অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। পথে নিরবে, একাকীত্ব মনে হাঁটছি। হাঁটার মাঝে মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা। যখন দাদুর কাছে গল্প শুনতাম। দাদু মাছ খেয়ে শেষ করতে পারতো না, শুটকি করে মাছ রেখে দিতো। ঐ গভীর জঙ্গলে নিরবে তারা মধু আহরণ করতো। মোম দিয়ে তাবিজ বানাতো। কালু জাদু করে মানুষ কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো। আমার এক চাচা জ্বিনের ওস্তাদ ছিলেন। অম্যাবস্যার রাতে তাকে ঘরে পাওয়া যেত না। ভোর বেলায় বাড়ি ফিরতো। উনি জ্বিনকে বিয়ে করেছে। এ কথাটা শুনতে ভয় লাগে। জ্বিন জাতির সাথে মানুষের বিয়ে তা কি রে সম্ভব! তিনি যখন জ্বিনের বাড়িতে যায়, তখন নাকি স্বর্ণের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন। এসব তো অবিশ্বাস্য মনে হয় আমার কাছে। জ্বিনকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখেছেন। আমি মৌমাছি কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। আমাদের বাড়ির পাশে তেতুল গাছ আছে। তেতুলের আচার ভীষণ প্রিয়। পাকা তেতুল কে না খেতে চায়। একদিন তেতুল গাছে উঠে তেতুল তুলতেছি। তেতুল গাছটার মগডালে মৌমাছির চাক চিলো। হঠাৎ করেই একটি মৌমাছি আমার ঘাড়ে হুল ফুটিয়ে দিলো। ব্যাথায় ছটফট করতেছি, মুখের ভেতরটা তেতুলের স্বাদে ভরে গেছে ।
জোৎস্না রাতে নিরবে হেঁটে যাওয়া মানুষটিকে কেউ যদি পাকা তেতুল খেতে দিতো।
গ্রামের নির্জন রাস্তা আমার ভালো লাগে। রাস্তায় কোনো জ্যাম নেই, কোনো মানুষের দেখাও নেই। তাই তো হাঁটতেছি, জোৎস্না রাতে চাঁদের আলোতে বের হয়েছি। এই আলো যেন ঘন কালো আধারকে আলোকিত করার চেষ্টা করতেছে।
ঘাসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। চাঁদের আলোয়, শিশির বিন্দুর সৌন্দর্য্য চোখে ধরা দিচ্ছে। আকাশে এখন মেঘ নেই, তারা ‘ রা যেন মিটমিট করে জ্বলছে। ঐ যে তারাটা ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে বোধ হয়। হঠাৎ করে আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো। কেমন যেন ভয় ভয় অনুভূতি।রাতে মানুষ নিরবে ঘুমিয়ে থাকে, অথচ আকাশটা ভয়ংকর রুপ দেখাচ্ছে। বিজলী দেখার অনুভূতি কেমন? তা তো জানি না, তবে বিজলী শেষে বিকট শব্দে বুকের ভেতর কেমন যেন লাগে। নিশ্চুপ প্রকৃতি কখনো কখনো ভয়ংকর রুপ ধারণ করে তা নিজে দেখতে পেলাম। এই বৃষ্টির পানিতে সবুজ ফসলের মাঠ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, ফলন বাড়বে। দূর হতে কোদাল হাতে কৃষক মাঠে নেমে যাবে।কারণ বৃষ্টির পানি আটকাতে না পারলে, আবার পানির সেচ দিতে হবে। ।চাঁদের আলোয় পুকুরের পানিটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। রাস্তার ধারে পুকুর। পুকুর পাড়ের গাছগুলো প্রতিচ্ছবি পানিতে ভেসে উঠেছে।
