নবীন বরণের আর পাঁচ দিন বাকি আছে। এখনো তিনটা নাচের পারফরম্যান্সও ভালোমতো উঠানো হয়নি। আর বেহায়ার মতো সেটা নিয়ে আমাদের কোনো লজ্জাশরমও নেই। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছি আর বলছি “হবে।” কী হবে, কিভাবে হবে আর কবে হবে সেইটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, সবাই হেলেদুলে বেড়াচ্ছি।
কারো মাথাব্যথা নাই কথাটায় অবশ্য একটু ভুল আছে। কিছু মানুষের মাথাব্যথা আছে। সেটা দিন এত বেশি হতে থাকল যে সবার মধ্যে সংক্রামিত হতে বাধ্য হল ক্লাসে ঢুকলেই শুরু হয় সুমাইয়ার ভাষণ “বুঝছিস আমাদের কলেজের নবীনবরণে আমরা এত সুন্দর পারফরম্যান্স করতাম যে সেটা মিডিয়ায় আসত। এবারের নবীন বরণে আমরা সবাই ব্লা ব্লা…।” সেটা লাঞ্চ ব্রেকে চলে যায় রিয়াজের কাছে, “ভার্সিটির এমন কোন বাস নাই যেইটার অনুষ্ঠানে আমি নাচি নাই। কিরকম নাচ তুলতে হবে বল শুধু। ব্রেক ড্যান্স, ক্ল্যাসিকাল, হিপহপ, পোল ডান্স, ল্যাপ-” তার কথার মাঝখানে আমরা সবাই চিৎকার করে উঠি “পোল ড্যান্স, পোল ড্যান্স। পোল ড্যান্স ছাড়া কোন নবীন বরণ হবে না।”
রিয়াজ তখন আমতা করে বলে, “দেখ চৈতালী বাসের রিহার্সালে একবার পোল ড্যান্স এর ডেমো দেখাইলাম। সেদিন থেকে চৈতালীতে আমি ব্যানড। এখন বৈশাখী তে করে মিরপুর যাওয়া লাগে। তোদের ব্যাপারটা কনসিডার করতাম কিন্তু আমার ওস্তাদ মিঠুনদা বলে গেছেন বাস হারালে বাস পাওয়া যায় রে পাগলা, ডিপার্টমেন্ট হারালে ডিপার্টমেন্ট পাওয়া যায় না-” এ সবকিছু শেষ হয় ফারহানার সূচনা বক্তব্য দিয়ে, ”দোস্ত, আমার স্পিচ টা একটু শুনে বল তো কিরকম হল।” আমি যতই বলি ভালো, ফারহানা ততই বিরক্ত হয়, “ভাই তুই শুধু দুই লাইন শুনে ভালো বলে চিল্লাচ্ছিস কেন। পুরাটা শুন।” আমাকে বাঁচায় নিয়াজ, ফারহানার প্রতিটা লাইন মনোযোগ দিয়ে শুনে (কানে ইয়ারবাডস রেখে)।
ক্যাম্পাস থেকে ফিরেও শান্তি নাই। প্রভা, মাইশা আর রিশা মিলে সমান হারে নাচের পারফরমেন্সের রিল স্প্যাম করতে থাকল। এদের অত্যাচারে কোনো গ্রুপে আর ঢুকা যায় না। যতোই দিন যায়, আশেপাশের সবার উৎসাহ তত বাড়তেই থাকে। সায়েমা, মাইশা, রিশা, সামিহা, তাবাসসুম, জারিন তাসনিম, আরিশা, সাবিহা, সুমাইয়া সবাই মিলে বেশ কয়েকটা নাচ তুলে ফেলল। ক্লাসের এক চিপা থেকে দেবদার গান বাজাই আমি আর সাজিদ। আরেক চিপায় রিয়াজ পলকের মধ্যে নাচ তুলে ফেলে। রিয়াজের সাথে যোগ দেয় রিভু্। শাহরিয়ার একটা নাটক বানাতে চাইলো। নাটকের প্লট হল এক লোকের অনেক প্রাক্তন বান্ধবী এজন্যে তার অনেক কষ্ট। প্রাক্তন বান্ধবীর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সে ক্লাসের সব মেয়েকে রাত বিরাতে টেক্সট দেয়া শুরু করল। কেউ রাজি না হওয়ায় রিহার্সালের সময় বিমর্ষ হয়ে বসে থাকল। ধুর কিসের ডিপার্টমেন্ট কেউ কাছের বান্ধবী হতে চায় নাহ!
