fbpx
বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচার পতন

আন্দোলনের মূলধারার মিডিয়ার খবরাখবর সবাই জানেন এবং সব তথ্যই হাতের নাগালে। তাই রাজনৈতিক সব দিক ও ঘটনা উল্লেখ না করে বরং বর্ণনা করা যাক যে কীভাবে আমার মত একজন সাধারণ ছাত্র, যার সরকারি চাকরিতেও কোনো ঝোঁক নেই, সে জড়িয়ে গেলো এই আন্দোলনের সাথে এবং তার চোখে কী ঘটলো প্রতিদিন তারই এক অনুভূতি।
জুনের কোনো একটা দিনে হুট করেই হাইকোর্টে করা রিট এর শুনানি যেখানে পুরনো বৈষম্য প্রথা কোটা পুনর্বহাল রাখা হলো। আমার কিছু বিসিএস প্রিপারেশন নেওয়া বন্ধুরা দেখলাম একদম ভেঙ্গে পড়লো যে এবার বোধহয় আর সম্ভব না তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরি। কেন? কারণ উদঘাটন করতে গিয়ে বুঝলাম কি চরম মাত্রায় অন্যায় এই প্রথা। ৫৬% ই কোটার দখলে; যেখানে ৩০ শতাংশই মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনীর জেনারেশন কোটার সুবিধা পাবে। এমনকি ৫৬% পূরণ না হলে সেই আসন ফাঁকা ই থেকে যায়। এ তো বিসিএস। আরও অনেক নিয়োগ পরীক্ষায় এই কোটা বৈষম্যের হার আরও বেশি। মনে হলো ’১৮ এর মতো রাস্তায় নামার সময় আবার হলো।

১লা জুলাই থেকেই বোধহয় ধীরে ধীরে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়ে। নিজের সরকারি চাকুরীর ব্যাপার গুলো পছন্দ না থাকলেও বিবেকের কাছে এই প্রশ্ন থাকে যে আন্দোলন তো নিজের জন্যই করতে হবে তা নয়। বন্ধুদের জন্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে হবে এই আন্দোলন। স্বার্থই যদি সবাই দেখার চেষ্টা করি তাহলে নিজের প্রয়োজন যখন পড়বে তখনো কাউকে পাশে পাবো না। আমার মতো চিন্তা করেছিল হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী।

স্লোগানসমূহঃ “দফা এক, দাবি এক / Quota not comeback”, “সংবিধানের মূলকথা, সুযোগের সমতা”, “৫২র হাতিয়ার, গর্জে উঠো আরেকবার”, “আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই”, কোটা না মেধা? মেধা, মেধা। (কি সাধারণ অধিকারচেতা স্লোগান, তাই না? )

সরকার যখন এই কোটা সংস্কারে ভ্রূক্ষেপ ই করছে না তখন আন্দোলন তরান্বিত করতে ডাক দেওয়া হলো “ব্লকেড” কর্মসূচীর। হাজার ছাত্রের ঢল আসে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে। গন্তব্য থাকে শাহবাগ। এই বিশাল ঢলের সামনে পুলিশের ব্যারিকেড অসহায়। দুই মিনিটের মধ্যে ভেঙ্গে যায়। ঢাবির পাশাপাশি আন্দোলনে ঢাকার অন্য দুই পাবলিক ইউনিভার্সিটি জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সারাদেশ থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংহতি জানালে সেটা আর ঢাকার ব্লকেডে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে যায় “বাংলা ব্লকেড”। এবার সরকার পক্ষ একটু নজর দেয়, শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যেতে বলে। বলা হয় আদালতের রায় এর ব্যাপারে তারা তো হস্তক্ষেপ করতে পারে না (যেন ওদের মতো আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দ্বিতীয়টি নেই)। তবে এদেশের আপামর জনতা জানে যে এসব গুরুত্বপূর্ণ রায় হয় সরকারেরই মদতে। এর মাঝেই আবার ১০ই জুলাই আপিল বিভাগ এর রায় হয় ১ মাসের স্থিতাবস্থা জারি করে। সরকার পক্ষ এবার যেন আদালতের সবচেয়ে অনুগত অনুসারী। তবে শিক্ষার্থী-সমন্বয়করা ভালো করেই ’১৮-এর মূলা ঝোলানো ইতিহাস মনে রেখেছে। মনে রেখে তাদের দাবি হলো সরকারি হস্তক্ষেপে পার্লামেন্টে পাশ করানো এই রায়। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলও চায় না। চায় ন্যায়সঙ্গত সংস্কার।

এভাবে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী চলে। জনদুর্ভোগ হচ্ছিল ঠিকই, তবে যদি জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল শাসক হতো, তবে এই দুর্ভোগ লাঘবে আলোচনায় বসতো। কিন্তু মন্ত্রীপরিষদের ব্যক্তিরা উস্কানিমূলক মন্তব্য ছাড়া কিছুই করে নি। এইদিকে এক সাধারণ ছাত্র আমি, আমার বন্ধুদের নিয়ে মাঝে মধ্যেই যাই, ব্লকেড সফলে কাজ করি সারাদিন। আমার যেই বন্ধুদের নিয়ে কাজ করি এদের বেশিরভাগই হয় বিদেশে যাবে বা কর্পোরেট লাইনের প্রতি আগ্রহী। এমনকি একজনের স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধা কোটাই আছে। কিন্তু সবারই এই পরিশ্রম যেন ন্যায়সংগত সুযোগ পায় আমাদেরই বন্ধুরা।

১৪ জুলাই,

এক সাংবাদিকের উস্কানিমূলক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য এমন ভাবে করেন যেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যতীত সকলে মূলত রাজাকারেরই সন্তান! অথচ, অধিকারের আন্দোলন করে সারাদিন রোদে পুড়ে এসে আমরা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে আমরা শুনতে পাই আমরা নাকি রাজাকার। সে রাতে ক্ষোভে ফেটে পড়লো ছাত্র-ছাত্রী, ঢাবির সব হল থেকে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে দলকানা বাদে সবাই তখন রাজু ভাস্কর্যে। প্রহসন করে (সঠিক ভাষায়, সার্কাজম ) স্লোগান দিলো “তুমি কে, আমি কে? রাজাকার রাজাকার” সেই সাথে আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ লাইন ছিল যেটা সরকার বা মিডিয়াপক্ষ সে সময় সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে, “কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার”। “চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার”। এই প্রথম ছাত্রসমাজ থেকে খোলাখুলি ভাবে স্বৈরাচারকে স্বৈরাচার সম্বোধন। আঁতে ঘা লাগে ওদের। প্রোপাগান্ডা চালায় যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজাকার বলছে। অথচ কতটা ক্ষোভ থেকে আসে এই স্লোগান তা যদি তারা জানতো। ক্যাডার বাহিনীকে অনুমতি দেয় মাঠে নামার। কিন্তু ক্যাডার বাহিনীর লোক কোথায়? যাদেরকে দিয়ে এতদিন জোরপূর্বক এসব প্রোগ্রাম করাতো তারাই তো কোটা আন্দোলনে।

১৫ই জুলাই,

ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশ, একই দিনে ছাত্রলীগের সমাবেশ। অনেকেই আঁচ করতে পারছিল কী হতে যাচ্ছে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা খবর পায় বিজয় ৭১ হলে আটকে রাখা হয়েছে ছাত্রদের। তাদেরকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে যায় একটি দল। শুরু হয় ছোট সংঘাত। ছোট সংঘাত সেখানেও শেষ হয়ে যেতে পারতো। আকস্মিক টোকাই বাহিনী এনে অনিরাপদ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ প্রথম নির্লজ্জতা, কাপুরুষতার চরম মাত্রা দেখাতে করে মেয়েদের উপর আক্রমণ। করে মাথা সই করে ইট নিক্ষেপ। সাধারণ ছাত্ররা তো সন্ত্রাসী না। প্রতিরোধ এর বদলে তাই প্রাণ বাঁচাতে আর নিজেদের বন্ধু বান্ধবীর নিরাপত্তার নিশ্চিতে পিছু হটে সবাই। সেইদিনের ভুক্তভোগী আমি ও আমার বন্ধুরা। প্রাণ ভয়ে পালানো, ইট লাঠির আঘাত, জুতা ছেঁড়া, হাত পা কাঁটা, সব কিছুরই এক অভিজ্ঞতা হয়ে যায় আমাদের নিতান্ত আনাড়ি দলটির। ট্রমাটাইজড হই। ফুঁসলে উঠি। ভেবে পাই ই না যে কীভাবে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাই-বোনদের বাহির থেকে টোকাই দিয়ে আক্রমণ করতে পারলো ছাত্রলীগ নামধারী সরকারি সন্ত্রাসবাহিনী। আক্রমণের শিকার হই বাড়ি ফেরার পথেও। দোকানে আশ্রয় নিই। তারপর কোনোভাবে অনেক এলোমেলো রুটের বাসে করে বাড়ি ফিরি। কিন্তু এদিকে ক্যাম্পাসে কুরুক্ষেত্র। টোকাই বাহিনী হলে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শহীদুল্লাহ হল যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের শিকার হবে। এই প্রথম গড়ে উঠে প্রতিরোধ। সায়েন্স পাড়ার তিনহল এক হয়। ঝেটিয়ে বিদায় করে টোকাই বাহিনীকে। আমরা ঘরে ফিরে ফেসবুকে রক্তাক্ত ক্যাম্পাসের ছবি দেখি। তীব্র ঘৃণা জন্ম নেয় ছাত্রলীগ নামের এই সন্ত্রাস বাহিনীর প্রতি। আর ছাত্রলীগ তো সেই স্বৈরাচারেরই এক সন্তান বলা চলে। তাই অনুমান করাই যায় আস্তে আস্তে রাগ কোথায় গিয়ে উঠবে।