নির্জন রাতে লাইট না নিয়ে চলতেছি। বাঁশঝাড়ের কাছাকাছি এসে বাঁশঝাড়ের কথাটা মনে পড়ে যায়। সত্যি বলতে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আগের দিনে এই বাঁশছাড়ে বাঘ ছিলো। মানুষ এই বাঁশছাড়ে আসার সাহস পেত না। এখন কার দিনে, এমন বাঁশঝাড় খুবই কম আছে বটে।
আমি আমার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তো। বুঝতে পারছি, সূর্যের আলো ছাড়া চাঁদের আলোয় গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে কেমন অনুভূতি হয়। চাঁদের আলোয় সবুজ ফসলের মাঠে কেমন যেন রং বিরাজ করছে। যদিও জানি, ফসলের ক্ষেত সবুজ হয়। এই সবুজ ক্ষেতটা যেন তার আসল রূপ আমার কাছে ধরা দিচ্ছে না। আমি তো বহুদূর যেতে চাই। এই আধার পথে চাঁদের আলোর সাথে যদি একটি বৈদ্যুতিক লাইট পাওয়া যেত তাহলে হয়তো একটু সাহস পেতাম। নিদারুণ প্রকৃতি, আমায় বুঝাচ্ছে সূর্য কেমন।
হাঁটতে হাঁটতে, বাড়ির কথা মনে পড়ে। বাড়িতে বাবা-মা আছে। যদিও বাবাকে বললাম, চাদের আলোয় বেশি দূর যাওয়া যায় না। বাবা তো শ্রমজীবী মানুষ। বলেছিল, ভয় পেলে চলবে না, চাদের আলো চলে গেলে নাকি সূর্যের আলো দেখা যায়।
তাই হয়তো সামান্য চাদের আলো দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
দূর থেকে কানে ভেসে আসে শিয়ালের ডাক। শিয়াল ভারী চতুর প্রাণী। আমাকে দাদা একদিন শিয়ালের গল্প শোনাচ্ছিল, আমি দাদাকে প্রশ্ন করেছিলাম, শিয়াল যদি চতুর প্রাণী হয় তাহলে আমরা কেমন? দাদা বলে, বড় হলে বুঝতে পারবে।
এখনো বড় হতে পারি নি।
রাস্তায় হাঁটতেছি, সামনে একটি কুকুর ঘুমিয়ে আছে। মনে ভয় এসেছে, কুকুর যদি কামড় দেয়। ভদ্র কুকুর বোধ হয়, কামড় দিলো না। আমার সাথেই হাঁটতে লাগলো। বুঝতে পারলাম, এই চাঁদের আলোতে সেও মনে হয় আমার মতো একজন। দেড় মাইল পথ অতিক্রম করেছি, এবার একটি গ্রাম পেলাম বটে। পিছনে তাকিয়ে দেখি, কুকুরটি দাঁড়িয়ে আছে। তার বাসা বোধ হয় এই গ্রামেই।
মধ্যরাতে গ্রামের প্রতিটি মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাবতেছি, তারা যদি আমাকে চোর বলে পেটায়।
আমি তো চুরি করি নি, চুরি না করলে কি আমায় চোর বলবে।
নিশ্চুপ ভাবে পা ফেলতেছি৷ রাস্তার ধারেই ঘর বানিয়েছে। ঘর থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম।
ভারী অদ্ভুত, এত রাতে মানুষ কান্না করে কেন?
পাখির বাচ্চাটা তখনই বেশী কিচিরমিচির করে, যখন তার ক্ষুধা বেড়ে যায়। মেয়ে মানুষের কান্না কানে ভেসে আসছে। বোনটির কথা মনে করতেই, চোখে পানি ছলছল করছে। গত ঈদে, সে বোরকা চাইছিল। খাবার জোটে না, আবার বোরকা কিনে দিবে কেমনে?
কান্নার শব্দ শেষে শুনতে পেলাম, আল্লাহ আমার সকল দুঃখ দূর করে দাও। আমাকে পাপকাজ থেকে হেফাজত কর !
