fbpx

দ্য স্পাইডার

(১)

দৈনিক ‘ঢাকা মিরর’-এ প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনটি বেশ কয়েকবার পড়লাম: “হাউজ পেইন্টার” দরকার হলে আপনার “ব্যক্তিগত নাম্বার” থেকে ০১৯১৫১৬৪৮৮২ নাম্বারে মেসেজ পাঠান।

আমার ধারণা, এটা “কানা বারেক” এর দেয়া বিজ্ঞাপন। লোকটা একজন ভাড়াটে খুনি। যদি সাধারণ কোনো রঙ মিস্ত্রি বিজ্ঞাপন দিতো, তাহলে “হাউজ পেইন্টার” আর “ব্যক্তিগত নাম্বার” লেখার জন্য কোটেশন মার্ক ব্যবহার করতো না।

এখানে হয়তো মাফিয়াদের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। “হাউজ পেইন্টার” মানে কিলার বা হিটম্যান – মানুষের রক্তে যারা ঘর ‘পেইন্ট’ করে। কানা বারেক (যদি বিজ্ঞাপনদাতা সত্যিই কানা বারেক হয়ে থাকে) অনেক খোঁজখবর রাখে।

“ব্যক্তিগত নাম্বার” বলতে নিশ্চয়ই বেনামি সিমকার্ড বোঝানো হয়েছে। যাতে পুলিশের তদন্ত হলেও ক্লায়েন্টের পরিচয় গোপন থাকে।

বিজ্ঞাপনে কানা বারেকের একটি মোবাইল নাম্বার দেয়া হয়েছে। নাম্বারটি পুলিশের হাতেও পড়তে পারে, এটা না বোঝার মতো বোকা নিশ্চয়ই সে নয়। কেউ মেসেজ দিলে কানা বারেক নিশ্চয়ই যাচাই বাছাই করে তার সাথে যোগাযোগ করবে।

একদিনের চেষ্টায় আমি একটা বেনামি সিমকার্ড জোগাড় করে ফেললাম। এটি যার নামে রেজিস্ট্রি করা, তিনি কয়েকদিন আগে মারা গেছেন।

নতুন সিম ব্যবহার করে কল করে দেখলাম কানা বারেকের নাম্বারটি বন্ধ। এমনই হবার কথা। মোবাইল ট্র্যাক করে পুলিশ তাকে ধরে ফেলুক, এটা নিশ্চয়ই সে চায় না।

লোকটিকে মেসেজ দিতে হবে। একবার ভাবলাম “The Irishman” মুভির ডায়লগ ব্যবহার করে লিখি, ‘I heard you paint houses.’ কিন্তু, শেষ পর্যন্ত সহজ সরল বাংলায় লিখলাম, ‘আমার পরিচিত একজনের ঘর “পেইন্ট” করতে আপনাকে পাঠাতে চাই। দয়া করে আমার এই “ব্যক্তিগত” নাম্বারে যোগাযোগ করুন।’  

প্রায় ত্রিশ ঘন্টা পরে উত্তর পেলাম: আপনার নাম, পাসপোর্ট সাইজ ছবি, বাসার ঠিকানা ও এক লক্ষ টাকা (১০০০ টাকার বান্ডিল, নতুন নোট নয়, আবার বেশি পুরানো নয়) একটা ছোট বাদামি খামে ভরে খামের মুখ টেপ দিয়ে আটকিয়ে রেডি রাখুন। আপনার এই সিমটি সেট থেকে বের করে রাখুন। কাল শুক্রবার সকাল আটটায় সিমটি ব্যবহার করে আমার মেসেজ পড়ে সাথে সাথে সিমটি আবার খুলে ফেলবেন এবং বাসা থেকে বের হবেন। কোথায় যেতে হবে তা তখন বলবো। আপনার নাম, ছবি বা ঠিকানা – যে কোনো একটিও যদি ভুয়া হয়, তাহলে আপনার এক লক্ষ টাকা বাজেয়াপ্ত হবে। এই টাকা প্রাথমিক খরচ হিসেবে নেয়া হচ্ছে। “পেইন্ট” এর খরচ বিশ লক্ষ থেকে চল্লিশ লক্ষ টাকা, যা মুখোমুখি বসে ফাইনাল করা হবে। রাজি থাকলে ও.কে. লিখে পাঠিয়ে সিম খুলে ফেলুন। 

