মাগরিবের নামাজ পড়ে বের হলাম, আকাশ রক্তিম, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, অপরিচিত এক রাস্তায় চা খাওয়ার সময় দেখলাম দুটো ছোট্ট ছেলে যাচ্ছে হেলে দুলে। ঠিক তখন মনে পড়ল আমার শৈশবের কথা। ঠিক কোথায় নিজের সুখকে ফেলে এসেছি, নিজেও মনে করতে পারছি না। যান্ত্রিক শহরে নিজেকে হারিয়ে নিজেকেই খুঁজে ফিরি। আমার অস্তিত্ব যেন পড়ে আছে সেই চিরচেনা জায়গায় যেখানে আমার জীবনের প্রথম পাঠ শুরু। বাবার চাকরি বদলির কারণে সেটি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছি এই যান্ত্রিক শহরে। চা শেষ করে মেইন রোড এর ফুটপাত দিয়ে হাটার সময় দেখলাম কোথাও কেউ নেই। পাখিরা নীড়ে ফিরছে, বাতাসে বেলি ফুলের তীব্র গন্ধ, কিছু মোটরযান দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে।
শরীর অনেকটা ভিজে গিয়েছে ততক্ষণে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না, হৃদয় সিক্ত হয়েছে বহুকাল আগে। সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু হাস্যোজ্জ্বল ছেলে-মেয়ে বের হচ্ছে। তাদের আনন্দ দেখে নিজেও আনন্দিত হলাম। পরক্ষণে মনে পড়ল এমন চিরচেনা বন্ধু আমারো ছিল, একসাথে ঘুরতাম, হাসতাম! কিন্তু সময়ের বির্বতনে সবাই হারিয়ে গিয়েছে। যে যার মত ব্যস্ত। এখন আর কেও বাসায় ডাকতে আসে না, কেও বলে না ‘দোস্ত ঘুরতে চল !’, কেও বলে না ‘চল,খেলতে যাই’। রাস্তার মোড়ে কে যেন ডাকলো, আমি পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম সেই পরিচিত মুখ, যা আমার দৃষ্টির অগচোরে ছিল ৮ বছর! আমার সেই প্রিয় মুখ যাকে দেখতে ব্যগ্র ছিলাম। আমাকে বললো, ‘কেমন আছিস? কতদিন দেখা হয় না, রংপুরে তো আসলিও না দেখা করতে একবারও, ভুলেই গেছিস নতুন শহরে এসে’। আমি কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে তাকে বললাম, ‘ভালোই আছি। তোকে দেখে অনেক ভালো লাগছে। স্কুলে আমরা একসাথে থাকতাম সবসময়। তোকে ঠিক আগের মতই সু্ন্দর লাগছে। ঢাকায় আসার পর আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। তুই কেমন আছিস? এখানে কোথায় থাকিস?’
সে বলল, ‘এইতো সামনেই। আগামীকাল আমার ফ্লাইট। আমেরিকাতে যাচ্ছি পড়াশোনা করতে। তুই বাসায় আয়।’
আমি বুঝতে পারলাম এই দেখা হয়তো শেষ দেখা। নিজের আবেগ সামলাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ কথা বলে অজুহাত দেখিয়ে চলে আসলাম। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। এশার আযান দিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। বাড়ি ফিরার সময় চোখ ভিজে আসছে। এভাবেই প্রতিনিয়ত কত পরিচিত মানুষ দূরে চলে যায়, কিন্তু স্মৃতি রয়ে যায়।
- This author does not have any more posts.