মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা… পাঠক, খুব পরিচিত মনে হচ্ছে না শব্দ গুলি? গত কয়েক মাসে হয়তো শব্দগুলি নানান ভাবে আমাদের সামনে এসেছে। কিন্তু যারা দেশকে ভালোবেসে যুদ্ধ করেছিলো, তাদের নিয়ে কি আমরা সেভাবে কথা বলেছি? কয়জন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা আমরা শুনেছি? আমাদের দেশে যাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে, তাদের সবাই কি আসলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা? আর সকল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কি আমরা সেই সম্মানটুকু করতে পেরেছি যেটা তাদের প্রাপ্য? উত্তরগুলির খোঁজ করতে গিয়ে প্যাপাইরাসের সম্পাদনা পর্ষদ-এর সদস্যের সাথে কথা হয় একজন মুক্তিযোদ্ধার, যার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেই।
পরিচয়: কে. এম. আমান উল্লাহ।
মুক্তিযুদ্ধের স্থান: সেক্টর নম্বর ১১।
যুদ্ধের সময়কাল: জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস, ১৯৭১।
তার সাথে হওয়া ক্ষণিকের আলাপন-
প্যাপাইরাস: আপনার নাম কি? আপনি কোন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন?
– কে. এম. আমান উল্লাহ। আমার সেক্টর এর নাম্বার ১১, মহেন্দ্রগঞ্জ। যুদ্ধ করেছি ধানুয়া কামালপুর, রৌমারি, কুড়িগ্রাম, পাখিউড়া, জামালপুর এসব জায়গায়।
প্যাপাইরাস: আপনি ইন্ডিয়া গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলেন কোন সময়ে?
– জুলাই মাসে।
প্যাপাইরাস: কয়দিনের ট্রেনিং ছিলো আপনাদের?
– ১৬ দিন। প্রথমে আমাদের ট্রেনিং মহেন্দ্রগঞ্জ হলো। এরপরে আরো কয়েকদিন হইছে কালাইপাড়ায়। তারপরে আবারো মহেন্দ্রগঞ্জ এ আরো ৪/৫ দিন ট্রেনিং হলো।
প্যাপাইরাস: এরপরে প্রথমে দেশে কোথায় আসলেন?
– যুদ্ধ করলাম আমরা ধানুয়া কামালপুর। প্রথম যুদ্ধ সেখানে। বেশ কয়েকদিন যুদ্ধ করলাম ধানুয়া কামালপুর এ। তারপরে গেলাম কুড়িগ্রাম, তারপরে যুদ্ধ করলাম পাখিউড়া, তারপরে যুদ্ধ করলাম রৌমারি-রংপুরের রৌমারি এলাকায়। আর লাস্টে এসে যুদ্ধ করলাম জামালপুর। অথচ আমাদের নামই নাই।
প্যাপাইরাস: আপনি পাকিস্তানি সৈন্যদের মেরেছেন যুদ্ধের মাঠে?
– ধরো, তোমার একদল সৈন্য, আমার একদল সৈন্য। আমরা মুখোমুখি যুদ্ধ করতেছি। তোমার দলে ১০০ জন সৈন্য আছে, আমার দলেও ১০০ জন সৈন্য আছে। তখন তোমার… গুলি চলে কি রকম? বৃষ্টির মতো। ঠিস-ঠাস, ঠিস-ঠাস চলতেই থাকে। কার গুলি কই যাইতেছে, এটা কি লেহা আছে গুলির সাথে। কার গুলি কার লাগলো, এটা কি লেহা আছে? অতএব এলোপাতাড়ি গুলি চলে, কিন্তু কার গুলি কার লাগে, সেটা কেউ কোনো দিন বলতে পারবে না। যুদ্ধের মাঠে থেকে কেউ যদি বলে, সম্মুখ যুদ্ধে আমি অমুকরে মারছি, তাহলে সে সরাসরি মিথ্যাবাদি। যুদ্ধের মাঠে কেউ কোনোদিন বলতে পারবে না যে, আমি অমুকরে গুলি করে মারছি। আমার গুলিতে অমুক মরছে, অমুক সৈন্য মরছে। সম্মুখ যুদ্ধে কেউ বলতে পারবে না। অনেকে এমন প্রশ্ন করে, তুমি কয়জনরে মারছো, সৈন্য মারছো কি না? এটা বলা যাবে না, কারণ আমার গুলিতে মরলো নাকি অন্যের গুলিতে মরলো এটা কেউ বলতে পারবে না। কারণ যুদ্ধের মাঠে এলোপাতাড়ি গুলি চলে, উল্টা পাল্টা গুলি চলে, সামনে ডাইনে পিছে, যখন যেদিকে শত্রুর নমুনা বুঝা যায়, সেদিকে গুলি চালানো হয়।
প্যাপাইরাস: আপনার যুদ্ধের সাথী দের নিয়ে কিছু বলবেন কি?