আমি ‘ও.কে.’ লিখে পাঠিয়ে সেট থেকে সিমটা খুলে ফেললাম।   

(২)

কানা বারেক আমার নাম-ঠিকানা যাচাই করবে তা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। গত দু’মাস ধরে আমি মোহাম্মদপুরে বর্তমান ঠিকানায় আছি এবং নিজেকে এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি করেছি।

লোকটির নির্দেশনা অনুযায়ী আমি আমার বর্তমান নাম (আতিকুল ইসলাম) আর ঠিকানা একটা A5 সাইজের (A4 এর অর্ধেক) কাগজে লিখলাম। এক কপি ছবি আর এক লক্ষ টাকার সাথে কাগজটা ছোট খামে ভরে রেডি করে রাখলাম। 

পরদিন শুক্রবার সকাল আটটায় নতুন সিম মোবাইলে ইনসার্ট করতেই কানা বারেকের মেসেজটা পেলাম (৭:৫৫ তে পাঠানো): খামটি সাথে নিয়ে এখনই বাসা থেকে বের হন। একটা রিকশা বা সিএনজি নিয়ে (প্রাইভেট কার নেয়া যাবে না) কলাবাগান ওয়েস্ট বাসস্ট্যান্ড চলে যান। খামটি হাতে রাখুন যাতে আপনাকে চিনতে পারি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমাকে কল করে পাবেন না, মোবাইল বন্ধ থাকবে। আপনার মোবাইলও বন্ধ রাখবেন। আমি খামটি নেয়ার আগে মোবাইল অন করবেন না।

কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালাম ৮:৩০-এ। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে খাম হাতে কানা বারেকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। শুক্রবার সকাল, তাই রাস্তায় পথচারী বা যানবাহন নেই বললেই চলে।

অপেক্ষার পালা যেন শেষ হচ্ছে না। এক একটা মিনিট মনে হচ্ছে এক ঘন্টার সমান।

নয়টার একটু পরে দক্ষিণ দিক থেকে একটা মোটর সাইকেল আসতে দেখা গেল। ফুল হেলমেট পরা রয়েছে বলে আরোহীর মুখ দেখা যাচ্ছে না।

বাইকটি কাছাকাছি আসতেই প্যান্টের পকেট থেকে আমার Glock 17 পিস্তলটা বের করার জন্য হাত নিশপিশ করতে লাগলো। কানা বারেককে ঘায়েল করার এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ! অতি কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করলাম। লোকটিকে কানা বারেক মনে করেই আমি কাজ করছি, কিন্তু সে কানা বারেক না-ও হতে পারে।

বাইকের আরোহী যদি কানা বারেকের প্রতিনিধি হয়ে থাকে, তাহলেও তাকে আটকিয়ে কোনও লাভ হবে না। তাকে মেরে ফেললেও সে কোনও তথ্য দিবে না। কানা বারেকের সাথে কেউ বেঈমানি করলে পরিবারের সব সদস্যসহ তাকে নির্মমভাবে টর্চার করে মেরে ফেলা হয়।

আমার কাছে এসে বাইক থামিয়ে আরোহী বুক পকেট থেকে একটা বাদামি খাম বের করে আমার হাতে দিলো। হাত বাড়িয়ে চাওয়ার ভঙ্গি করতেই আমি আমার হাতের খামটি তাকে দিলাম। এক মুহূর্ত দেরি না করে বাইক ঘুরিয়ে সে বাম দিকের গলিতে ঢুকে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।

