জুন ২০, ২০২৫

নিয়তি

করোনা পরবর্তী সময়ে অফিসের চাপ যেন দ্বিগুন বেড়েছে। মার্চ মাস টা যে কি গেলো, বাপরে বাপ! তবে কোনমতে টার্গেট টা কমপ্লিট হয়েছে, বসের শান্তি, কোম্পানী খুশী, আমিও যেন অনেকদিন পর একটু শান্তিমতো দম ফেলার সুযোগ পেলাম। মাঝেমাঝে ভাবি, সব ছেড়েছুড়ে ব্যবসা শুরু করে দিবো নাকি। তবে এত সিকিউরড জব, প্রিভিলেজড লাইফ, সব ছেড়ে অনিশ্চিত এ ভবিষ্যৎ বেছে নেওয়ার মতো সাহস আমার হয়ে উঠে না। এমন সাহসী কাজ জীবনে একবারই করতে পেরেছিলাম। তাছাড়া এখন আমার পরিবার ও আছে, সম্পূর্ণ একা নই। আমার বেটার হাফ, অনিন্দিতা, তার কথাটাও তো ভাবতে হবে!

আমি হাজবেন্ড হিসেবে একটু বেরসিক, তবে একেবারে রোবট অবিশ্যি নই। অনেকদিন ধরেই অনিন্দিতা বলছিলো একদফা নীলগিরি ঘুরে আসবে কিনা। অফিসের এত ব্যস্ততায় কিছুতেই সময় হচ্ছিল না। এবার যখন অবশেষে একটু রেহাই পেলাম, অনিন্দিতার আর বলে দেওয়া লাগলো না, নিজেই বললাম, চলো, একটু হাওয়া বদল করে আসি। অনিন্দিতার অনেক শখ নীলগিরি নীলাচলে যাওয়ার। আমার ওই জায়গাটা অতটা পছন্দ নয়। তবে অনিন্দিতার চোখের চাহনি উপেক্ষা করতে পারে, এমন সাধ্য কি কারো আছে! কিভাবে যেন আমাকে রাজি করিয়েই ফেললো।

অফিসে ছুটির আবেদন দিয়ে, মোটামুটি সব গুছিয়ে, বেড়িয়ে পড়লাম কাঙ্খিত গন্তব্যে। আহা, পুরাতন কত স্মৃতি জড়িয়ে এই অঞ্চলটার সাথে। ছোটবেলায় বড় হয়েছি রাঙামাটিতে, তাই হয়ত এই সৌন্দর্য্য অতটা নতুন নয় আমার কাছে, তবে অনিন্দিতার চোখে মুখে তার বেরসিক বরকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার যে জ্বলজ্বল করা খুশির ঝিলিক, তাতেই যেন প্রথমবার পার্বত্যে আসার অনুভূতি পাচ্ছি আমি। সারাপথ ধরে ওর কতই না গল্প। কতদিনের শখ ওর নীলগিরি, নীলাচলের মেঘের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার। আজ অবশেষে সে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে! দুচোখে এতটা কৃতজ্ঞতা দেখে যেন পাথরেরও মন গলে যায়।

তবে, সবকিছু সুন্দর চললে তো আর প্রকৃতির নিয়ম রক্ষা হয় না। এসি বাস টা রাস্তায় মোট ২ বার নষ্ট হলো। এসে পৌছালাম সন্ধ্যা হওয়ারও ঘন্টা তিনেক পরে এসে। যেভাবে স্মুথলি সব ম্যানেজ করা ছিলো, অনেক কিছুই ভেস্তে গেলো যেন। যাইহোক, তবুও এসে পৌছেছি তাই যেন শান্তি। কিন্তু আমার অফিস কলিগ যাকে ঠিক করে রেখেছিলো আমাদের রিসিভ করার জন্য, তার আর কোনো পাত্তা পাওয়া গেলো না। দেরী দেখে চলে গেলো, নাকি পাত্তা দিলো না, কে জানে। নিজের গালে নিজেকেই থাপড়াতে ইচ্ছে করছে আমার। অফিসের সামান্য ফাইল আনার ক্ষেত্রেও যেই অপদার্থ আমজাদ কে আমি ভরসা করিনা, আমার ওয়াইফের সাথে প্রথম হিল ট্র্যাক ট্রিপের সব ব্যবস্থাপনায় কিনা আমি এই গর্দভকে দায়িত্ব দিলাম!

