“দেয়াল” হুমায়ূন আহমেদের শেষ প্রকাশিত উপন্যাস। উপন্যাসের ভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্রের একটা উক্তি আছে। উক্তিটা এরকম “উপন্যাস উপন্যাস-উপন্যাস ইতিহাস নহে।”
“দেয়াল ” উপন্যাসে লেখক কখনো এই উক্তি কে অতিক্রমের চেষ্টা করেননি। তবে ইতিহাসের পটভূমি আর ফিকশন এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। “দেয়াল ” এর ফিকশনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে অবন্তি আর শফিক। “দেয়াল ” যতটা অবন্তি-শফিকের গল্প, ঠিক ততটাই ১৯৭৫ এর সমসাময়িক মানুষদের গল্প, সেই সময়ের রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর গল্প।
“দেয়াল ” উপন্যাসটা শুরু হয়েছে আকাশের বর্ণনা দিয়ে। ভাদ্র মাসের লালচে মেঘের আকাশ। আকাশের রঙের খেলা দেখছে উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র শফিক। কাহিনী আগানোর সাথে সাথে আমাদের পরিচয় হয় অবন্তির সাথে। অবন্তি ষোল বছর বয়সের এক মেয়ে, ভিকারুননিসা কলেজে পড়ে। অবন্তি-শফিকের মধ্যের ‘ডাইনামিকস’ যাতে গৃহশিক্ষক-ছাত্রীর চেয়ে অন্য কিছুতে পরিণত না হয় সেজন্য অবন্তির দাদা সরফরাজ খান সবসময় চিন্তিত। অবন্তি আর শফিকের গল্প কখনো প্রেমের দিকে আগায় না, কিন্তু প্রেম থেকে খুব দূরেও থাকে না হয়তো। প্রেম আর নিরাসক্তির মাঝের অনিশ্চয়তায় থাকে। আর এর আশপাশ দিয়ে উপন্যাসে কিছু রাজনৈতিক চরিত্রের ঝলক দেখতে পাওয়া যায়। সরফরাজ খানকে নাতনির চিন্তায় দিনযাপন করা এক বৃদ্ধ মনে হলেও খালেদ মোশাররফের মতো ব্যক্তিত্ব তার বন্ধুসম, এমনকি কর্নেল তাহেরের উল্লেখও আছে। উপন্যাসে এরকম রাজনৈতিক চরিত্রের আনাগোনা বাড়তে থাকে। লেখক বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা এমন সাধারণভাবে অনাড়ম্বরভাবে লিখে গেছেন মনে হয় যেন লেখক ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন তাকে। উপন্যাসে আমরা ভাস্কর শামীম শিকদারের দেখা পাই, মেজর ডালিমের দেখা পাই, ফারুক ও রশিদের দেখা পাই, বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই আবির্ভাব ঘটে এইসময় উপন্যাসটিতে। পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঢুকে পড়ার আগে অবন্তির চোখ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিপট ঘেঁটে দেখার সুযোগ হয় আমাদের। অবন্তি যে সুন্দর সেটা লেখক বারবারই বর্ণনা করেছেন, সুন্দর হওয়ার খাতিরেই হয়তো মেয়েটা এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের চোখে পড়ে যায়। অবন্তির সাথে তারপর কী হয় সেটা বইয়ের পাতাতেই থাকুক, আজকের রিভিউতে নাহয় উহ্য থাকুক।
এখানে এসে ফিকশন একটু বিরতি নেয়। পরের অংশটুকু শুরু হয় আবার প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে, মার্চের প্রকৃতি। কাহিনীর পরের এ পর্যায়ে উপন্যাস আর ইতিহাস এক অপরকে অতিক্রমের আস্পর্ধা দেখায় না। ইতিহাস বা রাজনৈতিক এর অংশটুকু লেখক মোটামুটি ননফিকশনের মতোই উপস্থাপন করেছেন। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে রেফারেন্স বইয়ের বর্ণনাও উল্লেখ করেছেন। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের কাছে মেজর ফারুকের দেওয়া ঘটনার বর্ণনা লেখক খুব সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। “দেয়াল ” বইটার অন্যতম শক্তিশালি একটা দিক হল এখানে রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর কথা আমাদের আশেপাশের অতিপরিচিত মানুষদের মত করে বলা হয়েছে। মেজর ফারুকের অপারেশন নিয়ে চিন্তার কথা যেমন বলা আছে, হঠাৎ বৃষ্টি দেখে তার বৃষ্টিতে ভিজতে চাওয়ার ইচ্ছাও বলা হয়েছে। ’ইনসাইড র’ তে শেখ মুজিবের সাথে ‘র’ পরিচালকের আলাপের যে রেফারেন্স আছে, সেটাও একেবারে কাহিনীর মত করে বলা হয়েছে, ডকুমেন্টারি নয়। ’লিগ্যাসি অব ব্লাড’ থেকে আওয়ামী কর্মী মোজাম্মেলের কুকীর্তি ও তাতে শেখ মুজিবের উদাসীনতার উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি কৈ মাছ ভাজা নিয়ে তার উৎসাহের কথাও তুলে ধরা হয়েছে কাহিনীর মতো করে। জিয়াউর রহমানের সাথে সেনা অভ্যুত্থানের বর্ণনা যেমন আছে, তেমনি তার নাশতার আয়োজনের কথাও লেখক তুলে ধরেছেন।
“দেয়াল ” ১৫ই আগস্ট ও তার পরবর্তী ঘটনা যতোটা বর্ণনাযোগ্য করে তুলে ধরা হয়েছে, তার চেয়েও ভালো করে তুলে ধরা হয়েছে সেই সময়ের সাধারণ মানুষদের মনোভাব। এখানেই “দেয়াল ” ডকুমেন্টারি বা রেফারেন্স বইগুলোর চেয়ে হয়তোবা অন্য জায়গায় স্থান পেয়েছে। চায়ের দোকানের ছেলেটা, সরফরাজ সাহেব কিংবা শফিক-সবাই যেন ১৫ই আগস্টের পরবর্তী বাংলাদেশের খন্ড খন্ড চিত্র। কোনো তৃতীয় পুরুষের বর্ণনা না, আমরা নিজেরাই যেন বইয়ের একেকটা চরিত্র হয়ে যাই। পঁচাত্তরের সাধারণ জনগণের ভীতি, আশা, হতাশা, ভারতীয় প্রভাব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, রাজনৈতিক চরিত্রদের নায়ক কিংবা খলনায়ক হিসেবে গ্রহণ করা সব যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। হুমায়ূন আহমেদের মত এরকম চরিত্রায়নের ক্ষমতা খুব কম লেখকেরই আছে। শেখ মুজিবের প্রতি সবার ভক্তি থাকলেও, তার শাসনামলের প্রতি কারোরই তেমন আবেগ পরিলক্ষিত হয় না। শাসনামল শেষ হলেও দেশের চালিকাশক্তিতে অস্থিরতার অবসান ঘটে না অবশ্য। চার নেতা হত্যা, সেনা অভ্যুত্থান কিংবা সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের মত ঘটনা দেশকে ভালো থাকতে দেয় না। লেখক মঞ্জুর, কর্নেল তাহের বা তাদের সাথে জিয়াউর রহমানের সম্পর্ক নিয়েও খুব মনোযোগ ধরে রাখার মতো করে লিখেছেন। এমনকি কাহিনীর মধ্যে নিজেই উদয় হয়েছেন উত্তমপুরুষের জবানবন্দিতে। হুমায়ূন আহমেদ “দেয়াল ” শেষ করে যেতে পারেননি। তাই উপন্যাসটা শেষ হয় অনেকটা অসম্পূর্ণভাবে, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর উপাখ্যান দিয়ে।
২০২৪ এর আগস্টের পর সবার কাছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সঠিক ধারণা পাওয়া আরো সহজ হয়ে উঠবে, নিশ্চয়ই উঠবে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বইগুলো বিভিন্ন শাসনামলে এতোসব ‘সুগারকোটিং’ এর মধ্য দিয়ে গিয়েছে যে ইতিহাসের অনেক অধ্যায় জানা অসম্ভবই। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের ’আ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বা ক্রাচের কর্নেল এর মত কিছু বই ছাড়া সেইসব অধ্যায়ের পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া প্রায় মুশকিল। “দেয়াল ” ইতিহাসের বই না, কিন্তু ইতিহাসের সময়ের বই। “দেয়াল ” যতোটাই রাজনৈতিক চরিত্রদের বই, ঠিক ততটাই সাধারণ ফিকশনাল চরিত্রগুলোর বই। “দেয়াল ” যতটা মহানায়কদের উত্থান-পতনের গল্প, শেখ মুজিবের সময়কালের অস্থিরতার গল্প, তার পতনের গল্প, ফারুক রশিদের গল্প, খালেদ মোশাররফ কিংবা মোশতাকের গল্প, কর্নেল তাহেরের গল্প, জিয়াউর রহমানের গল্প, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মানসিকতার গল্প, ঠিক ততটাই অবন্তি-শফিকের মত দুই অসাধারণ মানব-মানবীর গল্প।
- শাহেদ উন নবীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%a6-%e0%a6%89%e0%a6%a8-%e0%a6%a8%e0%a6%ac%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, জুন ১৩, ২০২৪