আমি এই মাত্র পাওয়া খামটি খুললাম। ভেতরে একটি কম দামি মোবাইল (বারো-তেরো শ’ টাকার বেশি নয়) আর একটা চিরকুট। লেখা আছে: আমার দেয়া মোবাইলটাতে বেনামি সিম সেট করা আছে। পত্রিকায় দেয়া নাম্বারটি আমি আর ব্যবহার করবো না, তাই ঐ নাম্বারে কোনও কল বা মেসেজ দেয়া যাবে না। আপনার আগের সিম কোন অবস্থাতেই আর ব্যবহার করা যাবে না, কারণ ঐ সিম থেকে আমার নাম্বারে কল করা হয়েছে। আপনার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করতে দিন দুয়েক সময় লাগতে পারে। সবকিছু সন্তোষজনক হলে আমি নতুন সিমে আপনাকে মেসেজ দিয়ে জানাবো সামনাসামনি কথা বলতে কোথায় কখন যেতে হবে। – কানা বারেক

যাচাই-বাছাইয়ে ‍টিকবো তো? নাকি এক লাখ টাকা জলে গেল? দেখা যাক।

অপেক্ষা বড়ই কঠিন কাজ। বিশেষ করে যদি জানা না থাকে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে এবং অপেক্ষার পালা আদৌ শেষ হবে কিনা।

তিন দিন পরে নতুন সিমে কানা বারেকের মেসেজ পেলাম: ক্যাফে অপিয়াস, বেইলি রোড। আজ বিকাল চারটা। দশ লাখ টাকা অগ্রিম বাবদ আনতে হবে (১০০০ টাকার বান্ডিল, নতুন নোট নয়, আবার বেশি পুরানো নয়, একটা A4 সাইজের বাদামি খামে)।

(৩)

বেলা তিনটায় আমি ক্যাফে অপিয়াসে ঢুকলাম। ঘন্টাখানেক আগেই এসেছি, যাতে পরিস্থিতির উপর দৃষ্টি রাখতে পারি।

রেস্টুরেন্টটি বড় হলেও এখন কাস্টোমার কম, আমাকে বাদ দিলে মাত্র চারজন। জানালার পাশের একটি কর্নার টেবিলে এন্ট্রান্সের দিকে মুখ করে বসলাম আমি। একটা এক্সট্রা লার্জ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার দিলাম।

ডান দিকের কর্নার টেবিলে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে বসে আছে। ছেলেটির বয়স আনুমানিক ত্রিশ (আমার চেয়ে বছর তিনেক কম), পরনে নেভি ব্লু প্যান্ট, সাদা শার্ট আর মেরুন কালারের টাই। হ্যানসাম, দেখে মনে হচ্ছে কোনও ব্যাংকের অফিসার। বসে আছে আমার দিকে মুখ করে। মেয়েটির বয়স সাতাশ-আটাশ হবে। পরনে গোলাপী পোলো শার্ট আর বাদামি লেগিংস। দেখে যে কোনও পুরুষের মাথা ঘুরে যাবে (ওয়েল, আমার মাথা ঘুরে গেছে)। বসে আছে আমার মতো এন্ট্রান্সের দিকে মুখ করে। স্ট্র দিয়ে জুস খাচ্ছে মেয়েটি। ছেলেটি কিছু খাচ্ছে না।

আমার সামনে দুই টেবিল পরে বসে আছেন একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। উল্টো ‍দিকে মুখ করে বসেছেন বলে তার মাথার পিছনের টাক ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তবে, পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় তার বদখত চেহারাটা চোখে পড়েছিলো।

রেস্টুরেন্টের দরজার কাছের টেবিলে এদিকে মুখ করে বসে আছেন আরেকজন মাঝবয়সী লোক, হা করে বার্গারে কামড় দিচ্ছেন তিনি। এত বড় হা কখনও দেখিনি।

এদের কাউকেই কানা বারেক মনে হচ্ছে না।

সাড়ে তিনটায় চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি। চমৎকার গড়ন, একেই বোধ হয় hourglass figure বলে। এক মুহূর্তের জন্য আমার সাথে তার চোখাচোখি হলো। ধীর পায়ে হেঁটে বের হয়ে গেল মেয়েটি।

পৌনে চারটায় প্রৌঢ় একজন ভদ্রলোক ক্যাফে অপিয়াসে ঢুকলেন। স্যুট-টাই পরা, চোখে বাইফোকাল। টেকো লোকটার ডান পাশের টেবিলে উল্টোদিকে ফিরে বসলেন তিনি।