আমি বরাবরই সমাজবিরোধী মানুষ। নবীন বরণের মতো “সামাজিক” অনুষ্ঠান থেকে তো আরো দূরে থাকার চেষ্টা করি। এবার কেন যেন দূরে থাকতে ইচ্ছা হল না আর। হয়তো অনুষ্ঠানটার জন্য, কিংবা মানুষগুলোর জন্য, কে জানে! আস্তে আবিষ্কার করলাম আমিও রিয়াজের সাথে নাচের তাল মিলাচ্ছি। দিয়া, অর্ণা, নিয়াজ, মাইশার সাথে গানের প্র্যাকটিস করছি। যৌথ নাচের প্র্যাকটিসে পা মিলাচ্ছি। আমার স্টেপ ভুল হচ্ছে, সুমাইয়া বিরক্ত হচ্ছে, রিয়াজ উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে হবে হবে, কোমরটা আরেকটু- দিন যতো যায়, উৎসাহ আর সমস্যা সমানতালে বাড়তে থাকে। আমি আর সাজিদ মিলে কয়েকটা নাটক আর অভিনয়ের স্ক্রিপ্ট বানালাম। ওয়াসিউর ভাই সেগুলো পড়ে নাকচ করে দিলেন আর বললেন এগুলা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। নাচের আগ্রহ আছে সবারই, কিন্তু প্র্যাকটিসের সময় দলের অর্ধেকের বেশি মানুষ উধাও হয়ে যায়্। ছুটির দিনে প্র্যাকটিসের সময় একজনের বিড়াল মারা যায়, একজনের কুকুরের জন্ডিস হয়। ঠিকঠাক কাউকে পাওয়া যায় না। সিনিয়র কো-অর্ডিনেটররা ডেডলাইনের প্রেশার দেয়। ট্রায়ালের দিন দেখা গেল আমাদের নাচের পারফরম্যান্সের অর্ধেকের বেশি গান অন্য ব্যাচ নিয়ে নিয়েছে। আমাদের নতুন গান লাগবে। এছাড়া স্টেজ অনুযায়ী আমাদের নাচের ফরমেশন নাকি ঠিক হয় না। আরো অনেক সমস্যা, সবকিছু মনেও নাই ঠিকমত।
সমস্যা রেখেই সবকিছু চলতে থাকল। কাজী শফিক আলম আর আরিয়া মিলে সিনিয়রদের সব বকাঝকার ভার নিল। মাইশা নিজের নাচ বাদ দিয়ে ফরমেশন ঠিক করতে লেগে গেল। সুমাইয়া আর রিয়াজের নেতৃত্বে নাচের দলের সবাই জানপ্রাণ দিয়ে নতুন গান খোঁজা শুরু করল। আমি “প্যায়ার কা বুখার”, “অভদ্র প্রেম” এর মতো কিছু গান সাজেস্ট করে চরম অপমানের শিকার হলাম (পরের বার এমন করলে আর নাচবো না ভাই)। নবীন বরণের আগের দুইদিন রাস্তাঘাটে নাচানাচি শুরু করে দিলাম সবাই। আচ্ছা না, রাস্তাঘাট কথাটা খারাপ শুনায়। কিন্তু এমন জায়গা নাই যেইখানে আমাদের পা পড়ে নাই। টিএসসি থেকে শুরু করে অ্যানেক্সের মাঠ, ল ডিপার্টমেন্টের বারান্দা থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল ফিল্ড-সবজায়গায় দেবদার গান বাজা শুরু করল। জনশ্রুতি আছে বাসের ভেতর নাচানাচি করায় রিয়াজ নাকি বৈশাখী বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। আমি আর সাজিদ আরো বেশি সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য স্ক্রিপ্ট বানানো শুরু করলাম আর সেগুলো আরো বেশি কঠোরভাবে নাকচ হতে থাকল। বড় ভাইয়েরা সবাই মিলে থ্রেট দিল আমরা যাতে কোনোদিন কোন নাটক/স্ক্রিপ্ট এর সাথে জড়িত না হই। অবশ্য মিনহাজুল ভাই আমাদের স্ক্রিপ্ট দেখে খুবই উৎসাহ পেলেন (ভাই বলেছে সামনের বছর এইসব সামাজিকভাবে অগ্রহনযোগ্য নাটক নামানোর ব্যবস্থা করে দেবেন)।
প্র্যাকটিস মোটামুটি হলেও, স্যার ম্যাডামদের সামনে ট্রায়াল দেখানোর সময় সবকিছুর ধ্বস নামল। ধ্বস নিয়ে আহাজারি করার সময় নাই, সবাই জানপ্রাণ দিয়ে সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করল। কয়েকটা মেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। কয়েকটা ছেলেদের নিজেদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল। আরো অনেক কিছু হওয়া শুরু করল কিন্তু নাচ থামল না। একটাই তো নবীনবরণ। নিজেদেরই তো, নাকি!