এতে বুজতে পারলাম, মেয়েটি বোধ হয় দোয়া করছে।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আসলাম, ক্ষুধা লাগছে।
ক্ষুধার তীব্র জ্বালা আমার হাঁটার গতিকে যেন বাড়িয়ে তুলছে।
খানিকটা পথ এগোতে নদীর তীরে পৌঁছালাম, নদীর পানিতে জোৎস্নার আলো ভীষণ ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
দূর থেকে দেখলে মনে হবে, এ যেন আগুনের ফুলকি। মৃদু বাতাস, নদীর পানির কলকলে শব্দ আমার সকল ক্লান্তি যেন দূর করে দিচ্ছে। নদীর সামান্য ঢেউ ছোট ছোট কচুরিপানা গুলোকে ভীষণ ভাবে দোলাচ্ছে। নদীর এই জলধারায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নদীর পানি আমায় তো ভাসিয়ে নিবে না। ডুবিয়ে মারবে। আজগুবি সব কথা মন পড়তেছে। নদীর পানিতে গোসল করতে এসে অনেকেই পটল তুলতে গেছে। নদীতে নৌকাগুলো সারি সারি ভাবে সাজানো রয়েছে। মাঝি ছাড়া নৌকাগুলো যেন পূর্ণতা পাচ্ছে না। তেরো শত এই নদীর দেশে মাঝি হাতে বৈঠা, ভাটিয়ালি গান, ছন্দ, কবিতা আর গানের সুরে যেন মন ভরে যায়। নদীর ঐ পাড়ে, মোড়লের হাট। ঐ বাজারে সকাল বেলা প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। জেলেরা রাতের আধারেই নদী পার হয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সূর্য ওঠার আগেই মাছ বিক্রি করা শুরু করে। জেলেদের আয় উপার্জন এই নদীর মাছের উপর নির্ভর করে। এই নদী না থাকলে, এত মাছ থাকতো না। জেলেরাও পরিসংখ্যান বুঝে বোধ হয়। কারণ, তারাও চাইলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রায় সব মাছ ধরে ফেলতে পারবে। কিন্তু ধরে না,সব মাছ ধরে ফেললে আগামীতে বেশী মাছ পাওয়া যাবে না। কারণ,যত কম সংখ্যক মাছ থাকে ততই কম পোনা মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাড়ে নিরবে বসে এসব কথা ক’জনেই আর ভাবতে পারে। যদিও মানুষের এসব ভাবা ততটাও ঠিক নয়। নদীর পাড়ে একাকীত্ব মনে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কবি মন, যেন এই প্রকৃতির কাছে মিনতি করছে, এক রূপসী নারীর জন্য। কত গল্পই না শোনা যেত। এই মিনতি প্রকৃতির কাছেই থাক। প্রকৃতির মায়ায় ডুবে গেলে ঐ রুপসীর কথা মনে পড়বে কি। কতই না বাসনা মনে জাগে। এই সামান্য জোৎস্নার আলোয় সূর্যের আলোর মতো প্রকৃতি দেখা সম্ভব নয় বটে। সূর্যের ডাকে প্রকৃতি আলোকিত হয় বটে, যৎসামান্য মানুষই তো জোৎস্নার আলোকে ভালোবাসে। সামান্য মানুষের এই ভালোবাসায় প্রকৃতি জোৎস্না আসে, পূর্ণিমা হয়। অম্যাবস্যার রাতে সবকিছুই কালো দেখায়। এ সময় জোৎস্না থাকে না বটে, তাই চাঁদের আলোর কথা আবার মনে পড়ে।
দূর হতে কয়েকজন মানুষকে আসতে দেখতেছি।
সাথে একটি ছোট বাচ্চা। তারা মাথায় করে কি যেন নিয়ে আসতেছে।
হয়তো এই বোঝার মাঝে মাছ আছে।
তাদের সাথে নদী পার হলে, আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো বোধ হয়। সামান্য চাঁদের আলোতে তারা যেন আমায় চিনতে পারছে না।
নৌকায় করে নদী পার হতে হলে, তাদেরকে ও কিছু দেওয়া লাগে।
আমি আমার গন্তব্য পৌঁছালে, তবেই তো তাদের কিছু দিতে পারবো।
তারা হয়তো আমায় সঙ্গে নিবে না।
হয়তো এই অপেক্ষা আরও বেড়ে যাবে।
হয়তো আসবে সে জন, বুঝবে আমায়,
আমি এখনো তার অপেক্ষায়।
ঝড় বৃষ্টির জোৎস্না রাতে,
এখনও আমি নদীর পাড়ে,
কবে তুমি আসবে, এই নদী পার করবে।
- মোঃ বিপ্লব আল হোসাইনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%83-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%ac-%e0%a6%86%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৪, ২০২৪
- মোঃ বিপ্লব আল হোসাইনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%83-%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%ac-%e0%a6%86%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%87%e0%a6%a8/রবিবার, জানুয়ারি ১৯, ২০২৫