মার্চ ১৯, ২০২৫

একজন কোবাদ আলী

দেশ এক অদ্ভুত সময় পার করছে, স্বৈরশাসকের পতন ঘটলো প্রায় দেড় যুগ পরে। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পুরো দেশের সবকিছু। পুলিশ প্রশাসন নেই দেশে, নেই ট্রাফিক পুলিশেরাও। সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে শিক্ষার্থী, আমজনতারা। শিক্ষার্থীদের অপটু হাতে সেই কন্ট্রোলিং পুরস্কারস্বরুপ তারা শুরুতে পেয়েছে মানুষের স্নেহ, বাহবা আর শ্রদ্ধা। দুদিন গড়িয়ে যাওয়ার পরে হয়তো কিছু যৌক্তিক কারনেই তাদের সমালোচনা হচ্ছে। তবে সেসবকে নেতিবাচক হিসেবে নেয়ার প্রয়োজন নেই। তারা ভুল শুধরে এভাবেই পথ দেখাতে থাকুক যতদিন না ফিরে আসে এখানকার দায়িত্বশীলরা। চারদিকে যখন ট্রাফিক পুলিশ নিয়ে এতো কথা হচ্ছে, তখন আমি একটা গল্প মনে করতে পারি।

তখন আমি ক্লাস এইট অথবা নাইনে পড়ুয়া। আমাদের বাসা বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে মুক্তারপুরে আমরা গাড়ি বদল করতাম। মুক্তারপুর থেকে লেগুনায় করে আমাদের বাকি পথ টুকু পাড়ি দিতে হয়। তেমনি একদিন আমি একা ফিরছিলাম। লেগুনায় উঠে বসে আছি, যাত্রীপূর্ন হলে গাড়ি চলবে তাই। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ডিউটিরত একজন ট্রাফিক পুলিশ। প্রথমেই চোখ গেলো তার নেইম-প্লেট এ, একটু অদ্ভুত নামটা। যেই নাম সচরাচর আমাদের আশেপাশে দেখি না। কিছুক্ষণ পরে উনি আমার সাথে কথা বললেন, হয়তো ছোট্ট বাচ্চা একা ভ্রমন করছিলো বলেই (আমাকে বয়সের তুলনায় বেশি বাচ্চা মনে হতো)। আমার নাম জিজ্ঞেস করলো, কোথায় পড়ি জিজ্ঞেস করলো। তারপর যখন শুনলো আমি তারই ছেলের বয়সী, আমরা পাশাপাশি স্কুলেই পড়াশোনা করি, তারপর আরো অনেক কথা বললো, এবং এতো স্নেহের সাথে! একটা শসা কিনলেন, আমি খেয়েছিলাম কিনা মনে নেই এতদিন পরে। তারপর ঐ পথে যাওয়ার সময় হুট করে হয়তো মনে পরতো তার কথা, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতাম আছেন কিনা। একদিন দেখলামও দূর থেকে, কথা হলো না অবশ্য।

একদিন কাচারি দিয়ে বাড়ি ফিরছি, খুবই আনন্দচিত্তে। কারন ঐদিন JSC পরীক্ষার স্কলারশিপের রেজাল্ট হয়েছিলো। হঠাৎ দেখলাম ঐ ট্রাফিক আঙ্কেল টা, উনার গায়ে পোশাক নেই, নেইম-প্লেট নেই, তবুও আমি চিনলাম, উনিও আমাকে চিনলেন। ছোট্ট আমি আনন্দের আতিশয্যে বললাম, “আঙ্কেল আমি বৃত্তি পাইছি”! উনি এতো খুশি হলেন। ঐদিনও আমাদের কথা হইলো, উনি বারবার বললেন, ” আম্মু, আবার মুক্তারপুর দিয়ে যাওয়ার সময় আমার সাথে দেখা করবা কিন্তু”। বললো, উনার ছেলেকে নিতে আসছেন। অনেক দোয়া করলো আমি যেনো অনেক বড় হই একদিন। তারপর কি আমাদের আর দেখা হয়েছিলো? মনে নাই আসলে।

একদিন রাতে সবার মুখে মুখে শুনলাম, মুক্তারপুরে একজন ট্রাফিক পুলিশের এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে, মানুষটা দেখে নাই যে ব্রীজ থেকে ট্রাক নেমে আসছিলো, পায়ের উপর দিয়ে চলে গেছে ট্রাকের চাকা। একটা ভয় সাথে সাথে আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি বারবার নাম জিজ্ঞেস করলাম, কেউই জানে না। পরদিন সকালে উঠেই দে ছুট পত্রিকার দোকানে, সভ্যতার আলো খুলেই প্রথম পৃষ্ঠায় মানুষটার ছবি, গায়ে পোশাকটা একদম ফিটফাট, নেমপ্লেটে সেই অদ্ভুত নাম “কোবাদ” লেখাটা অক্ষত। শুধু উরু থেকে পা দুটোর কোনো চিহ্ন নেই।চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু গড়াচ্ছিলো, কথা বলতে পারছিলাম না।

আমি তখনো বেশ ছোটো, আমার কাছে মোবাইল ইন্টারনেট ছিলো না। আমি জানতাম না কোথায় যেয়ে জানা যাবে মানুষটা সুস্থ আছে কিনা, আদৌ বেঁচে আছে কিনা। কি এক হাহাকার নিয়ে কাটতো কিছু দিন। তারপর আমি প্রায় ভুলতে বসেছিলাম।একদিন দেখলাম মুক্তারপুরের পুলিশ বক্সটার নামকরন করা হলো ‘কন্সটেবল কোবাদ আলী ট্রাফিক পুলিশ বক্স’  এই পুলিশ বক্সটা হয়তো আমাকে কখনো ভুলতে দিবে না। আমি এরপরে বহুবার ভেবেছি কোনোভাবে উনার পরিবার পর্যন্ত পৌঁছানো যায় কিনা! আমি পারিনি অবশ্য আজও।

আশেপাশে ট্রাফিক পুলিশ নিয়ে এতো কথায় আবারো মনে পরলো, মনে হলো এই গল্পটা বলে ফেলা দরকার। আর এই যে নতুন প্রজন্মের অ্যামেচার ট্রাফিক পুলিশেরা, তাদের জন্যে একটাই অনুরোধ, এমন কোনো ঘটনা না ঘটুক, কোনো সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটুক। শিক্ষার্থীরা যেভাবে সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে, তেমনি করেই সংস্কার করুক পুরো দেশটা। প্রাপ্তবয়স্ক দায়িত্বশীল মানুষ বিশেষত কলেজ বা বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেনো এই কাজে নিয়োজিত থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা দেখছি যেখানে একজন ট্রাফিক পুলিশ কাজ করতো সেখানে প্রায় চার-পাঁচ গুন শিক্ষার্থীরা জমায়েত হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছাড়াও রাস্তার মাঝে তারা গাড়ি থামিয়ে চেকিং করছে, যা অনেক বেশি সময় নষ্ট করছে এবং যাত্রীদের ভোগান্তির কারন হচ্ছে। আশা করবো, এই ছোটো-ছোটো ভুল গুলো খুব দ্রুতই সকলে উপলব্ধি করে শুধরে নিবে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করবে যতদিন না রাস্তার দায়িত্বে হাজারো কোবাদ আলী-রা ফিরে না আসে।

0814 last