১৬ই জুলাই,

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আজকের বিক্ষোভ থাকে শহীদ মিনারে। সবাই প্রস্তত লাঠি সোটা আর হেলমেট নিয়ে। সাধারণ ছাত্ররা আজ প্রতিরক্ষা প্রতি-আক্রমণ শিখে গেছে। ক্যাম্পাসে আর কিছু করার সাহস পেল না ছাত্রলীগ। এদিকে আক্রমণের প্রতিবাদের সারাদেশে এমনকি স্কুল কলেজ থেকেও শিক্ষার্থীরা নামে মাঠে। কিন্তু সেদিন ঘরে ফিরে এমন কিছু দেখি যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। লাঠি সোটা নিয়ে ছাত্ররা তো প্রস্তুতই। মার খেতে, হাত পা ভেঙে হাসপাতালে যেতেও রাজি। এতদিন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা ছিল, নীরব দর্শকের। আর আন্দোলনকারী দের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ এর ভূমিকা কি হতে পারে? লাঠিচার্জ? অনেক উগ্র আন্দোলনকারী হলে ছররা গুলি? মানবাধিকার এতটুকুই অনুমতি দেয়। আমরাও এটাই বিশ্বাস করতাম। আমাদের মতো পুলিশ বাহিনীকে এমনই বিশ্বাস করেছিল রংপুরের আবু সাঈদ। নিরস্ত্র অবস্থায় বুক পেতে দেয়। কারণ সে জানে এই ক্ষেত্রে পুলিশ হয়তো তাকে এরেস্ট করবে, হয়তো লাঠিচার্জ করবে, সঙ্গীরা পালাতে পারবে। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর মধ্যে ততদিনে এসে গেছে খুনের নেশা। গুলি চালায়। হতভম্ব হয় আবু সাঈদ, হতভম্ব হই আমরা। এই পুলিশ বাহিনীর প্রতি বিশ্বাস এক সেকেন্ডে ভেঙ্গে যায়, আবু সাঈদ তবুও পিছপা হয় না। ঢলে পড়ে। আবারও গুলি চলে; তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে। (ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করি) দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমনই ৬জনের মৃত্যুর খবর পাই। কেঁপে উঠে সারাদেশ !

ঢাবির হলে জ্বলে উঠে আগুন। সবকিছুর শুরু তো ছাত্রলীগ দ্বারা এই ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলায়। হামলা পরিচালনাকারী প্রতিটা ক্যাডারের উপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের এতদিনের জমানো ক্ষোভ এর বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। হল থেকে বের করে দেয় প্রতিটি হল ক্যান্ডিডেটকে। যারা এতদিন হলে আশ্রয়ের ব্ল্যাকমেইল করে সব করতে বাধ্য করতে শিক্ষার্থীদের, আজ সেই হলের ছাত্ররাই তাদের অন্যায়কে প্রশ্রয় আর না দিয়ে বরং সেই অত্যাচারী আশ্রয়দাতাদেরই আশ্রয় সংকটে ফেলে দিল। (১৫ জুলাই রাত থেকেই এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ) সরকার যেই মুহূর্তে বুঝতে পারলো পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে নেই। তাদের সবচেয়ে বড় ভরসার গুন্ডাবাহিনী মাত্র একদিনেই ফল করেছে, সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলো !

১৭ই জুলাই,

পুলিশি হামলায় মৃত্যুতে ক্ষেপে উঠে সারাদেশ। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আগের রাত থেকেই ক্যাম্পাসে মোতায়েন হয় পুলিশ-বিজিবি !! ছাত্ররা মূলত করে কফিন মিছিল। আর কতটা নিকৃষ্ট হলে সেই কফিন মিছিলের মতো শান্তিপূর্ণ এক মিছিলে ছুঁড়ে টিয়ারশেল ও গ্রেনেড। আমিসহ অনেক বন্ধুই সেদিন শহীদুল্লাহ হলে। ক্যাম্পাসের হল যাতে বন্ধ না হয় সেই চেষ্টায়, কিন্তু ব্যর্থ। ’৭১ এর শরণার্থীর মতো অজানা আশংকায় হল ছেড়ে আসতে হয়, কষ্টে বুক ফেটে যায় যেন; তবে আমাদের আন্দোলন শেষ? আমরা ব্যর্থ?

