। দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

মতিন মিয়া আগ্রহের সাথে বলল, ‘ জাফর ভাই, আমার একটা বিষয় জানার আছে। বলব? ‘ ‘ বলেন, কি বিষয়?’ ‘ ভাবিকে ঘরে আনার পিছনে নাকি এই রিক্সারই অবদান সব থেকে বেশি?’ ‘হ্যাঁ। তবে আপনাকে কে বলছে?’ ‘ শুনছি একজনের থেকে, , । ‘ ‘এ কাজ সাঈদ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। শালাটা আগে কতই না চালাক ছিল। ঐ গনরুমে ক’মাস থাকার পর আর ল্যাবের সব এক্সপেরিমিন্ট মুখস্থ করতে করতে, আজ ওর এই হাল। স্বাভাবিক কাজ, কথা সব ভুলে যায়। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ছেলেটা এক্সপেরিমেন্টের শিট মোটেও ভুলে না। সব গরগর করে বলে দিতে পারে। এজন্যই ক্লাসে টপ করে। ‘ ‘ বিয়ে সাদি করলে ঠিক হয়ে যাবে। এখন ভালো রেজাল্ট করলেই হয়। ‘ ‘ তবে মতিন ভাই, বাংলাদেশের স্টুডেন্টদের বিশেষ একটা গুণ আছে। ওরা এত এত চাপের পরেও বাকি আট দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক চলাচলের চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয় না। বাহিরের দেশের স্টুডেন্ট হলে হয়তো, সাইকিয়াট্রিস্টদেরকেই সাইকো বানিয়ে ফেলত। ‘ ‘ভাই, আপনি বেচারা সাঈদকে ছাড়ুন, আর ওসব কঠিন কি কি শব্দ বলছেন সব মাথার উপর দিয়ে গেছে। বিয়ের ঘটনাটা বলুন।  ছোট করে বললেই হবে। ‘ ‘ আজ নয়, অন্য কোনো দিন। দেখবনে ভাই, আজ এমনেতেই ক্লান্ত। আবার রিক্সার ঝাঁকুনি। ‘

 জাফর সাহেব আর মতিন মিয়া বিশেষ কোনো শপিং করার জন্য মার্কেটে যাচ্ছে না। সব কেনাকাটা আগেই শেষ। এখন যাচ্ছে কেক আর বেলুন কিনতে। জন্ম দিনের কেক না। আজ বিশেষ দিন। এই প্রথম নেয়ামুল নিজের দক্ষতায় পাশ করবে। এর আগে যত পরীক্ষা দিয়েছে, সবগুলোতে ওর বন্ধু রাসেদ সাহায্য করেছে। যাইহোক, ছেলে প্রথমবারের মতো পাশ করবে। এই উপলক্ষে জাফর সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছে , আজ কেক কাটা হবে। কেকের উপর লিখা থাকবে: “Happy passed day”। আর কেক কাটার সময়ের গান :”Happy pass day. Happy pass day dear Niyamul.” গ্রামার নিয়ে জাফর সাহবের কোনো মাথা ব্যথা নাই। তার মতে, মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলে এবং অপর পক্ষ বুঝতে পারলেই হলো।

রিক্সায় বসে জাফর সাহেব ঝিমাচ্ছে। হেলেদুলে পরছে। ক্লান্ত শরীর। রাতে ঘুম হয় নি। ঘুমে এখন চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মতিন মিয়া বলল, ‘স্যার, আমার কাঁধে মাথা রাখতে পারেন। আপনার মনে হয় অনেক ঘুম পাচ্ছে। ‘ জাফর সাহেব কোনো মতে ‘হ্যাঁ’ বলেই চোখের পাতা বন্ধ করে নিল।

