fbpx

জানুয়ারি ২১, ২০২৫

বুক রিভিউ: ম্যাসন সিরিজ

বই: সূর্যতামসী, নীবারসপ্তক, অগ্নিনিরয়
লেখক: কৌশিক মজুমদার

সাধারণত বুক রিভিউ কিংবা কোনো বই নিয়ে আলোচনা করার ক্ষেত্রে একটি বই নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে কৌশিক মজুমদারের ম্যাসন সিরিজের তিনটি বই: সূর্যতামসী, নীবারসপ্তক, অগ্নিনিরয়, এর ক্ষেত্রে তিনটি বই একসাথে না পড়ে সমালোচনা বা রিভিউ করলে সেটি বইগুলির কাহিনীর প্রতি অবিচার হয়ে যায়। কারণ তিনটি বইয়ের গল্প এককভাবে গড়ে উঠে নি, প্রতিটিই একে অপরের সাথে জড়িত। পাঠকের বইগুলি পড়ার সময় নির্দিষ্ট সিরিয়ালেই পড়তে হবে।

ম্যাসন সিরিজটি শুরু হয় সূর্যতামসী বইটি দিয়ে। এই সিরিজের গল্পগুলির প্রধান চরিত্র তুর্বসু, দেবাশীষ, গণপতি, তরিণি, প্রিয়নাথ নাকি অন্যকেউ সেটা নিয়ে বই তিনটি শেষ করার পরেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বই তিনটিতে আরো একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র আছে, যার নাম সাইগারসন। সাইগারসন নামটি হয়তো সবার কাছে অনেক বেশি পরিচিত না, তবে একটু বর্ণনা করলে তার সাথে অতি পরিচিত একজনের মিল পাবার কথা। সাইগারসন নামটি লোকটির নিজের বানানো। তিনি থাকেন সেন্ট্রাল লন্ডনের একটা বাড়িতে এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে। এক বিশেষ কাজে গা ঢাকা দিতে এসে পরেন ভারতবর্ষে। ফাঁকা সময়ে মৌমাছি পালনের এবং বেহালা বাজানোর ইচ্ছা থাকলেও, এখানে এসেও জরিয়ে পরেন বিভিন্ন রহস্যে ঘেরা মৃত্যুর সমাধানে। লোকটির আপাত দৃষ্টিতে একজনকে দেখেই তার সম্পর্কে বিস্তারিত বলার ক্ষমতাটি এদেশের গোয়েন্দা তরিণি আর পুলিশ প্রিয়নাথের কাছে মনে হয় যেন এটা ম্যাজিক। পাঠক, কি মনে হয়? সেন্ট্রাল লন্ডনের ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের এক বিশ্ব নন্দিত গোয়েন্দার সাথে কি এই বইয়ের সাইগারসন এর মিল পাওয়া যায়? আচ্ছা, এই চরিত্রের নামটির আরো একটু বর্ণনা করা যাক। সেই বেকার স্ট্রিটের গোয়েন্দা, যিনি জানতেন না যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, উনার বাবার নাম ছিলো সাইগার। তাই গা ঢাকা দিতে এসেও লোকটি নিজের নাম সম্পূর্ণ ভাবে বদলিয়ে নিলেও নিজের পরিচয় টা ঠিকই রেখেছেন, সাইগারের পুত্র – সাইগারসন, আমরা যাকে চিনি শার্লক হোমস হিসেবে। কৌশিক মজুমদার এই ম্যাসন সিরিজে স্বয়ং শার্লক হোমসকে হাজির করবেন এই ভারতবর্ষে তা একদমই অভাবনীয় ছিলো। বই তিনটি পড়ার সময় এমন অনেক অভাবনীয় ঘটনার এবং চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।