১৮ই জুলাই,

শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেয় কমপ্লিট শাটডাউনের। আজকের স্লোগানঃ “আমার ভাই মরলো কেনো? ” পাঠকরা শুধু স্লোগানের পরিবর্তন খেয়াল করুন। কি সাধারণ চাওয়া, স্বাভাবিক অধিকারের এক আন্দোলন, সেখান থেকে আজ প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে কেনো অধিকার চাইতে গিয়েও মৃত্যু? যেহেতু ঢাবি জাবি বন্ধ, আমরা অনেকে এটাই ভেবেছি আন্দোলন শেষ। তবে অবাক করে দিলো সব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। অবাক করে দিলো সব কলেজের শিক্ষার্থী। এদের কারোই কিন্তু কোটার সাথে ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই। এদের একটাই ক্ষোভ, ”আমার ভাই মরলো কেন? প্রশাসন জবাব চাই ”। প্রশাসন জবাব দিলো। বুলেট আর টিয়ারশেল দিয়ে। আমার বন্ধুর পিঠে লাগলো ২৫ টা ছড়রা গুলি। পায়ে লাগলো রবার বুলেট। আরও অনেক জায়গায় আমার বন্ধুরা ভুক্তভোগী টিয়ারশেল এর। ( নিজেও বিকেলে অংশ নিয়ে টিয়ারশেল এর স্বাদ গ্রহণ করে এসেছি)। আমি ভয় পেলাম। প্রচণ্ড ভয়। লাঠির জবাব লাঠি দিয়ে দেওয়া যায়। গুলি আর গ্রেনেড এর জবাব কি দিয়ে দিব? জীবন? দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরুতে এভাবে আক্রমণ চালায় পুলিশ। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এবং একের পর এক ছাত্রের লাশ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। করে পাল্টা আক্রমণ। এমনই আক্রমণ যে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীও পিছু হটতে বাধ্য হয়। ব্র্যাক-ইস্ট ওয়েস্টসহ বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর আসে। খবর আসে বিইউপি, এমআইএসটি-এর। খবর আসে শনির আখড়ার। খবর আসে উত্তরার। খবর আসে মতিঝিলের। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় দেশ। মৃত্যু হয় পানি বিতরণ করতে গিয়ে। চোখে গুলি খায় ৬ বছরের বাচ্চা। মৃত্যু হয় রেসিডেনসিয়াল কলেজ শিক্ষার্থীর। মৃত্যু হয় দেশের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের। সেই সাথে উস্কানিমূলক বক্তব্য চলে বিভিন্ন মন্ত্রীর। ওবায়দুল কাদের দাবি করেন যে ছাত্রলীগ নাকি ফুঁ দিয়েই উড়িয়ে দিতে পারবে ছাত্রদের (অথচ একদিনের মধ্যে আমরা ছাত্রলীগ মুক্ত করি ক্যাম্পাস)। আরেক মন্ত্রী ছাত্রদের দাবি করেন নেশাগ্রস্থ! ছাত্রদের দাবি এখন শুধু কোটাতেই আর সীমাবদ্ধ নেই। এত খুন হত্যাযজ্ঞের পর প্রহসনের আলোচনায় ডাকে সরকার। কিন্তু কাদের সাথে আলোচনা? শহিদ ভাইদের বুকে পারা দিয়ে খুনির সাথে আলোচনা হতে পারে না। বিচার চেয়ে ছাত্ররা পেশ করে তাদের দাবি। এতো মৃত্যুতেও যখন সরকারি পেটোয়া বাহিনী জিততে পারছে না তখন সরকার বন্ধ করে ইন্টারনেট। দেশের মানুষ অন্ধকারে!

১৯শে জুলাই,

শুধু শুনেছি অনেক গণ্ডগোল। রাতে শুনলাম কারফিউ জারি!

এর মাঝে কোনো একদিন কোটা সংস্কার করে আপিল বিভাগ রায় দিল। কি বিচিত্র! সরকার প্রমাণ করলো যে আদালতের রায় আসলে তাদের হাতেই। শুরু থেকেই ছিল যখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এই দাবি মেনে নিতেন? কেন ঝরালেন এত প্রাণ? এখন এই কোটা সিস্টেম দিয়ে কি করবো আমরা?

এইদিকে কারফিউ আর নেট শাটডাউনের মধ্যে শুধু সব এলাকায় শুনা যায় গুলি আর অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজ। হেলিকপ্টার থেকে গুলি, রাস্তা থেকে গুলি, ছাদ থেকে গুলি ! কিছুই জানি না কি হচ্ছে।

২৪ শে জুলাই,

ইন্টারনেট ফিরে এলো। কিন্তু একি! ইন্টারনেট খুলে ১৫ মিনিট স্ক্রল করতে পারলাম না। পিশাচের দল এই ৬ দিন কি নারকীয় তাণ্ডব করেছে একের পর এক উন্মোচন হলো ভিডিও তে! উন্মাদের মত রক্তের নেশায় পুলিশ আর র‍্যাব চালিয়েছি পাকিস্তানি বর্বরতা (বা তাদেরকেও হার মানায়) বিভিন্ন স্থানে দিয়েছে গণকবর। মেডিকেল ভর্তি কেবল গুলিবিদ্ধ লাশ! অফিশিয়ালি মৃতের সংখ্যা ২৫৬ কিন্তু বেশ অনেক রিপোর্ট বলছে এই মৃতের সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি হবে। ছোট বাচ্চা ছাদে হেলিকপ্টার দেখতে গিয়ে গুলি খায়, বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিয়ে গুলি খায় অন্তঃসত্ত্বা মা। রাস্তায় পথচারী গুলি খায়। গুলি খায় আন্দোলনকারী। বেঁচে থাকাই যেন অনেক বড় জুয়া যার পক্ষের Odds অনেক ছোট। ১৫ মিনিটেই এতকিছু দেখলাম। আর সম্ভব হলো না চালানো। সমন্বয়করা ৪ দফা জানালো। দাবিগুলো শুনলে অবাক হবেন। হত্যা বন্ধ, গ্রেফতার বন্ধ, হত্যার বিচার। এগুলো নাকি দফা আকারে দাবি পেশ করা লাগে এবং এ দাবিও খুনি সরকারের কাছে মেনে নেওয়ার মতো হয় না। তাদের কথা “কোটার দাবি তো মেনে নিলামই আবার কি চাও?” প্রথমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ট্যাগ দেওয়া হয়েছিলো রাজাকার। এবারের ট্যাগ জামায়াত শিবির। এই ট্যাগ দিয়ে চলে আরেক দুঃসহ গণগ্রেফতার অভিযান।