-হ্যাঁ, যুদ্ধে তো বহুত বন্ধু আছিলো। একদিন আমরা যুদ্ধ করতে গেলাম। আমাদেরকে প্রায় ঘিরে ফেলতেছে পাকিস্তানের সৈন্যরা। তখন আমাদেরকে সিগনাল মারলো যে, সব ব্যাক করো। আমরা ব্যাক করতাছি, আমাদের এক এলএমজি ম্যান- আবদুস সামাদ। উনি আর সিগন্যাল টা শুনে নাই। আমরা সব চলে আসছি, ও একাই আছে ওখানে। পাক সৈন্যরা চতুর্পাশ দিয়ে ঘিরায়ে ওরে স্যারেন্ডার করাইছে, ঠিকাছে। কিন্তু ওর হাতে এলএমজি, লোড করা। হাত দুইটা তুইলে দাড়ায়ে ছিলো, কিন্তু ট্রিগারে ঠিকই হাত। ওরা বুঝে নাই, মানে পাকিস্তানি সৈন্যরা বুঝে নাই। ট্রিগারে হাত দিয়ে, হাত উপরে তুলে রেখে দিছে। আর ওরা (পাক সৈন্যরা) যখন ওর আওতার মধ্যে আইসে পরছে, তখন ঢুররররর, ট্রিগার চেপে এলএমজি পুরা ঘুরায়ে দিছে। একে একে একুশ জন সৈন্য শেষ।
কিন্তু আমরা যায়ে তো এদিকে হিসাব করি যে, কত জন যুদ্ধে গেলাম। আমরা সেদিন গেছিলাম ৪২ জন যুদ্ধে, এখন ৪১ জন হয়। ৪২ হয় না, একজন নাই। ক্যাাডা নাই? সামাদ নাই। এলএমজি ম্যান নাই, এলএমজি সহ নাই। সর্বনাশ করছে, এদিকে কান্নাকাটি শুরু হইলো, আমাদের সঙ্গী মানুষ গেছে গা। এহন রুল করে ছাইড়ে দিতাছে। মানে হিসাবপত্র শেষ, কার কত রাউন্ড গুলি হইলো, এসব হিসাবপত্র শেষ করে সাইরে, আমরা যার যার মতো ব্যারাকে যামুগা। তহনই একুশটা হাতিয়ার ঘাড়ে নিয়ে… আর ওই ছিলো লম্বা অনেক, যেই রকম লম্বা তার হেই রকম বডি। শ্যামলা মানুষ। এই একুশটা হাতিয়ার ঘাড়ে নিয়া, তার এলএমজি সহ, আয়ে কয়- ‘তোরা যাস কই, আমারে থুয়ে?’ বাঁইচেই ছিলো। ওদের কেউ বুঝতে পারে নাই। মানে ও ট্যাকনিক খাটাইছে, লোড করা এলএমজি হাতে নিয়ে স্যারেন্ডার করছে, হাত উপরে রেখে। ওরা গুলির আওতার মধ্যে আসতেই ট্রিগার টা টান দিয়ে ঘুরায়ে দিছে আর সবাই শেষ। তো যেই একুশটা হাতিয়ার ঘাড়ে নিয়ে আসছে, হাতিয়ারের ওজন কি আর দুইডা-এডা ওজন হইলো? সাথে আবার নিজের এলএমজি, মানে বাইশটা হাতিয়ার ঘাড়ে করে নিয়ে চলে আসছে। এ বীর উত্তম না বীর প্রতীক পাইছে তো। মনে নাই সঠিক, তবে খেতাব পাইছে।
প্যাপাইরাস: আমাদের যোদ্ধাদের মারা যাওয়াটাও আপনি দেখেছেন?