তবে আমি যেহেতু আগেও এসেছি, রাস্তাঘাট সবই জানি। একটা সিএনজি ভাড়া করলাম, সোজা আমাদেরকে একটা হোটেলে নিয়ে যাবে। যেটায় বুক করেছিলাম, অত ভিআইপি অবস্থা না, তবে অন্তত রাতটা তো কাটানো যাবে! পরদিন সকালে নাহয় আমজাদ গর্দভটার সাথে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা করে নিবো। সিএনজি ওয়ালা মামা বেশ মিশুক মানুষ। উত্তরবঙ্গের মানুষ, ১৯৭৭ এ হিলট্র‍্যাকে এসে নাকি মায়া ছেড়ে আর যেতে পারেন নি। অনিন্দিতা তো ডাবল মিশুক। কথায় কথায় সিএনজি ওয়ালার ছেলে মেয়ে কয়টা, বড় মেয়ের কবে বিয়ে হলে, জামাই কি করে সবই বের করে ফেললো রাস্তায় গল্প করতে করতেই। আমার অবশ্য ওর মতো এত তেল নেই, জার্নির পর টায়ার্ড আমি বরং চুপ করেই রইলাম। সিএনজি ওয়ালা মামা জিজ্ঞেস করলো, ” তা আপা, কোন হোটেলে উঠবেন?” অনিন্দিতা এবার আমার দিকে তাকালো, কারন এর উত্তর তার জানা নেই। “নিকুঞ্জ ভিলা”, আমি বললাম। ” ওহ আচ্ছা” বলে সিএনজি ওয়ালা স্পিড টা আরো বাড়িয়ে দিলো। কথায় কথায় সিএনজি ওয়ালা গল্প করতেই থাকলো, “বুঝলেন আপা, এই বন জঙ্গলে অনেক ঘটনাই ঘইটা যায়, কোনো ব্যাখ্যা নাইকা। আপনারা যেইদিকে যাইতেসেন, ওইখানে অনেক ভূত-প্রেত এর নামগন্ধ শুনা যায়। পাহাড় থেকে পইড়া মরলে, আত্মা নাকি শান্তি পায়না বুইঝছুইন, তহন এই পাহাড়ে ঘুইরা বেড়ায়। কতজন যে মরলো, আহারে! ” বুড়া মানুষদের এই এক সমস্যা, সামান্য কথা বলার সুযোগ দিলে দুনিয়ার হাবিজাবি বলতেই থাকে। আমি হালকা কাশি দিয়ে বললাম, “মামা, মুখ না চালিয়ে, একটু গাড়ি চালান। একটু শোয়া দরকার গিয়ে।” কাজ হলো, সিএনজি ওয়ালা মামা স্পিড বাড়ালো৷ রাত ১ টার দিকে গিয়ে হোটেলে পৌঁছে দুজনে ফ্রেশ হলাম। খুব টায়ার্ড, কাল থেকে ঘুরবো নে, বলে দুজনেই বিছানায় এলিয়ে দিলাম নিজেদের।

যেই ঘরে আমরা শুয়ে আছি, এই ঘর টা আমার বেশ পরিচিত। বছর তিনেক আগে এসেছিলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু নাভিদ এর সাথে। আমরা দুই বন্ধু বলতে গেলে একদম ল্যাংটা কালের বেস্ট ফ্রেন্ড যাকে বলে। দুইটা ছেলে এত ক্লোজ বন্ডিং হয়, তা আমাদের না দেখলে বলা যাবেনা। ছোটবেলায় অত বুঝিনি, কিন্তু যতদিন গেলো, দুজনের কিছু তফাৎ যেন আসতেই থাকলো। আমি হাবাগোবা, সিজি বাড়ানোর চিন্তায় যে ক্লাস ছাড়া কিছু বুঝতামই না, বন্ধু নাভিদ তখন গিটার বাজানো, ফেস্ট নামানো, ইভেন্ট অর্গানাইজ, ডিবেট সবকিছুতে একদম ডিপার্টমেন্ট এর সবার মধ্যমনি। অবশ্য আমার মধ্যমনি ছিলো ডিপার্টমেন্ট এরই আরেকজন, অনিন্দিতা। তবে, নিজে গিয়ে ওকে বলার সাহস আমার তখনো ছিলোনা। আমার যে বন্ধু নাভিদ আমাকে এতটা বুঝে, সেও এই ব্যাপারটা বুঝলো না। ওর জাদুতে খুব দ্রুতই মুগ্ধ হয়ে গেলো অনিন্দিতা। দুজনে ডিপার্টমেন্ট এর একদম পাওয়ার কাপল। আমরা একই সাথে পাশ করে বের হলাম, আমি হ্যান্ডসাম স্যালারির চাকরিতে ঢুকলাম, নাভিদও ওর নতুন স্টার্টআপ নিয়ে কাজ শুরু করলো। বেচারা বুঝতো না, বিয়ের বাজারে এসব মুদি ব্যবসায়ীগিরির লাভ নেই। অনিন্দিতার বাবা একদমই চান না ওর হাতে তুলে দিতে। বেস্ট ফ্রেন্ড এর মন খুব খারাপ, আমিই প্রস্তাব তুললাম, চল, নীলগিরি ঘুরে আসি। তোর মন টা ভালো হবে। কিন্তু ওর মন ভালো করতে গিয়ে উলটো আমার মন বারবার বিগড়ায়। একটু পরপর অনিন্দিতার কল, মেসেজ, কি করছে না করছে সবকিছুর লাইভ আপডেট প্রেমিকাকে দেওয়াই চাই যেন। প্রতিটা বার যেন আমার গা জ্বলে যায় এসব দেখলে। আমার অনিন্দিতা, অন্য কারোর সাথে!