২৫ থেকে ২৯শে জুলাই,

গণগ্রেফতার এর প্রথম একদিনেই ২০১ টি মামলায় প্রায় ২২০০ জন কে আটক করা হয়। আমরা পরিচিত হই “ব্লক রেইড” নামক এক নতুন ইংরেজি শব্দের সাথে। একটা এলাকার চারপাশ আটকে রেখে সমগ্র বাড়ি বাড়ি তল্লাশী। বিএনপি জামায়াত নেতাকর্মীসহ নির্বিচারে সাধারণ ছাত্রদের গ্রেফতার ও হয়রানি। আমার আরেক বন্ধু শিকার হয় এই হয়রানির। মনে এবার গেঁথে গেলো স্থায়ী আতংক প্রতিদিন ফেসবুকে একেক এলাকায় ব্লক রেইড এর খবর শুনি। সাইরেন শুনলে চমকে উঠি। রাতে আর ঘুমাতে পারি না এখন। প্রতি মুহূর্তে আতংক। এই বুঝি পুলিশ এলো! এই বুঝি ধরে নিয়ে যাবে! ঘুমে চোখ জ্বালা করে কিন্তু এক বিরামহীন অস্থিরতায় ঘুমাতে পারে না আর। সিৎজোফ্রেনিয়া এর মতো হয়ে যায় আমার। ফোন থেকে আন্দোলন সংক্রান্ত প্রতিটা ছবি মুছে ফেলতে বাধ্য হই। মেসেঞ্জারেও অনেক মেসেজ ডিলিট করা লাগে। এমনকি সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো আমরা আন্দোলনকারীরা সকলেই কপালে পতাকা জড়াই, সেই পতাকা ও লুকিয়ে রাখতে হয়। কী অদ্ভুত! এটা নাকি স্বাধীন বাংলাদেশ? আমি জানতাম পাকিস্তানি হানাদার থেকে বাঁচার জন্য সে সময় স্বাধীন বাংলার পতাকা জনগণ লুকিয়ে রাখতো। এখন দেখছি বাংলাদেশি হানাদার পুলিশ বাহিনীর ভয়েই ৭১ এর ইতিহাস এর পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে। হানাদারের সাথে রাজাকারের মতো আছে ছাত্রলীগ বাহিনী ও কমিশনার। এরা পুলিশদের আন্দোলনকারীর বাসা চিনিয়ে নিয়ে যায়। এখানে “আমি” একক সত্ত্বা নই। আমি সমগ্র ছাত্র সমাজ। ব্লক রেইড এর এর ৪-৫ দিনে প্রায় ৯০০০ এর মতো আটক হয়। গ্রেফতার হয় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক রা। অমানুষিক নির্যাতন নেমে আসে নাহিদ ইসলাম আর আসিফ মাহমুদ এর উপর (আর আজ তারা সরকারের উপদেষ্টা)। একে একে আরও সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অত্যাচারের মুখে তাদের দিয়ে জোরপূর্বক আন্দোলন তুলে নেওয়ার “ভিডিও বার্তা” ধারণ করায়। তবে প্রজন্ম যথেষ্ট বোধসম্পন্ন। অন্যান্য সমন্বয়করা এই বন্দুকের নলের মুখে দেওয়া বিবৃতি না মানার ঘোষণা দেয়। চলতে থাকে আন্দোলন। আন্দোলনে গ্রেফতার হয় আমার দুই বন্ধু। আরেক দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে বন্ধুমহলে। গ্রেফতারের কারণ তাদের ফোনে আন্দোলনের ছবি ও পকেটে টুথপেস্ট পাওয়া! টুথপেস্ট দিয়ে নাকি এরা কেমিকাল উইপন বানাবে! কতটা অন্ধ-মূর্খ নিয়োগ হয়েছে এই পুলিশ বাহিনীতে। সারাদিন এর চেষ্টায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জোরাজুরিতে রাতে মুক্তি পায় তারা।

এর মাঝে আমাদের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেলের এক স্টেশনে কিছু কাঁচের জিনিস আর ফার্নিচারের ধ্বংস দেখে কেঁদে উঠে। এতজন ছাত্র-জনতা-শিশুর মৃত্যু যার ভ্রূকে সামান্য নাড়াতে পারে নি, সেই ব্যক্তি কাঁদে মেট্রোরেলের স্টেশনের কাঁচ দেখে। হতাশায় মনে হয়, “এর চেয়ে তো মেট্রোস্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল সেন্টার হতাম, যার মৃত্যুতে কান্না থামানো যায় না, যার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু হায় দূর্ভাগ্য ! জন্ম নিলাম ছাত্র হয়ে। যার বাঁচা মরায় যায় আসে না কারোও !

এর মাঝে এক কাজ হয়। প্রবাসীরা রেমিটেন্স শাটডাউন এর ঘোষণা দেন। বিদেশ থেকে দেশে ডলার আসা বন্ধ। ৭ দিন মিলিয়েও ১ দিনের সমান রেমিটেন্স আসে নি। বিপাকে পরে যায় সরকার। এই তো এই আন্দোলনে এতদিন জনসাধারণ এর ছিল মৌখিক সম্মতি। এখন সরাসরি অংশগ্রহণ চলছে।

তারপর, ২৯ শে জুলাই কিছু সম্মানিত আইনজীবী আদালতে রিট দায়ের করেন যেন অন্তত এই নির্বিচারে গুলি চালানো বন্ধ হয়। অর্থাৎ আবারও আন্দোলনের সাথে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ। ঐদিকে সমন্বয়কদের বন্দী থাকা অবস্থায় আন্দোলনও বেগবান হচ্ছে না আগের মতো। সেই সাথে গণগ্রেফতার অভিযান তো আছেই। তবে সরকার নিজেই ব্যবস্থা করে দেয় আন্দোলন বেগবান করার।

৩০ ও ৩১ শে জুলাই,

আচ্ছা মনে করুন, ২য় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসী বাহিনী পোল্যান্ডের এক-তৃতীয়াংশ ইহুদি হত্যার পর একদিন ঘোষণা দিল শোক পালন করার। ইতিহাসে কি এমন প্রহসনমূলক ঘটনা আছে? কিন্তু আমাদের প্রহসনের সরকার ৩১শে জুলাই শোক পালনের ঘোষণা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখান করে আপামর ছাত্র-জনতা। সরকার থেকে ঘোষণা আসে কালো ব্যাজ ধারণ করার। ছাত্র সমাজ তার বদলে বেছে নেয় রক্ত ও বিপ্লবের প্রতীক, লাল রঙ। এবার শুধু ছাত্ররা না, একে একে আইনজীবী, ডাক্তার, শিক্ষক, তারকা, সাধারণ মানুষও তাদের প্রোফাইল লাল করা শুরু করে। চিহ্নিত হয়ে যায় বিপ্লবের পক্ষের শক্তি। এই লাল প্রোফাইলের মাধ্যমে দেশের বেশিরভাগ জনগণ সরাসরি অংশ নেয় এই আন্দোলনে। সারাদেশে আজকেও নেমে পড়ে স্কুল কলেজ এর ছাত্রছাত্রী পুলিশ ও এরেস্ট করতে থাকে অহরহ। পুলিশ এক ১৬ বছরের কিশোরকে এরেস্ট করে আবু সাঈদ হত্যা মামলায়। যেখানে আমরা স্পষ্ট দেখি যে এক পুলিশের গুলিতেই নিহত হন আবু সাঈদ। চোখের সামনে প্রমাণ থাকার পরও কত বড় মিথ্যা! এমনকি ১৬-১৭ বছরের ছেলেদের ৭ দিনের রিমান্ড দেয়। যেখানে ওদের বিচার হওয়ার কথা শিশু আদালতে! এরপরও সেদিন, পুলিশ এরেস্ট করতে গেলে বাঁধা দেয় আইনজীবীরা। কিন্তু গুলি চালানো বন্ধ হয় না। একটা মানুষ মারতে কত গুলি লাগে? দাবী পরিণত হয় ৯ দফায়। খুন বন্ধ, গ্রেফতার বন্ধ, হত্যার বিচার ছাড়াও, এই নৈরাজ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মী, এমনকি মন্ত্রীদেরও পদত্যাগের দাবি উঠে। শেখ হাসিনার প্রতি দাবি উঠে ক্ষমা চাওয়ার। কিন্তু এই সাধারণ একটি কাজ কি একটা ফ্যাসিস্ট এর পক্ষে করা সম্ভব? মোটেই না! দম্ভই তার মূল।

১৮ তারিখ থেকেই অনেক এমপি মন্ত্রী নেতারা পালিয়ে যেতে থাকে। এই নিয়ে আওয়ামী লীগে হয় অন্তঃদলীয় কোন্দল। যেই পরাক্রমশালী নেতা ছাত্রদের ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, সেই নেতা নিজের দলের কর্মীদের কাছেই ভুয়া ভুয়া স্লোগান শুনে বেরিয়ে যান।

কত অপরিণামদর্শী কাজ যে করলেন এই ফ্যাসিস্ট সরকার তার হিসেব নেই। ছাত্রদের উপর গুলি চালালেন, সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালালেন, মনুষ্যত্ব নামক জিনিষ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিলেন। হিটলার-মুসোলিনীরা যা করে টিকতে পারেন নি তিনি সেই পথে টিকে যাবেন ভাবলেন কি করে? আসলে মানুষের যখন পতন আসে, পদে পদে ভুল করতে থাকে।

১লা আগস্ট (৩২শে জুলাই)

সমন্বয়কদের মুক্তি মেলে। গণগ্রেফতার চলতে থাকে। সেই গণগ্রেফতার আটকাতে এখন চলে আসে অন্য ফর্মুলা। সবাই মিলে পুলিশ এর গাড়ি আটকায়। সবাই ধস্তাধস্তি করে ছত্রভঙ্গ কাউকে ছাড়িয়ে আনে। তারকারাও ফার্মগেটে প্রতিবাদ করে। আমার হতাশায় নিমজ্জিত মন নতুন করে আশা ও সাহস সঞ্চয় করে। এই আশা আর সাহস দেখান আমাদের শিক্ষক-জনতা-আইনজীবীরা।

২রা আগস্ট (৩৩শে জুলাই )