নেয়ামুলের হাতে একটা ছুড়ি। সামনে কেক রাখা। সাথে পরিবারের সবাই। সবার দৃষ্টি ঘড়ির কাঁটার দিকে। কখন বারোটা বাজবে! বারোটা বাজলেই আনুষ্ঠানিক ভাবে নিম্ন মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করবেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। একটু ভুল বলে ফেলছি। সবার দৃষ্টি ঘড়ির কাঁটার দিকে না। একজন ব্যাতিক্রম। ময়না। ময়না তাকিয়ে আছে সাঈদের দিকে। ঠিক বাচ্চারা যেমন অবাক হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু মেয়েদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, তারা যদি কোনো ছেলেকে দেখে তবে সেটা কোনো ছেলের টের পাবার কথা না। কারন মেয়েরা আড় চোখেও ভালো দেখতে পারে। সোজা সামনের দিকে তাকিয়েও সমকোনের সব দৃশ্য দেখে নিতে পারে। আবার সরল কোনেও দেখতে পারে; বাহ্যিক চোখে দেখতে পারে না, কিন্তু অনুভব করতে পারে। ময়না আজ এসব গুণকে আঁচলে বেঁধে রেখে সাঈদের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজ কেন জানি সাঈদের চেহারায় কোনো সূত্র কিংবা এক্সপেরিমেন্ট মুখস্ত করার ভাব দেখা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানের জটিলতা বিহীন একটা সরল মুখ। দেখলেই মায়া লাগে। বারোটা বেজে গেল! সবার মুখে একই গান- ‘Happy pass day. Happy pass day dear Niyamul.’ গানের শব্দ শুনতেই ময়নার হুশ ফিরলো। সাঈদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। দৃষ্টির লেশ কাটতেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসল -‘ Happy birthday. Happy birthday dear Niyamul.”

জাফর সাহেব আগেই ধারনা করছে যে, ময়না কিছু একটা ভুল করবে।  ভুলটা করেই ফেলল। ময়নার এই গান শুনে জাফর সাহেবের মুখ থেকে একটা শক্ত আওয়াজ বের হয়ে গেল। মতিন মিয়া বলে উঠল, ‘জাফর ভাই কিছু বললেন? রাস্তায় জ্যাম, এখনো অনেকটা পথ বাকি। আপনি চাইলে আবার ঘুমাতে পারেন। ‘

৩.

 খাটের এক অংশ জুড়ে বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট আসবাবপত্র ছড়িয়ে আছে। এসব নেয়ামুল করেছে। সবগুলো শপিং ব্যাগে ছিল। খাটের উপর নেয়ামুল আর মহুয়া বসা। নেয়ামুলের হাতে একটা সোনালী রঙের কলম। এরপর নেয়ামুল নিজের হাত থেকে কলমটা মহুয়ার পাশে রাখল। আর বলল, ‘আমার মৃত্যুর পর ঠিক ঠিক যেন এটাকে মতিন কাকার কাছে পৌছে দেওয়া হয়। এই নে, রাখ।’ মহুয়া কলমটাকে মুখে নিয়ে সারা বিছানা জুড়ে ছুটাছুটি করছে। কখনো বা চার হাত পা নাড়িয়ে কলমটা দিয়ে দুষ্টমি করছে। তবে হঠাৎ কিছুক্ষন পর আবার শান্ত হয়ে গেল। ঠিক যেন শহরের সিএনজিগুলোর মতো। খুব গতিতে এঁকে বেঁকে চলে। আর হঠাৎ করে হার্ড ব্রেক কষে। সিএনজিগুলোর হার্ড ব্রেক কষার তো কারন আছে। কিন্তু মহুয়ার এরকম হার্ড ব্রেক কষার কারন খুঁজে পাচ্ছে না নেয়ামুল। ‘মুড সুইয়িং? সেটা তো মানুষের হয়, বিশেষ করে মেয়ে মানুষের। কিছু কিছু মেয়ের এত দ্রুত মুড সুইয়িং হয় যে, গিরগিটির রংও তত দ্রুত বদলায় না। মহুয়ারও কি মুড সুইয়িং হচ্ছে? না। মহুয়া তো বিড়াল। বিড়ালের আবার মুড সুইয়িং কিসের?’