– হ্যাঁ, শুনো। তারপরে আরেকদিন যুদ্ধে গেলাম, এক সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন কয় আজকে হয় ধানুয়া কামালপুর স্বাধীন করমু, না হয় মইরে যামু। আমরা এক্কেবারে ওগোরে বাংকারের কাছে চলে গেছি। একদম কাছাকাছি চলে গেছি। কাছে যে চলে গেছি, এই খুশিতে উনি উইঠে দাড়াইছে। দাড়ায়ে বাংকারের মুখ খুঁজতে গেছে। মুখ পাইলে ওখানে এলএমজি ঢুকায়ে ফায়ার দিলেই সব মরবো। এই আশায় বাংকারের মুখ খুঁজতে যাবার সাথে সাথে ঠাস ঠাস গুলি করে দিছে ওরা। সাথে সাথেই ক্যাপ্টেন মরে গেলো আমাদের। ক্যাপ্টেন মরে গেলে আমরা তখন ব্যাক করে চলে আসলাম। এছাড়া আসলে উপায় নাই তো।
প্যাপাইরাস: যুদ্ধের সময়, আপনারা কি ভাবতেন সবসময়?
– যুদ্ধের মাঠে কেউ যদি ভাবে যে, আমি বাঁচবো, অমুকরে মারবো। এটা ভুল, এটা সম্পূর্ণ ভুল। যুদ্ধের মাঠে একটাই চিন্তা থাকবে, আমি তো মরবোই, কিন্তু মরার আগে আমি আমার শত্রুদের কে মাইরেই মরবো। এইটাই সাধারণ চিন্তা থাকতে হয়, একজন সৈনিকের, একজন যোদ্ধার। অতএব যুদ্ধের মাঠে কেউ যদি ভাবে যে, আমি বাঁচবো বা আমি মারবো অমুকরে কিংবা তারে মেরে আমি বাঁচবো, এটা ভুল। আর আমার গুলিতে ও মরে গেছে, এটা তো আগেই কইলাম, এটাও ভুল।
প্যাপাইরাস: আপনি কোন অস্ত্র চালাতেন? মানে আপনার হাতে কি থাকতো?
– আমার হাতে ছিলো এসএলআর। যথাস্থানে, মফিজ কমান্ডার এর কাছে আমরা অস্ত্র জমা দিছি। মফিজ উনার নাম ছিলো মফিজ সুবেদার, পরে উনি মেজর হইছিলেন। মেজর হয়ে রিটায়ার্ড করছেন বিডিআর থেকে। মফিজ সুবেদার এর কাছে জামালপুর ওয়াপদা অফিসে আমি হাতিয়ার জমা দিছি, সেই সার্টিফিকেট ও আমার আছে।
প্যাপাইরাস: তাহলে আপনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট পান নাই কেনো?
– সার্টিফিকেট পান নাই হইলো… আমি তো ইন্ডিয়ার ট্রেনিং করা সৈনিক। অরিজিনাল মুক্তিযোদ্ধা। আমি কেনো আমার সার্টিফিকেট কিনতে যাবো?
প্যাপাইরাস: আপনার থেকে সার্টিফিকেট কেনার জন্য টাকা চেয়েছিলো?
– হ্যাঁ। আমার সার্টিফিকেট তো অটোমেটিকই হবে। আমি কেনো কিনবো? সার্টিফিকেট কিনি নাই, আর তাই এহনও খাতায় কলমে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাই নাই। অতএব এটার জন্য আমার আর চিন্তাও নাই, কেনোনা যখন যুদ্ধে গেছিলাম, তহন এইডা ভাইবে যাই নাই যে- আমি এটার বেনিফিট পাবো, অমুক পাবো, তমুক পাবো। এসব চিন্তা ভাবনা করে আমরা তহন যুদ্ধে যাই নাই। আমরা যুদ্ধে গেছিলাম দেশকে স্বাধীন করার জন্যে। আমরা যুদ্ধে গেছিলাম দেশে গনতন্ত্র ফিরায়ে আনার জন্যে। আমরা যুদ্ধে গেছিলাম এই দেশের মানুষকে-দেশকে ভালোবেসে। যুদ্ধে আমরা নিজেরা স্বার্থ উদ্ধার করবো, এই আশায় কোনো মুক্তিযোদ্ধাই যুদ্ধে যায় নাই। যারা গেছে, তারা মরার জন্যই গেছে, দেশ স্বাধীন করার জন্যে গেছে। আমাদের ভাগ্য ভালো। আল্লাহ আমাদের হায়াত রাখছে বিধায় আমরা বেঁচে আছি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হইছে, গুলি খায়ে মারা গেছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু হইছেন। আল্লাহ আমাকে পঙ্গু ও করেন নাই, আমি মরিও নাই। আল্লাহ আমাকে বাঁচায়ে রাখছে। সঠিকভাবে বাঁচায়ে রাখছে। অতএব যেহেতু আমরা কোনো স্বার্থ নিয়ে যুদ্ধ করতে যাই নি, এখন স্বার্থ আসলো কি আসলো না, সেই চিন্তাও আমি করি না। ঠিকাছে।