আবারো সারাদেশে আন্দোলন ছড়ায় দাবানলের মত। এবার পিছনে আছে শিক্ষক-আইনজীবী-শ্রমজীবী-তারকাদের সহায়তা। ঢাবির শিক্ষিকার গায়ে পুলিশের হাত তোলার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনার ও তীব্র প্রতিবাদ করে ছাত্রসমাজ। পুলিশ আবারো হিংস্র হয়ে ওঠে। একের পর এক প্রিজন ভ্যান ভরতে থাকে। হাজতেও আর জায়গা নেই। খুলনা থেকে গ্রেফতার হয়ে অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হয় আমার আরেক ফ্রেন্ড। আপনজনদের উপর এমন অত্যাচার হতে দেখে বোধহয় রক্ত আরও টগবগ করে। সিদ্ধান্ত নেই কপালে যাই ই থাকুক। আবার মাঠে নামবো। বাসা থেকে লুকিয়ে। ফেসবুকেও কাউকে না জানিয়ে যেভাবে পারা যায় নিরাপদ ত্থেকে আর কি। সমন্বয়করাও মুক্তি পেয়ে স্বীকার করেন যে তাদের আন্দোলন ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। রবিবার (৪ঠা আগস্ট) থেকে ডাক দেন অসহযোগ আন্দোলনের। একজন সমন্বয়ক সুর তুলেন “এক দফা” -এর।

৩রা আগস্ট (৩৪শে জুলাই)

আজ সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায়। সারা ঢাকা, সারা বাংলা। কিন্তু বিশেষ করে শহীদ মিনার। লোকে লোকারণ্য। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ। এত জনসমাগম দেখে ঘাবড়ে যায় স্বৈরাচার। ভেবেছিলেন দমন পীড়নের রাজনীতি থাকে আসনে স্থায়ী করবে। কিন্তু ছাত্রসমাজ ভয় পায় না। আর সর্বস্তরের জনগণ যখন পক্ষে তখন তো আরোও না। শহীদ মিনারে অফিশিয়াল ঘোষণা আসলো “এক দফা” এর। সবার টাইমলাইন ও নোট জুড়ে ১। মেধাবীরা আবার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা ধরে “১” লিখে দিচ্ছে যা মূর্খ সরকারের পক্ষে ডিকোড করা সম্ভব না হলেও অন্তত দাবি বুঝতে অপারগ হওয়ার কথা না। দেয়ালে লিখা উঠে, “স্বৈরাচার নিপাত যাক”। টিএসসির মেট্রো পিলারে হাসিনার মুখে রক্তের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয় লাল রঙ।

৪ঠা আগস্ট (৩৫ শে জুলাই )

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ব্যতীত এই বাংলার মাটি ইতিহাসের বীভৎসতম গণহত্যা দেখে। অফিশিয়ালি এতদিন মৃতের সংখ্যা মোট ৩০০ ছুঁই ছুঁই (যদিও আনঅফিশিয়ালি তা প্রায় ১ হাজার) হলেও সেইদিন ১ দিনেও রেকর্ড করা মৃত্যুর সংখ্যা ১০২+। রেকর্ড ছাড়া কত হবে ভাবতেও চাই না। এখানে উল্লেখ যে ৭১ এর স্বাধীনতা ব্যতীত, পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে ৪ টি বড় আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা ছিল ১০৬ জন। যেই সংখ্যা কেবল একদিনেই ছুঁয়ে ফেলেছে এই রাক্ষসবাহিনী। আওয়ামী সন্ত্রাস, বিশেষ করে ছাত্রলীগ বহুদিন পর জেগে উঠে। তারা স্লোগান দেয়, “জনে জনে খবর দে, ১ দফার কবর দে”। প্রকাশ্যে মৃত্যুর হুমকি! যদিও এই প্রকাশ্য হুমকি মন্ত্রণালয় দিয়েছিল ১৮ তারিখেই। ইঙ্গিত এমন যে ঘরে না থাকলেই বিপদ। সেদিন আমার গন্তব্য মিরপুর। কিন্তু মোড় এ মোড় এ টোকাই বাহিনী। ফোন চেক করছে, সাধারণ ছাত্রদের আক্রমণ করছে। ১০ নাম্বার দখলে থাকে অস্ত্রধারী লীগের ক্যাডার দের। ছাত্ররা সেই মিরপুর-১০ এর দখল নিতে যায়, শুরু হয় গুলি। ধাওয়া পালটা ধাওয়া। আজ ছাত্রদের স্লোহান: “দফা ১, দাবি ১; খুনি হাসিনার পদত্যাগ” কোটা নট কামব্যাক থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকলো কেবল তার একগুঁয়েমিয়ের কারণে। ও হ্যাঁ, আগেরদিন আর্মিরা জানান যে তারা জনগণের উপর গুলি চালাবেন না। মানুষের মধ্যে শুরু হয় গুঞ্জন … তবে কি তাই হতে যাচ্ছে যেটা আমরা চাচ্ছি? সকালে স্বৈরাচার ঘোষণা দেন যে এখন তিনি আলোচনায় রাজি! কি অদ্ভুত। কোটা চাইলাম, খুন করলো তারপর বললো কোটায় রাজি। খুনের বিচার চাইলাম, আরোও খুন-দমন-পীড়ন চালালো। তারপর যখন পদত্যাগ চাইলাম এখন তিনি ৯ দফায় রাজি। তবে আলোচনায় যদি তিনি রাজিই হতেন তবে গুলি কেনো? দেশের রাজপথ আমার ভাই বোনের রক্তে আজ রঞ্জিত। কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকা সর্বত্র রক্তের বন্যা। কিছু এলাকায় সেনা বাহিনী ছাত্রদের রক্ষা করে। বাকি এলাকায় প্রয়োজনে স্নাইপার দিয়ে হত্যা করা হয় ছাত্রদের। তবুও ছাত্ররা দমে না। গদিতে প্রচন্ড আঘাত পেয়ে আবারো কারফিউ দেন। ভাবেন রক্ষা পাচ্ছেন। এইদিকে সমন্বয়করা সিদ্ধান্ত দেন “মার্চ টু ঢাকা”র। সারাদেশ থেকে সব আন্দোলনকারী যেকোনো উপায়ে ঢাকায় আসবে। নেট আবারো বন্ধ করা হয়। কিন্তু ঘোষণা পৌঁছে গেছে। সময়টাও সবাই জানে।