এই ভদ্রলোক কানা বারেক হয়ে থাকলে আমি ডোনাল্ড ট্রাম্প।

চারটায় কর্নার টেবিলের ছেলেটি হঠাৎ উঠে এসে আমার কাছে দাঁড়ালো। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বললো, ‘আমি কানা বারেক।’

অবাক হলাম। যদিও কানা বারেক ‘কানা’ হবে তা আমি আশা করিনি (ধরে নিয়েছি নামটা এক ধরনের ব্র্যান্ডিং), তবে এমনটাও আশা করিনি। এই ছেলের চোখ দুটো মায়াভরা, দেখে মনে হয় না ভাড়াটে খুনির চোখ।

নিজেকে সামলে নিয়ে হাত ইশারায় তাকে বসতে বললাম। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হয় শুনেছি, কিন্তু পদ্মলোচন ছেলের নাম কানা এই প্রথম দেখলাম।

(৪)

‘কী খাবেন বলুন,’ কথা শুরু করলাম আমি।

‘কিছু না। আগে দরকারি কথা সেরে ফেলি।’

‘ও.কে.।’

‘আমার রেট হলো: পুরুষ মানুষ বিশ লাখ, মহিলা পঁচিশ লাখ – মহিলাদেরকে খুন করলে ঝামেলা বেশি, নামকরা পুরুষ ‍ত্রিশ লাখ, নামকরা মহিলা পঁয়ত্রিশ লাখ, আর পুলিশ বা আর্মির কেউ হলে চল্লিশ লাখ – এদের বেলায় ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। রেট ফিক্সড, নট নেগোশিয়েবল, ও.কে.?’

‘ও.কে.।’

‘এবার বলুন কাকে খুন করতে হবে?’

‘একজন মহিলাকে। নামকরা কেউ নয়, আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ইট শুড নট বি ডিফিকাল্ট ফর ইউ।’

‘ইজি অর ডিফিকাল্ট – দ্য রেট ইজ টোয়েন্টি-ফাইভ, ও.কে.?’

‘ও.কে.। কিন্তু, খুনটাকে অ্যাক্সিডেন্ট মনে হতে হবে। নইলে আমি ঝামেলায় পড়বো।’

‘নো প্রবলেম,’ বললো বারেক। ‘মহিলার নাম-ঠিকানা দিন। তার এক কপি ছবিও নিয়ে এসেছেন আশা করি?’

‘হ্যাঁ। ছবিটাই আগে দেখুন।’ একজন মহিলার পোস্টকার্ড সাইজের ছবি তার হাতে দিলাম।

‘কেন খুন করাতে চান?’ জানতে চাইলো বারেক।

‘আমি ইদানিং একা থাকি। ওয়াইফের সাথে সেপারেশন চলছে। এর জন্য দায়ী এই মহিলা।’

‘অগ্রিমের টাকা?’ আমার সামনে রাখা A4 সাইজের বাদামি খামটির দিকে তর্জনি তাক করে জানতে চাইলো বারেক।

‘হ্যাঁ,’ বলে আমি খামটি তার দিকে এগিয়ে দিলাম।

টাকার একটা বান্ডিল বের করে চেক করলো বারেক। সন্তুষ্ট হয়ে খামটি এক পাশে সরিয়ে রেখে বললো, ‘কাজটা যেদিন সারবো, সেদিন রাতেই আমার পছন্দের জায়গায় বাকি পনেরো লাখ টাকা নিয়ে যেতে হবে। এক হাজার টাকার বান্ডিল। ও.কে.?’

‘ও.কে.।’

‘মহিলার নাম-ঠিকানা?’

‘একটা কথা বলে রাখি। মহিলার সাথে তার এক কাজিনের চেহারার বেশ মিল। তবে, মহিলার ডান হাতের অনামিকায় টকটকে লাল পাথরের আংটি। প্লিজ চেক হার রেড রিং।’

ভ্রুকুটি করলো বারেক। বললো, ‘হার রেড রিং?’

‘ইয়েস।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো বারেক। তারপর বললো, ‘ও.কে., নাম-ঠিকানা দিন। এবার বলুন, কী খাবেন? আমার ট্রিট।’

‘আমি এক কাপ কফি খাবো, যদি আপনিও কিছু খান,’ বললাম আমি।

‘আমি বাদামের শরবত খাবো,’ বললো সে। হাত তুলে ওয়েটারকে ডেকে একটা রেগুলার কফি আর এক গ্লাস বাদামের শরবত অর্ডার দিলো বারেক।

‘আপনি কীভাবে কাজটি করবেন?’

আমার প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো বারেক। বললো, ‘সেটা তো আপনার ব্যাপার না।’

‘বিরক্ত হচ্ছেন কেন? আপনিও তো জিজ্ঞেস করলেন মহিলাকে কেন মারতে চাই – সেটা তো আপনার ব্যাপার না।’

‘তা ঠিক। যেহেতু খুনটাকে অ্যাক্সিডেন্ট মনে হতে হবে, তাই অপশন খুব বেশি নেই। যেমন, ‍বিষ খাওয়ালে বা গুলি করে মারলে অ্যাক্সিডেন্ট দাবি করা যাবে না। খুন করার দুটো সহজ উপায় বাদ পড়ে গেল। যাই হোক, আগুন বা কার অ্যাক্সিডেন্ট – যে কোনও একটা উপায়ে কাজটা করবো। দেখা যাক।’

কফি আর বাদামের শরবত চলে এলো।

‘আনুমানিক কত দিনের মধ্যে আপনি কাজটা সারতে পারবেন?’ কফির মগে চুমুক ‍দিয়ে জানতে চাইলাম।

‘সর্বোচ্চ সাত দিন,’ শরবত খাওয়া থামিয়ে উত্তর দিলো বারেক।

(৫)

কফি খাওয়ার কিছুক্ষণ পর বমি পেলো আমার।

‘আমাকে একটু ওয়াশরুমে নিয়ে যাবেন, প্লিজ?’ বারেককে বললাম। ‘বমি পাচ্ছে। মাথাটা এমনই ঘুরছে, মনে হচ্ছে হাঁটতে গেলে পড়ে যাবো।’

‘শিওর,’ বলে উঠে এসে আমাকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল বারেক। বেসিনের সামনে দাঁড়াতেই বমি হলো আমার।

দেখলাম বারেক আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে!

‘কী খাইয়েছেন আমাকে?’ উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘সায়ানাইড,’ নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো বারেক।

‘কেন? আমি তো আপনার ক্লায়েন্ট।’

‘ক্লায়েন্ট না ঘোড়ার ডিম! “Her red ring” কথাটা “red herring’’ এর অ্যানাগ্রাম, অক্ষরগুলো খুব বেশি অদলবদলও করতে হয় না। তার মানে, আপনি কাউকে খুন করাতে আসেননি। আমাকে একটা রেড হেরিং বা মিথ্যা টার্গেট ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাজ সারতে চেয়েছেন।’

‘আপনাকে অনর্থক ক্লু দেয়া আমার উচিৎ হয়নি,’ বললাম আমি। ‘আপনি যে এত ইন্টেলিজেন্ট, বুঝতে পারিনি। সায়ানাইডের তো অ্যান্টিডোট আছে। আমার জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে কতো টাকা চান?’

‘আপনাকে ৩০০ এমজি সায়ানাইড দেয়া হয়েছে। বাঁচার কোনও আশা নেই। আর সর্বোচ্চ দশ ‍মিনিট।’

‘কফিতে কীভাবে সায়ানাইড ‍দিলেন?’