(একটু থেমে) স্বার্থের জন্য যুদ্ধে যাই নাই, যেই কথাটা।
সার্টিফিকেট কেনার যেই কথা হইলো। যুদ্ধের পরে যখন তালিকা করা হলো বাংলাদেশে, তিন চারবার তালিকা করা হলো তৃণমূল থেকে, টিএনও তালিকা করলেন, থানা কমান্ডার, জেলা কমান্ডার তালিকা করলেন। সমস্ত তালিকাতেই টিকে আছি, তারপরেও যে কেন আমি মুক্তিযোদ্ধা হইতে পারলাম না, স্বীকৃতি কেন পাইলাম না। এইটা এখনও আমার বোধগম্য নয়। অথচ, আমার ইউনিয়নের কথা আমি যতদুর জানি ২০ থেকে ২১ জন অরিজিনাল মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমার ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে রইছে ৪৪ জন। আসলে মুক্তিযোদ্ধা আমি সহ ২১-২২ জন।
প্যাপাইরাস: ওই ২১ জনের সবাই কি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কিংবা স্বীকৃতি পেয়েছে?
– এই ২১ জনের মধ্যে এখনো ৩ জন বাকি আছি আমরা, আমি বাকি আছি, ফজলুল হক বাকি আছে, আরেকটা ছেলে বাকি আছে, নামটা ওর ভুইলে গেলাম। এই তিনজন এখনো বাকি আছি। অথচ মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে ৪৪ জন। কিভাবে হলো, কার মাধ্যমে হলো, কি দিয়ে হলো এটাই বুঝতে পারলাম না। এখনো বুঝতে পারতেছি না, আমরা মুক্তিযুদ্ধে গেছিলাম, কি গেছিলাম না? (হাসি)
অথচ যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়েছে, তারা রাইফেলের নামই জানে না, কোনো হাতিয়ারের নামই জানে না। যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলা হয়েছে, তারা সেক্টর এর নামও জানে না। সেক্টর এর নাম কি, সেক্টর এ কে কে ছিলো, তাদের সাথী কে ছিলো যুদ্ধের সময় এসব বলতে পারবে না। অথচ আমাদের ইউনিয়ন কমান্ডার সাবেরা, থানা কমান্ডার সাবেরা, এরা কেমনে এদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানাইলো?- এই জিনিসটা বুঝতে পারতেছি না। আমার বাড়ি জামালপুর ডিস্ট্রিক্ট, মেলান্দহ থানার ৯ নম্বর ঘোষের পাড়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে অরিজিনাল মুক্তিযোদ্ধা ২০ থেকে ২২ জন। আর এখানে মুক্তি যোদ্ধা হয়ে রইচে ৪৪ জন। আমরা ৩/৪ জন আসলে যারা যুদ্ধ করছি, তারা বাদ পরে আছি।
আওয়ামী লীগের সরকার তিনবার তালিকা করছে, বিএনপি সরকার একবার তালিকা করছিলো, অস্ত্র জমা দেবার সব সার্টিফিকেট থাকার পরেও, তৃণমূল থেকে যখন যাচাই বাছাই করা হয়, সমস্ত যাচাই এ আমরা মুক্তিযোদ্ধা টিকে আছি। অথচ কোন অদৃশ্য ইঙ্গিত এ আমরা যে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারলাম না- এইটাই বুঝতে পারেছি না। এইটা কার কাছে বলবো বা কার কাছে বললে এর সুরাহা হবে, এটাও বুঝতে পারতেছি না। আপনার সাথে অনেক কথা বললাম, বেয়াদবি হলে মাফ করবেন, আসসালামু আলাইকুম।
[কথাটার ভেতরে কি পরিমাণ দুঃখ ছিলো তা হয়তো লেখায় ফুটে উঠছে না, কিন্তু দেশের জন্য প্রাণ দিতে যিনি রাজি ছিলেন, আমরা কি তাকে সামান্য স্বীকৃতি টা দিতে পারি না?]