আমাদেরকে দেওয়া আজকের ট্যাগঃ “জঙ্গী”! অথচ এই আন্দোলনে এমনকি আমার বিভাগীয় শিক্ষকরাও ছিলেন। আমরা সবাই জঙ্গী!

৫ই আগস্ট (৩৬ শে জুলাই)

গণভবনে অস্থিরতা। ৩ বাহিনীর কেউ জনতার উপর গুলি চালাতে রাজি না। এইদিকে ফ্যাসিস্ট এর নির্দেশ যত লাশ পড়ুক, দমন করতেই হবে। ফুঁসে উঠে রাগ ঝাড়ে বাহিনী প্রধানদের উপর। সারাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ জনতা এসেছে ঢাকায়। মিছিলের শুরু আছে কিন্তু শেষ নাই। মিরপুর-১০ থেকে কেউ যদি আওয়াজ শুনতে চায়, সে মিছিলের প্রথম স্লোগান শুনার ৩০ মিনিট পর ও দেখবে পদযাত্রা শেষ হয় নাই। এতটাই মানুষ। পতন সুনিশ্চিত। তবুও হিটলারের মতো, বার্লিনে রাশিয়া আর ইংরেজ বাহিনী এসে পড়ার পরও যেমন হিটলার পরাজয় মানতে পারেন নি, উল্টো তার জেনারেলদের হুমকি ধামকি দেন। তারই গোত্র শেখ হাসিনাও শেষ মুহুর্তেও স্বীকার করতে চান না তার পতন। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পারেন পালিয়ে না গেলে তার জীবন হুমকির মধ্যে পড়বে।

সেদিন আমিও মিছিলের আওয়াজ শুনে বেরিয়ে পড়ি। গত দুইদিন মা জানতো না কোথায় যাই, আজকে না বলে উপায় নেই। তখনো দেশে কারফিউ। তখনো গুলি চালানোর নির্দেশ। অনিশ্চিত এক যাত্রা। কিন্তু এ যাত্রায় দমে গেলে দেশ আর স্বাধীন যে হবে না। আমার মতো লাখ লাখ মানুষ এই একই চিন্তা করে রাস্তায়। এখানে থেমে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। এত ত্যাগের পর আর হেরে যাওয়া কোনো অপশন না। আমার আরেক বন্ধুর ঘটনা বলি, তার মা তাকে বললো এখন তুই বের হলে আমি বিষ খাবো। ছেলের উত্তর, তুমি বিষ খেলে খাও, কিন্তু বের হতে না দিলে আমি বিষ খাবো। এভাবেই হয় গণঅভ্যুত্থান। সর্বস্তরের সব জনতা রাস্তায় নামে। পরিচিত, অপরিচিত, অর্ধপরিচিত সবার সাথে দেখা হয়। এতজন যদি নেমে গণঅভ্যুত্থান সফল না করতেন তাহলে হয়তো নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীর হাতে নিহত হতো আজ কয়েক হাজার! পদযাত্রা কারওয়ান বাজার পার হতে গিয়ে বিজয়ের খবর পাই। অদ্ভুত প্রশান্তি ভর করে। তবে অর্জিত হলো কাঙ্খিত স্বাধীনতা? তবে আনন্দের মাঝেও গ্রাস করে ফেলে বিষণ্ণতা। একটা গান ই মাথায় আসছিল বারবার।

যারা জীর্ণজাতির বুকে জাগালো আশা,
মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা,
তারা কি ফিরিবে আর এই সুপ্রভাতে,
যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে…

শহীদ সকলের স্মরণে চোখ ভিজে উঠে। কত আত্মত্যাগ, কত প্রাণের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। তাদের সকলকে সম্মান। অনেক অল্প সময়ে অনেক বেশি রক্ত ঝড়িয়ে বিদায় হয়েছে এই স্বৈরাচার। অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশের স্বপ্ন পূরণের আশা সবার বুকে। ছাত্র আন্দোলন এক গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেওয়াতেই পতন হলো স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ-এর।

তবে এই লিখাটা যখন লিখি তখন মাত্র নতুন সরকার গঠন হলো। এই পর্যন্ত দেশে নেই কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছাত্ররা দেশ রক্ষার চেষ্টা করলেও ঢাকার বাহিরে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে হিন্দুদের উপর নেমে এসেছে নির্যাতন। নতুন সরকারের প্রথম কাজ হবে এই নির্যাতন ও নৈরাজ্য থেকে দেশকে রক্ষা করা ও সংবিধানে অন্যায় আইনের সংশোধন। এটাই কামনা করি।

1304 আদনান করিম চৌধুরী new writer
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন : ২০১৯ - ২০২০