গোয়েন্দা, থ্রিলার কিংবা রহস্য গল্পের প্রেমীরা নিজেদের কিছুটা তৃষ্ণা হয়তো মেটাতে পারবেন এই ম্যাসন সিরিজে। বই তিনটিতে ফিকশন আর নন-ফিকশন এমনভাবে মিলিয়ে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে যে ইতিহাস নিয়ে একটু ধারণা না থাকলে তা আলাদা করা সমস্যা। বইতে উপস্থিত চরিত্র কলকাতার বড়োলাট, মহারাণী ভিক্টোরিয়া, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, রবার্ট লুই স্টিভেনসন এর মতো ঐতিহাসিক চরিত্র যে বাস্তবেও ছিলো তা হয়তো সবাই ধরতে পারবেন। তবে এই সিরিজের কাহিনী তে বর্ণিত ড্রিসকল সাহেব, এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি, হেমচন্দ্র বসু, অরুণ মুখোপাধ্যায়, রজত চক্রবর্তী-রাও বাস্তব চরিত্র। অবশ্যই তাদের ঘিরে বানানো ঘটনাগুলি কাল্পনিক, তবে লেখক এই কাল্পনিক ঘটনার সাথে যেভাবে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জুড়ে  দিয়েছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। ম্যাসন সিরিজে একটি চরিত্রকে প্রথম থেকেই উত্তম পুরুষে কথা বলানো হয়েছে। আনরিলায়েবল ন্যারেটর তৈরীতে ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভের জুড়ি নেই। তবে সমস্যা হলো, এক্ষেত্রে কিছুক্ষণ চলার পরেই ন্যারেটরের প্রতি পাঠকদের সন্দেহ তৈরী হয়ে যায়। তবে কাহিনীতে মাল্টিপল ন্যারেটিভ ব্যাবহার করা হয়েছে, তাও আবার আলাদা আলাদা টাইমলাইনে। ১৮৯০ এর দশকে ম্যাসনিক ব্রাদারহুডের আসলেই এক গুপ্ত সমিতি ছিলো। তাদের বিশেষ হ্যান্ডশেক, অদ্ভুদ রিচুয়াল, চৈনিক গুপ্ত চিহ্ন এসবই সত্যি যা বইতে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে মূল কাহিনী কাল্পনিক। যদিও ওরিজিন-এর শিষ্যরা ম্যাসনিক ব্রাদারহুডকে চরম ও নরমপন্থি তে ভাগ করেছেন এই তথ্য সত্যি। তবে সেই চরমপন্থী গোষ্টি আসলেও ভারতে অনুষ্ঠিতব্য ডায়মন্ড জুবিলিতে ব্রিটিশ রাণীকে মারার ফন্দি এঁটেছিলো কিনা এটা তো কোনোভাবে জানা সম্ভব নয়। এই প্রতিপাদ্যটিকে ঘিরেই ম্যাসন সিরিজ গড়ে উঠেছে। গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আরো আছে জ্যাক দ্যা রিপার এর করা কিছু খুন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা।

পাঠক এতক্ষণ লেখাগুলি পড়ে হয়তো মনে হচ্ছে ম্যাসন সিরিজের গল্পগুলির সময়কাল ১৮৯০ এর দশক, কিন্তু এর মূল গল্পের সময়কাল একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের। সেজন্যই বলা হয়েছে যে লেখক তার গল্পতে মাল্টিপল নেরিটিভ এবং মাল্টিপল টাইমলাইন যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা প্রসংশার দাবি রাখে। গল্পে ২০১৮ সালের  ইতিহাস নিজেকে আবারো পুনরায় মঞ্চস্থ করে চলছে কোলকাতার বুকে। ঠিক শতবর্ষে আগে খুনগুলি যেভাবে করা হচ্ছিলো, এই একবিংশ শতকেও যেনো তখনকার ভুত নেমে এসেছে ঠিক তেমনইভাবে খুন করতে। এখন তুর্বসু নেমে পরেছেন এই রহস্য সমাধানে। তবে তার সাথে তো সাইগারসন, কিংবা পুলিশ প্রিয়নাথ নেই, যেমনটা ছিলো তার প্রোপিতামোহ তরিণির সাথে। তরিণির পৌপুত্র তুর্বসু কি শেষ পর্যন্ত পারেন রহস্যের সমাধান করতে? নাকি ম্যাসন সিরিজটাও একটা হেয়ালি দিয়ে শেষ হয়? প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়া যায় সিরিজের শেষ বই অগ্নিনিরয়-এ। সুখপাঠ্য হোক বইগুলি।

পুনশ্চ:

  1. অনেকদিন পরে বই রিভিউ লেখার সমস্যা হলো নিজের লেখার গঠন বা ধরণের প্রতি মাঝে মাঝে নিজেরই বিরক্তি চলে আসে। আশা করি আমার এই বুক রিভিউটি যদি প্রকাশিত হয়, তাহলে পাঠক আমার ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
  2. তিনটি বইতেই কিছু জায়গায় ভালগার (অরুচিকর) বর্ণনা এবং খুনের বিশদ বিবরণ দিতে গিয়ে কিছু নৃশংস ঘটনার বর্ণনা রয়েছে গল্পের স্বার্থে। যাদের গল্পের বইতে এমন বর্ণনা পছন্দ নয়, তাদের বই তিনটি না পড়ার অনুরোধ রইলো। সাথে ড্যান ব্রাউন-এর অরিজিন, দ্যা লস্ট সিম্বল এবং দ্যা ভিঞ্চি কোড বই তিনটি কেউ পড়ে থাকলে  খুব সহজেই হয়তো ধরে ফেলতে পারবেন যে এইসব গল্প এবং ম্যাসন সিরিজের গল্প গুলির ক্ষেত্রে প্রায় কাছাকাছি প্লট ব্যাবহার করা হয়েছে।

ধন্যবাদ।

Profile Picture
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাবর্ষঃ ২০১৯-২০