fbpx

পার্সেল

Picture1

১.

“আই উড নেভার ফল ইন লাভ অ্যাগেইন আনটিল …” হঠাৎ গান থেমে যাওয়ায় বিরক্তি নিয়ে স্ক্রীন এর দিকে তাকালো নওশীন। পরমুহূর্তেই বিরক্তি ছাপিয়ে চোখে মুখে আনন্দ ফুটে উঠলো তার। আরাফ কল দিয়েছে। রিসিভ করে ফোন কানে তুলে নিল নওশীন। 

– হ্যালো, প্রাণপ্রিয় স্বামী। কখন আসবেন? 

– এইতো আর ঘন্টাখানেক লাগবে। খেয়েছো তুমি?

– নাহ। তুমি আসো, একসাথে খাবো।  

– আহা! কি যে পাগলামি করো না! আচ্ছা দেখা হচ্ছে একটু পর ইনশা আল্লাহ। 

– খোদা হাফেজ।

ফোন রেখে দিল আরাফ। “পাগলামির দেখেছো কি?” মনে মনে বলে উঠলো নওশীন। অন্ধের মত ভালবাসে সে আরাফকে। 

আরাফ প্রচুর চা খায়। শুধুমাত্র আরাফ কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য চা ধরেছিল নওশীন। এখন না খেলে মাথা ধরে। এমন ছোটো বড় সবকিছুতেই আরাফ এর প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পায়। আরাফ দেখে না। কিংবা না দেখার ভান করে। মুচকি হেসে আবার গান প্লে করলো নওশীন। “আই ফাউন্ড হার……”

সাইকেলের স্ট্যান্ডটা নামিয়ে রাখলো রাফি। রাস্তাটা শুনসান। মানুষ তো দূর, আসে পাশে একটা কুকুরও নেই। পিছে ডেলিভারি ব্যাগ আছে রাফির। একটাই ডেলিভারি বাকি। এইটা দিয়ে বাসায় যাবে সে। 

“থাক। সে পরে হবে।” ভাবে রাফি। এখন এক তীব্র উন্মাদনা তাকে চেপে ধরেছে। 

একটু দূরেই মেয়েটি একা দাঁড়িয়ে আছে। চশমা দেখে মনে হয় মেয়েটি হয়তো প্রফেসর। রাস্তার পাশেই ঝোপ। টেনে ঝোপের আড়ালে নিয়ে যেতে পারলেই কাজ হয়ে যাচ্ছে রাফির।

পেটের তাগিদে কৈশোরে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মর্গে কাজ নেয় রাফি। প্রথম প্রথম মর্গের অস্বাভাবিক বিভৎসতা সহ্য করতে পারতো না সে। কত বার খেতে গিয়ে বমি করেছে, কতো রাত চোখের সামনে দেখা মৃত লাশের বিভীষিকা তাকে ঘুমাতে দেয়নি হিসাব নেই। এরপর আস্তে আস্তে সয়ে গেছে। এখন তার লাশ ভালই লাগে। বিশেষ করে নারী মৃতদেহ। তীব্র ভালোলাগা থেকেই লাশের সাথে সহবাস থেকে শুরু করে লাশ ভক্ষণ, সবই সে করেছে। ভালোই কাটছিল সব। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ধরা পরে যেতে হয়। শেষমেষ চাকরি হারিয়ে এখন সে ডেলিভারি ম্যান। 

সাইকেলের ক্যারিয়ারে রাখা ডেলিভারি ব্যাগ এর চেইন আস্তে আস্তে খুললো রাফি। সাইড পকেটে রাখা ধারালো ছুরি কোমরে গুঁজে ঘুরে তাকাতেই দুর থেকে ভেসে আসা হেড লাইট এর আলো তার চোখে পড়লো। কয়েক সেকেন্ড পর একটা বাইক এসে থামলো মেয়েটার সামনে। অভিবাদন জানিয়ে বাইকে চড়ে বসলো মেয়েটি। বাইকটা সাই করে রাফির সামনে দিয়ে চলে গেলো। ক্ষুধার্ত শেয়ালের সামনে থেকে শিকার ছিনিয়ে নিয়েছে সিংহ। রাফির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। অদম্য আকাঙ্ক্ষা মাথা চারা দিয়ে উঠলো। আজকে তার একটা শিকার যেকোনো মূল্যে চাই-ই চাই। 

নওশীন এর কল কেটে দিয়ে মুচকি হাসলো আরাফ। চোখ বন্ধ করে প্রিয় স্ত্রীর মায়া মুখখানা মনে করার চেষ্টা করলো। “তাহারেই যেনো, ভালোবাসিয়াছি, শতরুপে শতবার…”। চোখ মেলে টাকার খামটা তানভীর সাহেবের দিকে এগিয়ে দিল আরাফ। কৃতজ্ঞতায় তানভীর সাহেবের চোখে পানি চলে এলো। এতদিন কতই না চিন্তায় ছিলেন তিনি! কিভাবে জোগাড় হবে মেয়ের বিয়ের টাকা? কিছুই বলতে পারলেন না তানভীর সাহেব। চোখ মুছতে মুছতে উঠে চলে গেলেন। “কী অসাধারণ মানুষ! কী শান্ত! কী অমায়িক!” আরাফকে এইসব বিশেষণে প্রশংসা করতে লাগলেন নিজের মনেই। 

রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো আরাফ। অফিসের সবাই তাকে শান্ত আর অমায়িক ভাবে। মুহূর্তেই তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেলো আরাফ এর মুখে। 

ছোটবেলা থেকেই প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছে আরাফ। সাথে তীক্ষ্ণ মেধা আর গগণবিদারি রাগ। কিছু মানুষ আছে যাদের ক্ষেত্রে “রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে” কথাটা আক্ষরিক অর্থেই ফলে। আরাফ এমনি একজন। রাগে তার গায়ের তাপমাত্রা লক্ষণীয় ভাবে বেড়ে যায়। 

বছর সাতেক আগে, এমনি প্রচণ্ড রাগের বশে ফাইয়াজ কে খুন করে আরাফ। আরাফ এর এতে কোনো অপরাধবোধ নেই। মৃত্যুই প্রাপ্য ছিল ফাইয়াজ এর। বান্ধবী নওশীনকে নিয়ে বাজে কথা তার সহ্য হবে না জেনেও ফাইয়াজ কটূক্তি করেছিল। ফাইয়াজ এর লাশ অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। মীর মোশারফ হলের পিছনের জঙ্গলে পুতে ফেলা খন্ড বিখন্ড লাশের কিছু অংশ আরাফ এর পেটেও গিয়েছি। শুধু খুন করে ক্ষোভ না মিটায় এই ব্যবস্থা। সেই থেকে মানুষের মাংস খুব তৃপ্তি করে খায় আরাফ। তাকে দেখে কেউ বলবে শান্ত হওয়ার ভান করা এই মানুষটা আট আটটা খুন করেছে। 

দ্রুত বাসায় ফিরতে হবে। নওশীন এর জন্য মন কেমন করছে আরাফ এর। কিছুদিনের মধ্যে ইন্ডিয়া যাবে আরাফ। এর আগে একটু মানুষের মাংস খেয়ে যেতে পারলে ভালোই হয়।

“কে?” 

নওশীন এর প্রশ্নে দরজার ওপার থেকে রাফি জবাব দিলো “ম্যাডাম একটা পার্সেল ছিল”। রাফির এখন ভয়ানক তাড়া। শেষ পার্সেল ডেলিভারি দিয়ে তার রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হবে শিকার এর সন্ধানে। “পার্সেল!” অবাক হয়েই দরজা খুললো নওশীন। আপাদমস্তক রাফিকে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করলো 

– কার নামে পার্সেল? 

– নওশীনননননননন তাবাসসুম। আপনি?

– হ্যা

পার্সেলটি হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নওশীন। 

– কতো হয়েছে?

– রিসিটে লেখা আছে ম্যাডাম। 

– আচ্ছা, অপেক্ষা করুন। আমি টাকা নিয়ে আসছি। 

টাকা আনতে এতো দেরি হচ্ছে কেনো? রাফির তো যাওয়ার তাড়া। আজকে রাতে তার শিকার চাই-ই চাই। হঠাৎ রাফি মাথায় চিন্তা আসলো বাড়িতে পুরুষ সদস্য থাকলে এতো রাতে মহিলার দরজা খুলতে আসার কথা না। মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলে গেলো রাফির মাথায়। “একটা রিস্ক নিয়ে দেখবো কি?” ভাবে রাফি। পরমুহূর্তেই “যা আছে কপালে” ভেবে রিস্ক নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় রাফি। 

টাকা দেওয়ার জন্য দরজা খুললো নওশীন

– এইযে নেন। বাকিটা টিপ।

টাকা পকেটে রাখতে রাখতে রাফি বললো 

– ম্যাডাম এক গ্লাস পানি হবে? 

