“আট বছর আগের একদিন”। সাল তখন ১৯৩১ কি ৩২। কবি জীবনানন্দ দাস তখন সদ্য বিবাহিত, সদ্য চাকরীচ্যুত ও সদ্য কন্যাসন্তান জন্মদাতা। প্রথম সন্তান সবার জীবনে খুশির কারণ হলেও কবির জীবনে যেন আরোও দুশ্চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। অভাবের এই সময়ে নবজাতক কে পৃথিবীতে এনে নিজেকে তার এক অপরাধী বাবা মনে হয়, যার চাহিদা ও দ্বায়িত্ব পূরণে সে ব্যর্থ। একই সাথে ব্যর্থ বনেদী পরিবারের শিক্ষিত স্ত্রী লাবণ্যের কাছেও। তার তখনকার লিখাতে আত্মহত্যা সম্পর্কিত অনেক বর্ণনা ও পাওয়া যায়। যেমনঃ
“Our marriage is scram…সারা দিন কাঁদে…আমায় ধুলায় মিশিয়ে দেয়…মুক্তি চায়…উঠে পড়ি…কী করব? আত্মহত্যা? শীতের রাতে অন্ধকার পুকুরে ডুবে মরব?…”
আবার আরেক বর্ণনায় লিখেছেন ,
“To what social position & status have I arrived now? -A PARIAH A man who can’t incur debts. Reflect 1 great disability-Like a bankrupt moral and material-a nuisance.”
স্পষ্টতই হতাসার গভীর খাদে কবি তখন নিমজ্জিত।
এর প্রায় ৮ বছর পরে, তখন কবি বরিশালে আবার অধ্যাপনার চাকরী জোগাড় করেছেন। স্ত্রী লাবণ্য ও আবার পড়াশুনা শুরু করেছে। সংসার এ শান্তির সুবাতাস। নতুন করে কবিতা ও ছাপা হচ্ছে তার বেশ। এমনি এক সময় কবি লিখলেন কবিতাটি। “আট বছর আগের একদিন”।
উনি লাশকাটা ঘরে এক লাশ দেখেন, সেই ব্যক্তি, যে পঞ্চমীর চাঁদ ডোবার সময়, অশ্বত্থ গাছে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। স্থান হয় তার লাশকাটা ঘরে। তার স্ত্রী – সন্তান সব ছিল পাশে। তবে কেন এই মৃত্যু? যেন মরবার ই ইচ্ছা হচ্ছিল উনার? নাকি কোনো মৃত্যু চিন্তার ভূত ভর করেছিল? চিরকাল এর এক নিস্তব্ধ ঘুম ঘুমানোর ই কি প্রয়াস ছিল এটা? এমন এক গুমোট অন্ধকার, নির্জন, নির্জীব, যাকে তিনি তুলনা করেন উটের গ্রীবার সাথে।
তো কবি সেই লাশ কে তখন নিজের ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে বলছিলেন যে একটা অন্ধ প্যাঁচা ও ইঁদুর ধরার উদ্দেশ্যে, বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে উড়ে বেড়ায়। ব্যাঙ ও থেতলে যাবার আগে দুদন্ড বেশী বাঁচার আকুতি করে, মশারীর বাহিরে মশার গুঞ্জন চলে সারারাত, কেবল ই রক্ত নিয়ে বাঁচার আকুতি। ছোট ছেলেদের হাতে ধরা খাওয়া ফড়িং ও বাঁচার শেষ চেষ্টা করে। কীট পতঙ্গের মধ্যেও বেঁচে থাকার কি স্পৃহা আর তুমি মানুষ কেন বাঁচার আকাঙ্ক্ষা হারাও! কবি প্লেগগ্রস্থ ইঁদুরের সাথে তুলনা করেন লাশটিকে।
তারপর যেন লাশের হয়ে তিনি ই উত্তর দেন। যে জীবন ফড়িঙের, যে জীবন দোয়েলের, যে জীবনে মূল উদ্দেশ্য ই বেঁচে থাকা, স্বকীয়, স্বাধীন। সংসার – আবেগ – অনুভূতি – সমাজের কিংবা ব্যক্তিগত অবসাদের ঝামেলামুক্ত, মানুষের কখনো সেই জীবনের সাথে দেখা হয় নি! তারপরও কবি যেন তুষ্ট নন। তিনি প্রশ্ন করলেন আবার। প্রশ্ন করলেন, তবুও কি এই অশ্বত্থ গাছ, এই পেঁচা, এই ফড়িঙেরা, এই জোনাকী , এই যবের ঘ্রাণ। এরা আটকায় নি তাকে? জীবিত অবস্থায় নাহয় অসহ্য বোধ হলো। মৃত্যু তে কি এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি মিললো? লাশকাটা ঘরে এসে কি তবে প্রশান্তি? (এইখানে উল্লেখ ব্যাপার যে আত্মহত্যা কে নিরুৎসাহিত করার পিছনে প্রায় সবার ই চেনা এক বক্তব্য হলো পরিবার – স্ত্রী – কন্যার পিছুটানে বাঁধার চেষ্টা। কবি এখানে পরিবারের উল্লেখ ই করলেন না, বরং প্রকৃতির ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর অংশ থেকেই জীবনের রস আস্বাদন করার কথা বললেন)। এবারোও কবি নিজেই লাশ এর হয়ে উত্তর দেন। এ যেন আট বছর আগের সেই নিজের সত্ত্বার সাথেই নিজের কথোপকথন। তখনকার জীবনানন্দের মৃত্যু ঘটে গেছে। এক পরিণত জীবনানন্দই যেন সেই অতীত সত্ত্বার সাথে কথা বলছেন।
লাশ এর উত্তর এমন হয় যে, তিনি কোনো প্রেমে ব্যর্থ নন, স্ত্রী সংসার এ অসুখী নন, অর্থাভাবে জর্জরিত নন। তবু যেন এক বোধ তাকে তাড়া করে বেড়ায়। সেই বোধ তাকে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত করে তোলে। এই বোধ এর মুক্তি নারী-প্রেম-সংসার-সচ্ছলতা কিছু থেকেই নয়। জাগতিক কোনো মোহ দ্বারাই এই বোধ পরিচালিত নয়। ভেতর থেকে ক্ষয় করে এই অনুভূতি। মৃত্যুতেই কেবল তার থেকে মুক্তি। এই বোধ এর অনেক সুন্দর এক নাম দেন কবি। এর নাম “বিপন্ন বিস্ময়”।
তবুও কবি শেষে আত্মহত্যাকারীকে সমর্থন দেন না। তিনি এই ব্যাঙ, এই অন্ধ প্যাঁচা, অশ্বত্থ গাছে তার সাথেই ইঁদুরের সন্ধান, জীবনের সন্ধানের যেন তিনি বেশী আগ্রহী।
অর্থাৎ আত্মহত্যাকারীর যুক্তি কে ফেলে না দিলেও কবি শেষ পর্যন্ত জীবনের জয়গান ই গেয়েছেন। যেন নিজের হতাশ, বিষণ্ণ – বিপন্ন সত্ত্বা কেই দিচ্ছেন জীবনের অণুপ্রেরণা। আত্মহত্যার নান্দনিক প্রশান্তির চেয়েও জীবন কে তুলে ধরেছেন ঊর্ধ্বে। এমনকি আত্মহত্যার জন্য বেছে নেওয়া দিন টিও যেন নতুন জীবনের ই ইঙ্গিত দেয় তিনি। বেছে নেন পঞ্চমীর চাঁদ ডোবার দিন। পরের দিন হচ্ছে ষষ্ঠী, যা দেবতা ষষ্ঠীর দিন। সনাতন ধর্মমতে ষষ্ঠী শিশুদের দেবত। তিনি নবজাতককে সৃষ্টিও করেন, পালনও করেন। এ যেন ফিনিক্স পাখির মতো পূনর্জন্ম।
রেফারেন্স ও অণুপ্রেরণায়
“একজন কমলালেবু”
-শাহাদুজ্জামান
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, জুলাই ৮, ২০২১
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৩
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, মে ১১, ২০২৩
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩
- আদনান করিম চৌধুরীhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%86%e0%a6%a6%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%95%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%ae-%e0%a6%9a%e0%a7%8c%e0%a6%a7%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a7%80/সোমবার, আগস্ট ১২, ২০২৪