নবীনবরণের দিন কী হল, সেটা বলার সামর্থ্য আমার নাই। কারোরই নাই হয়তো। কতো হাজার ছবি আর ভিডিও ক্লিপে সেটা বাঁধাই হয়ে আছে কে জানে। শুধু মনে আছে নবীন বরণের সন্ধ্যাটা শেষ হয় নাই। ওই সন্ধ্যা ওই জায়গায়ই স্থির হয়ে আছে। মাঝে মাঝে ছবি বা ক্লিপ দেখি( নিজে উল্টাপাল্টা স্টেপ ভুলের কারণে দেখতে ইচ্ছা করে না, কিন্ত অন্যরা নিশ্চয়ই দেখে)। ওই সন্ধ্যা আবার জীবন্ত হয়ে উঠে। ওইদিন একেকটা ব্যাচের পারফরম্যান্স তখন সবার পারফরম্যান্স হয়ে গিয়েছিল। নবীনবরণ তো ব্যাচের হয় না, হয় ডিপার্টমেন্টের। এবারের মটো ছিল “তুমি যেন থাকো বন্ধু চিরকাল নবীন” সাউন্ড সিস্টেমে বাজতে থাকে দেবদার গান, ব্যাচভেদে মঞ্চের সবাই নবীন হয়ে যাই। সাহিত্যের একটা উক্তি আছে, ওইটার অনুকরণে বলি নবীনবরণ কখনো শেষ হয় না, আমরা তাকে অপূর্ণ রেখে আসি। পরের বছর ওই অপূর্ণ জায়গা থেকে আবার শুরু হবে।
হবে তো!?
পুনশ্চ ১: মাইশা আর সাবিহাকে এই লেখাটার অল্প একটু পড়তে দিয়েছিলাম। দুইজনই পড়ে বললো ছাপানোর অযোগ্য লেখা হয়েছে। রীতিমতো অখাদ্য।
পুনশ্চ ২: মূল অনুষ্ঠানের দিন ফারহানার বক্তব্য পুরো শুনলাম। আসলেই পুরোটা ভালো হয়েছে।
পুনশ্চ ৩: ব্যাকস্টেজে রিহার্সালের সময় আমি হুট করে অনেকগুলো স্টেপ ভুলে গেলাম। অবাক করার মত ব্যাপার ঘটল, সুমাইয়া বিরক্ত হল না। এমন করুণভাবে তাকিয়ে থাকল যে আমার মায়া হওয়া শুরু করল।
পুনশ্চ ৪: নবীনবরণ শেষ করে অনেক রাতে বাসায় ফিরলাম। আম্মু রেগে জিজ্ঞেস করল খালি যে নাচানাচি করছ, পড়াশুনার কী অবস্থা?
আমি মুখ ফস্কে বলে ফেললাম, ঝিংকু-
- শাহেদ উন নবীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%a6-%e0%a6%89%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a6%ac%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