এতো রাতে কাউকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবেনা জেনেও রাফিকে বসতে বললো নওশীন। অসহায়কে ‘না’ করতে পারে না নওশীন। 

ঘরে ঢুকেই রাফির চোখ জ্বলে উঠলো। শিকারের গন্ধ তাকে এখানে টেনে এনেছে। 

“এও কি সম্ভব? এতো সরল বিশ্বাসী মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছে? কোনো বাধা ছাড়াই তাকে ঘরে ঢুকতে দিল নওশীন? এই মেয়ের শরীরে ছুরি চালাতে কি তার একটুও বাঁধবে না?” ভাবে রাফি।

পানির গ্লাস নিয়ে হাজির হলো নওশীন। গ্লাসটা হাতে নিয়ে আমতা আমতা করে রাফি জিজ্ঞেস করলো 

– বাসায় কেউ নেই?

– না। আপনার ভাই অফিসে। ইকটু পরেই চলে আসবে। 

আপনার জন্য চা করছি। চা খেয়ে আপনার ভাই আসলে ডিনার করে একবারে যাবেন। 

হাসতে হাসতে এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে শেষ করলো নওশীন। 

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো রাফি। “ভাই এসে তো আর আপনাকে দেখতে পাবে না ভাবী” মনে মনে বলে রাফি। কিন্তু এই হাস্যময়ীর গায়ে ছুরি চালাতে কি তার একটুও বাঁধবে না?

কোমরে গুজে রাখা ছুরির দিকে হাত বাড়ায় রাফি।

“ভোয়ে সিন সাবের। সিন তু আমোর। কমো হাসের। কোন তানতো দলোর।” সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টি টেবিলে পা রেখে এক মনোযোগে গান শুনছিল নওশীন। মনোযোগে চিড় ধরে কলিংবেল এর শব্দে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে। আরাফ এসেছে। 

 “তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। ড্রয়িং রুমে।” বলে নওশীন।

ড্রয়িং রুমে ঢুকেই খুশিতে নওশীন এর দিকে ফিরে তাকায় সে। থ্রি সিটার সোফায় পরে আছে একটা লাশ। গলার কাছের তীব্র খয়রি রঙের রক্ত শার্ট প্যান্ট সোফা ভিজিয়ে মাটিতে এসে ঠেকেছে। 

চায়ের সাথে প্রচুর পরিমাণে চেতনা নাশক মিশিয়েছিল নওশীন। তার আর দরকার পড়েনি। পানির সাথে মেশানো সামান্য চেতনানাশকে অজ্ঞান হয়ে যায় রাফি। আহারে! বেচারা। সে কি জানতো তার বয়ে নিয়ে আসা পার্সেলেই আছে আর তার মারণাস্ত্র। চা নিয়ে রুমে ঢুকে যখন নওশীন দেখে রাফি অচেতন, তখন আর বেশি সময় নেয় নি সে। তাড়াতাড়ি পার্সেল এর মোড়ক খুলে ছুরি বের করে রাফির গলায় সজোরে চালিয়ে দেয় সে। ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্তে তার সারা শরীর মেখে যায়। রক্তের গন্ধ একদমই নিতে পারে না নওশীন। মানুষের মাংস খাওয়া তো দূরের বস্তু। আরাফ এর জন্য রান্না করতে গিয়েই তার গা গুলিয়ে আসে। কিন্তু কী আর করা যাবে? অসম্ভব ভালোবাসে সে আরাফ কে। 

ড্রয়িং রুমের দৃশ্য দেখে তীব্র আনন্দে নওশীনকে জড়িয়ে ধরে আরাফ। নওশীনের গা থেকে জমাট বাঁধা রক্তের গন্ধ ভেসে আসছে। আহা! স্বর্গীয়! কতই না ভালোবাসে মেয়েটা তাকে। মেয়েটাকে তাজমহল দেখতে নিয়ে যেতে হবে। আলিঙ্গন আরো শক্ত করে আরাফ।

Prize Owner Story 3rd
Story3

প্যাপাইরাসের অনলাইন সংস্করণের ৪র্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় গল্প লিখাতে তৃতীয়
মিনহাজুল আরিফিন ইনাম

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়