শেষ পেশেন্ট কে বিদায় দিয়েই ভারী একখানা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। এই মুহূর্তটার জন্যই সপ্তাহভরে অপেক্ষায় থাকা হয় তাঁর।
ডা. মাহমুদুল হাসান তালুকদার, সাইকিয়াট্রিস্ট অর্থ্যাৎ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ। ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বড় মাপের ডাক্তার। শহরে ডা. তালুকদার নামে বেশ পরিচিত তিনি। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মানসিক বিপর্যস্ত রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। মানসিক রোগীদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা তাদের এই প্রতিবন্ধকতাকে নিজের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। যখন তারা সাপোর্ট পায় না, তখন তারা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। অনেকগুলো কেসেই তিনি এটি অবলোকন করেছেন।
বৃহস্পতিবারের রাত ১০ টা। শেষ পেশেন্টকে বিদায় দিয়ে নিজের কেবিনের চেয়ারে শরীরখানা এলিয়ে দিয়ে সাপ্তাহিক অবকাশের শুভসূচনা করলেন ডা. তালুকদার। তিনি চিন্তা ভাবনা করতে ভালোবাসেন। তাই বাসায় ফিরে চলমান দিনটির বিভিন্ন মুহূর্তগুলো সম্পর্কে ভাববেন বলে মনস্থির করলেন।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় গেলেন তিনি। সাধারণত শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস নেই তার, কিছুক্ষণ বই পড়ে তারপর নিদ্রা যান। তবে আজ তিনি বই পড়বেন না। দিনটি সম্পর্কে কিছুক্ষণ ভাববেন।
সারা দিনে উল্লেখ করার মত কোন ব্যাপার ঘটেনি। সাধারণ মানসিক রোগীরা এসে চিকিৎসা নিয়ে গেছেন। তবে শেষ যে পেশেন্টকে তিনি বিদায় দিলেন, তার ঘটনাটা একটু অন্যরকম।
তার নাম রবিউল হাসান পূর্ণ। সে ডা.তালুকদারের সবচেয়ে সিরিয়াস পেশেন্ট। তাই তার চিকিৎসাও সবার শেষে সময় নিয়ে করেন তিনি। তার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাবলী আজও ডা.তালুকদারকে কাঁদায়।
পূর্ণ কোনো সাধারণ ছাত্র ছিল না, উদ্ভাসের তুখোড় ব্যাচের নামকরা ছাত্র হিসেবে কোচিং মহলে বেশ নামডাক ছিল তার। উচ্চ মাধ্যমিকে পরিশ্রম করে যথেষ্ট ভালো ফলাফল অর্জন করে পূর্ণ। বুয়েট টার্গেট করে এডমিশনে দিনরাত এক করে পড়াশোনা শুরু করে সে। ভর্তি পরীক্ষায় দারুণভাবে সফলতাও অর্জন করে। এইচএসসি পূর্ববর্তী ৩ মাস ও পরবর্তী ৩.৫ মাস নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে রেখে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। ফলশ্রুতিতে যত জায়গায় সে পরীক্ষা দিয়েছে, সব জায়গায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে।
মা, বাবা ও ছোটবোনকে নিয়ে ভালোই চলছিল তাদের পরিবার।
এডমিশন টেস্ট রেজাল্ট পরবর্তী ১ম দিন। তার আম্মু সকলের কাছে চান্স পাওয়ার সুসংবাদ দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময় হঠাৎ পূর্ণ খাপছাড়া কথা বলা শুরু করলো বাসায়। এমনিতে সে খুব শান্তশিষ্ট ছেলে, কিন্তু আজ তাকে এমনভাবে কথা বলতে দেখে সকলেই ঘাবড়ে গেল। মা তাকে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় সে কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলো। পড়ার টেবিল থেকে খাতা পত্র ছুড়ে ফেলতে লাগলো। ঘরের জিনিসপত্র ওলট পালট করতে লাগলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মা তাকে থামাতে যান। কিছুটা আঘাত করেন তাকে। হঠাৎ মার দিকে একদৃষ্টিতে তাকালো সে। মুখে আক্রমণের হাবভাব না থাকলেও হঠাৎ তার চোখসহ পুরো মুখ লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই মূর্ছা গেল সে। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার তার লাল মুখ দেখে এবং মূর্ছা যাওয়ার কথা শুনেই বুঝলেন ব্রেনে কোনো সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার তার ব্রেন টেস্ট করালেন।
সকল ঘটনা জেনে ব্রেন টেস্ট করে তিনি দেখলেন, তার হাইপোথ্যালামাসের কিছু কোষ ড্যামেজড হয়ে উল্টো পথে কাজ করছে। অর্থাৎ যে পথে সিগন্যাল যাওয়ার কথা, সে পথে না গিয়ে উল্টো পথে যায়, যার ফলে খাপছাড়া কাজ করা শুরু করে সে। উপরন্তু, মাঝে মাঝে ব্রেনের ওই এরিয়া টা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, ফলে মানুষ যে অবস্থায় থাকে, সে অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
ডাক্তার দুঃখ ভারাক্রান্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে, ওষুধপত্র ঠিকমত পড়লে সে ঠিক হয়ে যাবে। এজন্য তাকে অবজারভেশনে রাখতে হবে। তাই করা হলো।
ঘটনা এই পর্যন্তই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু বিধি বাম। জ্ঞান ফেরার পর থেকে তার আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা না গেলেও অসংলগ্ন কথবার্তায় ডাক্তার চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।
একপর্যায়ে সে হাসপাতালের বেড ছেড়ে বিভিন্ন ডাক্তারের কেবিনে ঢুকে পড়ে অসংলগ্ন কথাবার্তা শুরু করে। যাকে তাকে সন্দেহ করা শুরু করে এই ভেবে যে, তারা পূর্ণর ক্ষতি করবে। সমস্যা প্রকট হতে শুরু করলে ডাক্তার তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট ডা.তালুকদারের কাছে স্থানান্তর করেন। ডা.তালুকদার সবকিছু শুনে তার চিকিৎসা শুরু করেন। দুই ডাক্তারের যৌথ প্রচেষ্টায় সে আজ অনেকটাই সুস্থের পথে। তবে মাঝেমধ্যে সেই সকল আচরণ ফিরে আসে ব্রেনের ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে। এটি ওভারকামের জন্য ডা.তালুকদার আজ অবধি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও সমাধান পাননি। পাবেন কিনা তাও নিশ্চিত নন।
হয়তো পাবেন…
হয়তো পাবেন না কোনোদিনও…!
ঘুমোতে যাবার আগে ডা. তালুকদার নিজের ছেলেবেলার কথা একবার ভাবলেন। তিনি ডাক্তারি পড়েছেন। তার উপর দিয়েও এমন অবকাশবিহীন সময় গিয়েছে অনেক। ডাক্তার বলেছেন, মাত্রাতিরিক্ত অবকাশবিহীন প্রেসারের কারণে পূর্ণর ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। তাই তার ব্রেন এখন সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে পারে না। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে করেন তিনি, কারণ পূর্ণর মত পরিস্থিতি তারও হতে পারতো। তখন হয়তো তিনি এই স্বাধীন পৃথিবী উপভোগ করা হতে বঞ্চিত হতেন। সৃষ্টিকর্তার নিকট ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন তিনি। এখন তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, জীবনের সবকিছুই কঠিন, হোক সেটা পড়ালেখা বা অন্যকিছু। এসবের মধ্যে যদি একটুখানি অবকাশ তথা ফুরসত খুঁজে বের করা যায়, তবে জীবনকে সত্যিকার অর্থেই উপভোগ করা যায়; কারণ দিনশেষে কপালে যা লেখা আছে তা পাওয়া যাবেই।
ডা.তালুকদার বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। যান্ত্রিক জীবন থেকে বের হওয়ার কোনো অবকাশ নেই তাদের। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কাজে যাওয়া, গভীর রাতে ফেরা, আবার এই চক্রের পুনরাবৃত্তি!!
এভাবে চক্রবন্দি হয়েই একদিন মানুষ চিরস্থায়ী ফুরসত পেয়ে যায়, জীবন অপূর্ণ রেখে যে ফুরসত সে চায়নি কখনো!
তবুও বর্তমান মানুষ জীবন নিয়ে মিথ্যাচক্রে ব্যতিব্যস্ত; এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত যে, এসব বিষয় অবগত হইবার ফুরসত ই মেলে না!!……….
- This author does not have any more posts.