‘কিচেনে আমার লোক আছে। তাকে বলে রেখেছিলাম, আমি বাদামের শরবত অর্ডার দিলে সাথের অন্য ড্রিংকে সে সায়ানাইড মেশাবে।’

আবার বমি হলো আমার।

‘চেক করে দেখেছি আপনি পুলিশ বা র‍্যাবের লোক না। তাহলে কেন আমার পিছনে লাগলেন?’ জিজ্ঞাসা করলো বারেক।

‘কদিন আগে আপনি মারুফ নামের একজনকে খুন করেছেন। ওর বাবা আমার বাবার বন্ধু। তাঁর কাছ থেকে বিনা সুদে টাকা ধার পেয়ে আমার বাবা ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন। বছর খানেক আগে আমার বাবা মারা গেছেন। মারুফের বাবাকে আমি নিজের বাবার মতো দেখি।’

পাশের বেসিনে বারেক হঠাৎ একগাদা বমি করলো।

‘কী খাইয়েছেন আমাকে?’ তার কন্ঠে উদ্বেগ আর বিস্ময়।

‘Tetrodotoxin,’ বললাম আমি, ‘pufferfish বা পটকা মাছে এই বিষ থাকে।’

‘অ্যান্টিডোট আছে?’

‘না।’

বারেকের মুখটা কালো হয়ে গেল। আবার বমি করলো সে। এদিকে আমি ওয়াশরুমের মেঝেতে বসে পড়লাম।

‘আমরা দুজনই মরবো,’ বললো বারেক। ‘তবে, আপনি হারবেন, আমি জিতবো।’

‘কীভাবে?’

‘আমি কানা বারেক নই,’ বলে হা হা করে হাসলো সে। ‘আমি তার সহকারী, আমার নাম নাসিম।’

আমি এখন মেঝেতে আধশোয়া হয়ে আছি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কানা বারেক তাহলে কে?’

‘বলা যাবে না। আপনি ফোন করে কাউকে বলে দিতে পারেন।’

আমি আমার মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। হাত বাড়িয়ে সেটি নিয়ে নাসিম বললো, ‘আমার সাথে যে বসে ছিলো, সাদেকা আপা, সে-ই কানা বারেক।’

আমি চমকে উঠলাম। তবে, নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে Glock 17 পিস্তলটা বের করে নাসিমের দিকে তাক করলাম। তার হাত থেকে আমার মোবাইলটা ফেরত নিয়ে একটি নাম্বারে কল করে বললাম, ‘ক্যাপ্টেন জামান বলছি। চলে আসুন, আমরা ওয়াশরুমে।’

(৬)

আমাকে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে দেখে অবাক হলো নাসিম। আমি মনে মনে হাসলাম। আমাকে সে বিষ খাওয়াতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। কিচেনের যেই লোকটা এদের গ্রুপের সদস্য, তাকে আগেই অ্যারেস্ট করে কিচেনেই রাখা হয়েছে। 

রেড হেরিং ক্লূটা নাসিমকে ইচ্ছে করে দিয়েছি। জানতাম সে এটা ধরে ফেলবে এবং আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে। এটাও জানা ছিলো, এদের প্রধান অস্ত্র বিষ।

নাসিমকে বিষ খাওয়ানো হয়নি। আমাদের দু’জনেরই বমি পেয়েছে, কারণ আমাদেরকে ipecac দেয়া হয়েছে, যা খেলে অনেক বমি হয়। নাসিমকে বিষের কথা বলেছি, যাতে তার কাছ থেকে কানা বারেকের পরিচয় বের করা যায়। সাদেকাকে অলরেডি অ্যারেস্ট করা হয়েছে। নির্দেশ দেয়া ছিলো, আমি রেস্টুরেন্টে ঢোকার পর যে-ই বের হবে, কাস্টোডিতে নিতে হবে।

এরা খোঁজ বের করতে পারেনি যে আমি র‍্যাবের লোক, কারণ গত দু’মাস আমি আন্ডারকাভার ছিলাম। একটা আইসক্রিম পার্লার চালিয়েছি এবং ফ্যামিলি থেকে দূরে থেকেছি।

র‍্যাবের দু’জন সদস্য এসে নাসিমকে হ্যান্ডকাফ পরালো। আমি দ্রুত পায়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাসার পথ ধরলাম।

(শেষ)

প্রাক্তন শিক্ষার্থী

পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪

জাফর আহমেদ খান

প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেশনঃ ১৯৮৩ - ৮৪