সেবার এক সকালে উঠলাম নাভিদের চেঁচামেচিতে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” বন্ধু, তুই আমার লাকি চার্ম! অবশেষে আমার এতদিনের স্বপ্ন সার্থক। আমার প্রোগ্রামটার অবশেষে ইনভেস্টমেন্ট এসেছে বন্ধু! পুরো ৩ মিলিয়ন ডলারের! আর পিছনে তাকাতে হবে না রে। অনিন্দিতার বাপ কেন, চৌদ্দগুষ্ঠিও মানবে এবার। নতুন করে সব গুছাতে হবে রে এবার। রাতের বাসে ঢাকা চল, ট্রিট আমার! ” যেই নাভিদের সব সাফল্যে আমি খুশী হই, সেবার কোথায় যেন খুব বাঁধলো। দুপুর এ পাহাড়ের ঢাল ঘেষে যখন হোটেলে ফিরছি, হঠাৎ নাভিদ দাঁড়িয়ে বললো, “দেখ দেখ-সাক্ষাৎ স্বর্গ। ” খুশীতে পাগল আর মন্ত্রমুগ্ধ নাভিদ এগোতেই থাকলো, ঠিক তখনই অসাবধানতায় পা হড়কে খাদের কিনারায় চলে গেলো। তবে পিছনে আমি ছিলাম, দ্রুতই গিয়ে ধরে ফেললাম ডান হাত দিয়ে। নাভিদ এর চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা, “দোস্ত, তুই আসলেই আমার সবচেয়ে লাকি চার্ম রে! জলদি টান দে, হাতে ব্যাথা পাইতেসি!” আমি জানিনা, ওই একটা মূহুর্তে আমি কি ভাবলাম। চোখে অনিন্দিতার চেহারাটা ভেসে উঠলো, যাকে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে দেখতাম, গোপনে পিছু নিতাম, যাকে স্টার্টআপে সাক্সেসফুল নাভিদ ঢাকায় ফিরেই অফিশিয়ালি পেয়ে যাচ্ছে। নাভিদ থাকলে অনিন্দিতা কোনোদিন ই আর আমার হচ্ছে না। ওই এক মূহূর্তে আমি কত যে জটিল ইকুয়েশন করলাম মাথায়, নিজেও জানিনা। তবে, ইকুয়েশনগুলো দ্রুতই সরল হয়ে গেলো, হয় নাভিদ কিংবা অনিন্দিতা। সমাধান টাও দ্রুতই আসলো। আমি নাভিদের হাত ছেড়ে দিলাম।

বিপর্যস্ত অনিন্দিতার সামলে উঠতে বেশ কয়েক মাস লেগে গেলো। ওকে এই সময়টা কাটিয়ে উঠতে নাভিদের বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে আমিই সাথে সাথে থাকতাম সারাক্ষণ। এতদিন আগে মাস্টার্স শেষ করা মেয়ে, ওর বাবা আর দেরী করতে চাইছেন না ওর বিয়েতে। চাকরিতে সেটেল্ড হওয়া আমি অনেক আগে থেকেই তার নজরে ছিলাম, মেয়ের জেদ এর কারনে বলতে পারছিলেন না। নাভিদ এর সাথে সম্পর্ক এর কথা আমি জানি, আর তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই, জেনে অনিন্দিতা আশ্বস্ত হলো। দুইপক্ষ এর সম্মতিতে, নাভিদ মারা যাওয়ার দেড় বছরের মাথায় আমরা বিয়েটা সেরে ফেলি।

বিয়ের পর হিল ট্র্যাকে এই প্রথম আসলাম আমরা। নাভিদ থাকাকালীন সে ট্রিপটাতেই অনিন্দিতা আসতে পারছে না, অনেক আফসোস ছিলো ওর। এবার হয়ত সেই আফসোস গুছলো! আমি ওর চুলগুলো সরিয়ে মিষ্টি মুখটার দিকে তাকালাম। আশ্চর্য! হঠাৎ ওর কপালের শিরাগুলো নীল দেখাচ্ছে কেন! আমি ডাকলাম, “অনিন্দিতা! অনিন্দিতা! উঠো তো! কি হচ্ছে তোমার!” হঠাৎ একটা ঠান্ডা বরফের মতো একটা কালসিটে রঙের হাত আমার কাধে এসে পড়লো। আমার পিছনে ঘুরে তাকাতে সাহস হচ্ছে না। অবিকল নাভিদের গলায় সেই ঠান্ডা হাতটার মালিক পিছন থেকে আমাকে বললো, “দোস্ত, তুই না আমার লাকি চার্ম! আর তুই আমার সাথে এটা করলি! অনেকদিন অপেক্ষা করে আছি রে তোর জন্য, অবশেষে এবার তুই আসলি তোর নিয়তির কাছে! ….”

0501 মাহিম পারভেজ উত্তরকবিতা Writer
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp