জুলাই ১০, ২০২৫

উপসংহারে ঊনসত্তরঃ সংখ্যা থেকে স্মৃতির পথে

সময়টা ৭ জানুয়ারি, ২০২০। শীতের সকালে জবুথবু হয়ে ক্লাসে এসেছে এক ঝাঁক উৎসুক চোখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিন! সে এক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধসম ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে আজ এনেক্সের চার তলায় ঠাঁই হয়েছে তাদের। কারো কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে, “সত্যিই কি আমি আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে?”, আবার কেউ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগের গেটের দিক চেয়ে, “ডাক্তারিটা আর পড়া হল না। স্বপ্ন বুঝি কখনই পূরণ হয় না!”, কিংবা কেউ আমার মত বড় সাধের বিষয় “স্থাপত্য” ছেড়ে এসে শোকের ভারে জীবনের এই রোমাঞ্চকর অনুভূতিটা কিছুতেই উপভোগ করতে পারছে না। কেবল আফসোসে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। (যদিও শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জাফর স্যার বলেছেন, “আল্লাহ্‌ (বা প্রভু) যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন তাকে পরিসংখ্যানে নিয়ে আসেন!”) আবার এদিকে একদল কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, যে, বিজ্ঞান অনুষদের বিষয় পড়তে এসেও তার কার্জনের লাল দালানে ক্লাস করা হবে না!!

এরা হল পরিসংখ্যান বিভাগের নতুন সংযোজন- সংশপ্তক ৬৯। সেদিন বিভাগ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করা হল এই সংশপ্তককে।

শুরু হল পুরোদমে প্রথম বর্ষের ক্লাস। কাঠখোট্টা সব কোর্সের ভারে নুইয়ে পড়ার মত অবস্থাপ্রায়! ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা শেষ হবার আগেই দূর থেকে চোখ রাঙাচ্ছে পরীক্ষা। তখন কে জানতো? এই সংশপ্তকের প্রথম বর্ষের শেষ ক্লাস যে কেবল তিন মাস পর ১৫ই মার্চ হয়ে যাবে। সুদূর চীন থেকে যে করোনা ভাইরাস যমদূত হয়ে এসেছে দেশে। শুরু হল দীর্ঘ লকডাউন! বহুল প্রতীক্ষিত নবীনবরণটাও হল না। ‘৬৯ বরণে ৬৭’ খচিত একটি সুসজ্জিত ডিজিটাল ব্যানারই তাদের নবীনবরনের একমাত্র স্মৃতি! ভাগ্যিস! পিকনিকটা ফেব্রুয়ারিতে হয়ে গিয়েছিলো! অতঃপর অনলাইন ক্লাসে কোনোমতে সিলেবাস শেষ করে একেবারে ২০২১ এর নভেম্বরে প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার মাধ্যমে শেষ হল সংশপ্তকের “স্মৃতির দৃষ্টিকোণ হতে সংক্ষিপ্ত কিন্তু সময়ের হিসাবে দীর্ঘ রসকষহীন” প্রথম বর্ষ!
২০২০-২০২১ সময়টা কারো জন্যই ভালো ছিল না। বিশেষ করে পরিসংখ্যান বিভাগের তো নয়ই। পরিসংখ্যান বিভাগের চারতলা আঁধারে ঢেকে পরপারে চলে গেলেন বিভাগের সবার প্রিয় অধ্যাপক তসলিম সাজ্জাদ মল্লিক স্যার, যার সাথে সংশপ্তকের আর দেখা হল না, তাঁর ক্লাস পাওয়ার সৌভাগ্য হল না।

তারপর যেন চোখের পলকে দ্বিতীয় বর্ষ চলে গেল। ৬ মাসের সংক্ষিপ্ত সময়ে বিশাল সিলেবাস শেষ করতে ছাত্র- শিক্ষক দুই পক্ষেরই প্রাণ যায় যায় করছে! তারপর তৃতীয় বর্ষে এসে এই সংশপ্তক কি না করেছে! প্রথমে সামাদ স্মৃতি টুর্নামেন্ট, তারপর প্রথমবারের মত পিকনিক আয়োজন, প্যাপাইরাসের অনলাইন সংস্করণের চতুর্থ বর্ষপূর্তিসহ আরও কত কি!

এবারে দেখতে দেখতে শেষ বর্ষে চলে এলো! জুনিয়র সংশপ্তক-৬৯ সিনিয়রও হয়ে গেল! ভাবা যায়? এই সংশপ্তক না সেদিন সবে বিভাগে এলো? কোয়ান্টাইল-৭২ কে কি সুন্দর জাঁকজমক নবীনবরন অনুষ্ঠান করে বরণও করে নিল যে! তবে শেষ বর্ষটাও ভালো হতে হতেও যেন হল না সংশপ্তকের! সামনে এসে দাঁড়ালো তাদের জীবনের অনাকাঙ্খিত একটি মাস- জুলাই! রক্তাক্ত জুলাই!! এ কালো অধ্যায় ভুলে কি থাকা যায়?

শত বাঁধা পেরিয়ে ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ ক্লাস হয়ে গেল। অবশেষে গত ৭ই অক্টোবর, ২০২৪, আনুষ্ঠানিকভাবে উপসংহার টানলো ৭ জানুয়ারি, ২০২০ এ বিভাগে পা রাখা সংশপ্তক! আমাদের সবার জীবনের নতুন এই যাত্রা শুভ হোক এই কামনা করে আজ চোখে টলমল পানি ধরে রেখে এখানেই শেষ করছি। দেখা হবে বন্ধু, কারণে অকারণে।

“স্মৃতির পাতায় চিরদিন থাকবে লেখা,
একদিন আবার মিলবে আমাদের পথের রেখা।”

0612 শামায়েলা শেবন্তী photo
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp