বাবা মায়ের মায়া মমতায় আজ অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছি। কখনো বুঝতে চেষ্টা করি নি, বাবা এত পরিশ্রম করে কেন? মাকেও কখনো বলা হয় নি, মা তুমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে রান্না করো কেন?
বাবা মা ছাড়াই একদিন বেঁচে থাকতে হবে, কথাটা ভাবতেই বুকটা কেমন যেন করছে। কখনো তো মনে কি নি, মা বাবা ছাড়া মানুষ কেমন করে বাঁচে?
যে মানুষগুলো নিঃস্বার্থে আমার জন্য এত কিছু করছে, তাদের ছেড়ে কিভাবে থাকবো?
সামান্য কিছুদিনই হয়েছে, বাসা থেকে এসেছি। বাবা মায়ের কথা কমই মনে পড়ছে। ডিপার্টমেন্টের ক্লাস আর কিছুটা সময় বন্ধুদের সাথে কাটিয়ে দিয়েই জীবন চলছে।
অপরিচিত মুখগুলো যেন, পরিচিত হয়ে উঠতেছে আমার কাছে।
ঢাকার বাইরে থেকে এসে ঢাকার পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু হিমশিম খাচ্ছি। তারই মাঝে একটু স্বস্তিবোধ করছি, কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আবেগের জায়গা।
এখানে আবেগটা একটু বেড়ে যায়, যখন কার্জন হলে বহিরাগতরা মানুষেরা প্রবেশ করতে পারে না।
আমি আর আমার দুইজন বন্ধু কার্জনে বসে গল্প করছি। চা ওয়ালা চা নিয়ে কাছে এলো।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতেছে, আপনাদের তিনজন ছেলে বন্ধুকে চা দেয়। এখন তো আসরের নামাযের সময় হয়ে আসছে, আমরা এখন চা খাবো না বলে তাকে বিদায় জানালাম।
ঠিক কিছুটা মুহুর্ত পড়েই, ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করলাম। ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে শুনতে পেলাম, তুমি বিপ্লব। আমি সালাম দিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
এরপরই বললো, আমি তোমার ভাইয়া বলতেছিলাম। ওনাকে বললাম, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে বললো, আমি তোমার হলের সিনিয়র ভাই, ২০১২-২০১৩ সেশন। আমি বললাম, কোনো সমস্যা ভাই।
একথাটা বলেই, ওনার কথা বলা কিছুটা থমকে গেলো। খানিকক্ষণ পরে জানতে পারলাম, আমার রুমে এক বড় ভাই। ঐ ভাইয়ার কাছে ব্লাড চেয়েছে। ভাইয়া তখন আমার ফোন নম্বর দিছে। তখনি বুঝতে পারলাম, আমাকেও ব্লাড দিতে হবে এখন। আমি সিনিয়র ভাইকে বললাম, রোগী আপনার কি হয়। ভাই বললো, ভাতিজা হয়। আমি একটু অসুস্থ বোধ করছি, ঢাকায় নতুন এসেছি। এর মধ্যে প্রথমবার ব্লাড দিবো।
ভাইকে বললাম, আমি বর্তমানে ব্লাড দিতে পারবো না। এই বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষ করে, রুমে ঢুকতেছি।
রুমে ঢুকার সাথে সাথেই রুমের ভাই বলে উঠলো, বিপ্লব দ্রুত রেডি হও। যেমন বলা তেমনি কাজ। এবারে, ভাই বললো কলটা রিসিভ কর।
কল রিসিভ করতে না করতেই শুনতে পেলাম,
ভাই আমার বাচ্চার অবস্থা খুবই সিরিয়াস। ডাক্তার বলছে যতদ্রুত সম্ভব এক ব্যাগ ব্লাড মেনেজ করতে। আমি অনেক জায়গায় খোজ করেছি, কোথাও তেমন আশ্বাস পায় নি। আপনি ব্লাড না দিলে, আমার সন্তানের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হবে।
দয়া করে, এক ব্যাগ ব্লাড দেন ভাই।
সন্তানের জন্য বাবার মিনতি। বাঁচতে চায়, সন্তানকে বাঁচাতে চায়। এজন্য অন্যের কাছে ছোট হওয়াটাকেও তুচ্ছ মনে করলেন। নিরবে কথাগুলো বললেন। বুঝিয়ে দিলেন, বাবা হওয়াটা কতটা কঠিন। মুমূর্ষু সন্তানের পাশে, দাড়িয়ে প্রতিটি বাবাই এমনই করে। কখনো ভুলতে পারে না সন্তানদের। হয়তো, মা ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আছে। মা হয়তো আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে। নিরবে কোথাও হয়তো চোখের জল ফেলছে। মায়ের মতো মানুষ হয় না। অসুস্থ হলে, বোঝা যায়, মায়ের দোয়া, যত্ন, ভালোবাসা কতই না দামী।
যে মা আধার রাতে সন্তানকে, ঘুম পাড়িয়ে দেয়, সেই মা অসুস্থ সন্তানকে রেখে যাবে কোথায়। বাবার ভালোবাসা কাছ থেকে বোঝা যায় না ঠিকই, দূর থেকে অনুভব করা যায় বটে। যখন শূন্য পকেটে ঘুরে বেড়াই তখনই মনে হয়, আমার বাবা কতদিনই না শূন্য পকেটে দিন পার করেছে। বৃদ্ধ বয়সে অবহেলায় শিকার হওয়া বাবা মায়েরা হয়তো বেঁচে থাকতেও মরে যায়। চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে, তারা হয়তো চোখের পানি লুকিয়ে রাখে।
ব্লাডের জন্য এমন কথা শুনে, হার্টবিটটা বেড়ে গেলো।
রওনা হলাম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্য। পৌঁছে গেলাম, মেডিকেলের সামনে। দ্রুততার সাথে আমাকে পানি, জুস আর কেক খাওয়ানো হলো।
ব্লাডের সেম্পল নেওয়া হলো। খানিকক্ষণ পরে, আমাকে ডাকা হলো, ব্লাড ডোনার সেন্টারে।
কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলো। উওর দিলাম।
মেডিকেলের ঐ বেডে শুয়ে আছি। রক্তের ব্যাগ রেডি করা হয়েছে। একটু মোটা সুই প্রবেশ করানো হলো আমার হাতের শিরায়।
নিরবে পাঁচ মিনিটের মতো শুয়ে আছি।
কিছুক্ষণ পরে, নার্স এসে বললো, হয়ে গেছে।
সুই বের করেছে, দশ মিনিট শুয়ে আছি।
ব্লাড দেওয়ার ভয়টা কেটে গেছে।
নিজেকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। বেড থেকে উঠে দাড়ালাম। রোগীর সমস্ত লোক আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। আমার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে।
ছোট বাচ্চাটাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে না, সে অসুস্থ।
সম্ভবনার ক্লাসে, সম্ভাব্য এক ব্যক্তির ফোন আসলো। ক্লাস শেষে ফোন ব্যাক করলাম।
সালাম দিলাম, শুনতে পেলাম কিছু কথা। বাচ্চাটা প্রায়ই সুস্থ।
রক্ত দিতে ছিলো ভয়,
এই রক্ত দানে মনবতার জয়।
রক্তের জন্য আহাজারি,
রক্ত ঝড়াই স্বৈরাচারী।
রক্ত দিয়ে বাচালো যারা,
এই দেশের প্রাণ।
চিরদিন মোরা গাইবো,
তাদের জয়গান।
রক্ত দানে পূণ্য হয়,
বাঁচে মানুষের প্রাণ।
আজকে আমি গাইতে থাকি,
রক্তদাতার জয়গান।
- This author does not have any more posts.