এই বলে নেয়ামুল খাটের উপর একটা টুল নিয়ে আসল। টুলে দাঁড়িয়ে ফ্যানের সাথে দড়ি বেধে নিল। এমন সময় রুমের বাহির থেকে নেয়ামুলের দাদীর আওয়াজ, ‘নেয়ামুল। কিরে দাদু, তুই কি কারাবন্দী হয়ে আছোস? অ্যাহোনও বাইর হও না ক্যা? বিয়ার আগেই এইরম ঘরবন্দী থাইকলে বিয়ার পর কী করবি? যা, গোসলে যা। ‘ নেয়ামুল দ্রুত করে টুল থেকে নেমে খাটের উপর বসল। নেয়ামুল নিশ্চিত যে, তার দাদী এখন পান খাওয়া লাল টুকটুক ঠোঁটে হাসতেছে। তার দাদী অধিকাংশ সময়ই বিয়ে নিয়ে কথা বলে। আর বিয়ের আলোচনা করেই কুটকুট করে হাসতে থাকে। গালের ত্বক ঢিলা হয়ে গেছে। তবে ফর্সা মুখে লাল ঠোঁট সমেত হাসলে এখনো অনেক সুন্দর দেখায়।

নেয়ামুল বলল, ‘মহুয়া, মন খারাপ হলে দাদীর কাছেও যেতে পারিস। বয়স হয়ে গেলে মানুষ বাচ্চাদের মতো আচরন করে। খুবই সরল এবং সচ্ছ আচরন।’

মহুয়ার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। তবে মনের অবস্থা কেমন, সেটা বলা মুশকিল। নেয়ামুল বলল, ‘শোন, সেদিন দাদীর সাথে কথা বলছিলাম। তখন খুব হাসছিল। আমি চলে গেলে কার সাথে হাসবে? তুই তাকে সময় দিস। ‘ মহুয়া ‘মেও’ বলে কোল থেকে নেমে নেয়ামুলের গায়ের সাথে গা লাগিয়ে পাশে বসে পড়ল। নেয়ামুল বলল, ‘আচ্ছা সেদিন কেন দাদী ওরকম ভাবে হাসছিল, শুনবি না?’ মহুয়া শান্ত হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু বলছে না। নেয়ামুল বলল

-আচ্ছা, এভাবেই বসে শোন। মাথা তুলতে হবে না। সেদিন দুপুরে খাবার খাওয়ার পর দাদীর রুমে গেলাম।  দাদী চৌকির উপর বসে পান খাচ্ছে। আবদার করলাম, আমিও পান খাবো। পান মুখে দিয়ে দাদীকে বললাম, ‘দাদী তুমি হাসলে অনেক সুন্দর দেখায়। তবু মা কেন তোমাকে কম হাসতে বলে জানি না। ‘এটা শুনেই দাদী আবার হেসে দিল। হেসে বলল, ‘ আমি দ কয়দিন পর মইরা যাম। তহোন কার আইস দেকবি? তোরে একটা বুদ্দি দেই। বিয়া করলে আমার মতন ধলা দেইক্কা একটা বউ আনবি। আইস দেকতোন মন কইলে, তারে আইসতোন কবি। পান না খাইলেও দোষ নাই, ঠোডে রং লাগাইয়া দিবি। ‘ এতটুকু বলেই হেসে দিয়েছিল। আমি বললাম, ‘ না বুড়ি। তোমার মতো বউ পাওয়া সম্ভব না। তবে আমার বউ হবে চাঁদের মতো সুন্দর। গায়ের রং বেশি কালোও না, আবার বেশি ফর্সাও না। ‘ দাদী বলল, ‘ কি কস? ধলা না অইলে চানদের মতন সুন্দর অইবো ক্যামোন কইরা?’ আমি বললাম, ‘ গায়ের রং হয়তো বেশি ফর্সা হবে না। হালকা কালো, হালকা ফর্সা। তবে চরিত্র হবে উজ্জল ফর্সা। যেন একটা পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের গায়ে যেমন একটু হালকা অন্ধকার থাকে, তেমনি তার সমস্ত জীবন জুড়ে রূপের অংশটুকু চাঁদের ঐ হালকা অন্ধকার অংশের মতো। আর চাঁদের বাকি সমস্ত অংশ যেমন উজ্জল থাকে, তেমনি তার চরিত্রের অংশটাও উজ্জল থাকবে। ‘ এই সময় দাদীর হাসার কথা। কিন্তু কোনো শব্দ পাচ্ছি না। দাদীর দিকে ফিরে দেখি, সে ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘড়িতে ঠিক দুইটা। দুপুরের পর ঘুমানো, দাদীর বিয়ের আগের অভ্যাস।

এটুকু বলে নেয়ামুল খাটের উপর থেকে টুলটা নামিয়ে ফেলল। ফ্যান খুবই নিচে। তাই টুলের যে উচ্চতা আছে তাতে ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়া কঠিন। দরকার একটু কম উচ্চতার টুল বা চেয়ার। তাই সে জানালার পাশ থেকে চেয়ার এনে খাটের উপর রাখল। এবার সে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে আছে । আর মহুয়ার দিকে ফিরে বলল, ‘ আর কান্না করবি না কিন্তু। আর সরল চোখে আমার দিকে তাকাবি না। মায়াভরা কন্ঠে আর কোনো আওয়াজ করবি না। যদি করো, তাহলে আমি চলে যেতে পারবো না। দয়া করে একটু শান্ত থাকিস!’ নেয়ামুল লুপ হাতে নিয়েও বারবার এভাবে ফিরে আসার জন্য মহুয়ার সরলতাই দায়ী। পৃথিবীর কোনো মানুষ আত্মহত্যা বা এ জাতীয় কোনো কাজ করতে পারবে না; যদি তার চারপাশে ইতিবাচক চিন্তা, ইতিবাচক বুলি এবং ইতিবাচক মানুষ বিরাজ করে। এ যুগে এত এত আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হলো, আমাদের চারপাশে নেতিবাচক রশ্মি, নেতিবাচক চিন্তা, নেতিবাচক কথাবার্তা এবং নেতিবাচক লোকজনে ভরে গেছে।

নেয়ামুল এবার লুপটা গলায় প্রবেশ করাবে। কিন্তু নেয়ামুল পারতেছে না। উচ্চতা কম। অল্প কিছু উচ্চতা বাড়লে ভালো হত। এমন সময় নেয়ামুলের চোখ পড়লো ঘড়ির কাঁটার দিকে। এখন বাজে এগারোটা তেইশ।  এখনই ফাঁস না দিলে আর ফাঁস দেওয়া হবে না। তাই উচ্চতা বাড়ানোর জন্য হাতে কাছে কিছু না পেয়ে, টেবিল থেকে দুটো বই নিয়ে আসল। চেয়ারের উপর বই,  তার উপর নেয়ামুল দাঁড়িয়েছে। এবার পারফেক্ট উচ্চতা। ফাঁস দিতে কোনো সমস্যা হবে না। হাতে লুপ নিয়ে ধীরে ধীরে গলায় প্রবেশ করাচ্ছে। আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। চব্বিশ বাজলেই গলায় লুপ প্রবেশ করিয়ে দিবে। আর ঠিক পঁচিশের সময় পায়ের নিচ থেকে বই সরিয়ে দিবে, সাথে সাথে গলায় মৃত্যু ফাঁস আটকে যাবে। চব্বিশ বাজতে আর সাত সেকেন্ড বাকি। নেয়ামুল গননা করতেছে আর দড়ির লুপকে গলায় ক্রমে প্রবেশ করাচ্ছে। সাত। ছয়। পাঁচ। চার। আর কয়েকটা সেকেন্ড বাকি। কেন জানি নেয়ামুলের হাত পা কাঁপছে। মৃত্যুর ভয়? না।  তাহলে আর কী হতে পারে? এমন সময় নেয়ামুল অনুভব করল, তার মাথাও ঘুড়ছে। কিছু বুঝতে না বুঝতেই নেয়ামুল চেয়ার থেকে পরে গেল। উপর থেকে পরতে পরতে তার মনে পড়ছে, সে আজ নিয়ে মোট দুই দিন প্রায় না খেয়েই আছে। খাটের উপর পরেই অজ্ঞান হয়ে গেল। আর মহুয়া? সে খাট থেকে এক বিশাল বড় লাফ।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়