fbpx

ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫

একটি অসম্পূর্ণ গান

কল্পনা করুন- কোন একদিন আনমনে সুরেলা এক গান শুনছেন, কিন্তু গানটি শেষ হওয়ার আগেই হঠাত তাল কেটে বন্ধ হয়ে গেল। সে গান আর কখনো সম্পূর্ণই হল না। সেই মুহূর্তে যে খালি জায়গা ভিতরে বার বার খোঁচা দিয়ে যাবে, শ্রদ্ধেয় মুরশীদা খানম ম্যাডাম- আমাদের মাঝে নেই, এই কথা বারবার আমাকে তেমন একটি শূন্যতার মাঝে ফেলে দিচ্ছে।  ছাত্রী অবস্থায় উনাকে প্রথম দেখার কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে।  আমরা যখন প্রথম বর্ষে, মুরশীদা ম্যাডাম এবং ডঃ এরশাদুল হক স্যার আমাদের বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা।  প্রথম বর্ষের প্রথম দিনগুলোতে ছাত্র উপদেষ্টা ক্লাসে এসে ছাত্রদের সাথে পরিচিতি পর্বের রেওয়াজ তখনো ছিল।  ক্লাসে একজন এত রাশভারি সিনিয়র ম্যাডাম ঢুকলেন, আমরা একটু ভীত সন্তস্ত্র হয়ে উঠলাম।  যেই মাত্র তিনি কথা বলে উঠলেন, আমাদের যেন আকাশ থেকে পড়ার পালা- এত সুন্দর বাচন ভঙ্গি, এত সুরেলা রিনরিনে গলা একজন মানুষের কিভাবে হতে পারে? স্পষ্টভাষী, নিয়মানুবর্তী ও সুরেলাকণ্ঠী মুরশীদা ম্যাডামের সাথে আমাদের পরিচয়ের শুরুটা ঠিক এভাবেই।

ম্যাডাম ছিলেন আমাদের বিভাগে ইকোনোমেট্রিক্স এর অঘোষিত সম্রাজ্ঞী।  চতুর্থ বর্ষে এবং মাস্টার্সে এই ইকোনোমেট্রিক্স কোর্সের যা কিছু শিখেছি উনার হাত ধরেই শেখা। আমি চোখ বন্ধ করে বলতে পারি যে ম্যাডামের মতো গুছিয়ে পড়ানো শিক্ষক কপাল গুণে পাওয়া যায়। পরীক্ষার হলে এসে নিজ থেকে জিজ্ঞেস করতেন প্রশ্ন কেমন হয়েছে, সব উত্তর করতে পারছি কিনা। এমনকি পরীক্ষা শেষে জিজ্ঞেস করতেন পরীক্ষা কেমন হল। অস্বীকার করব না- প্রথমদিকে আমি ম্যাডামকে একটু ভয় পেতাম। একদিন আমার বেশ মন খারাপ। ম্যাডাম ক্লাসে খেয়াল করেছিলেন। আমাকে আলাদা ভাবে বললেন, “তুমি ক্লাস শেষে দেখা করবে”। আমি দুরু দুরু বুকে ম্যাডামের কাছে যাই, সত্যি বলতে ম্যাডাম আমাকে চিনেন এই ধারণা আমার ছিল না। উনার কাছে যাওয়ার পর, উনি উনার চিরাচরিত মিষ্টি গলায় বললেন “তোমার কি কিছু নিয়ে মন খারাপ? আমাকে তুমি বলতে পারো।“ ম্যাডাম এই কথা বলে যেন আমার আবেগের বাঁধ ভেঙ্গে দিলেন। অশ্রু সজল চোখে সব কথা উনার সামনে খুলে বললাম। উনি সব শুনে শুধু এইটুকুই বললেন, “চিন্তা করো না সুতপা। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার যখনই মন খারাপ লাগবে আমাকে বলবে।“ ম্যাডামের এইটুকু কথা শুনে মনে হল আমার ভিতর থেকে বিশাল একটা বোঝা যেন নেমে গেল।  আমি এরপর আর কখনো ম্যাডামকে ভয় পাইনি। ভয়ের জায়গায় মনে ঠাই পেল উনার জন্য অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।  ম্যাডাম ও যে আমাকে ভালবাসতেন সেটা আমি একটু একটু বুঝতে শুরু করি।আমার ফলাফলের পর উনি একদিন আমাকে ডেকে আমাকে একটি বই উপহার দিলেন। ম্যাডামের কাছ থেকে কত অগণিত বার না চাইতেই সাহায্য পেয়েছি তা হয়তো আমি নিজেই জানিনা।  কোন এক গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার এর পর উনি আমাকে নিজ থেকে কল দিয়ে বললেন, “সুতপা তুমি একদম ভাববে না। সব কাগজ আমাকে দিবে। আমি তোমার কাগজ সত্যয়ন করব।“কাঁচুমাচু করে বললাম, “ম্যাডাম, আমি অন্যদের ও একটু জিজ্ঞেস করে দেখব? এতগুলো কাগজ, আপনার কষ্ট হয়ে যাবে।“ ম্যাডাম অনড়।  শেষ পর্যন্ত আমার সকল কাগজ ম্যাডাম ই সত্যায়িত করেছিলেন। ম্যাডাম আসলে ছাত্রদের জন্য আকাশসম ভালোবাসা ভিতরে লুকিয়ে রাখতেন, আমি দেখেছি উনি এমন যে শুধু আমার জন্য করেছেন তা নয়। পরিসংখ্যান বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী উনার ভালবাসায় বারবার সিক্ত হয়েছে। আমার গল্পগুলো শুধু আমার নয়। আমরা যারা ম্যাডামের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম, আমাদের সবার।

Last 1
৫০ তম সমাবর্তনের সময় আমি ও মুরশীদা ম্যাডাম

আমি তখনো জানতাম না যে এইটুকু ম্যাডামের চরিত্রের শুধু একটা অংশ।  শিক্ষক হিসেবে পরিসংখ্যান বিভাগে যোগদানের পর আবিষ্কার করলাম মুরশীদা ম্যাডাম কে চেনার এখনো অনেক বাকি। ম্যাডামের মতো অসম্ভব পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, নিয়মনিষ্ঠ ও গোছানো মানুষ আমি আর দেখিনি। যত ছোট হক, আর যত বড় হোক, ম্যাডাম মন থেকে সম্পূর্ণ কাজটুকু নিজ হাতে করতেন। তিনি এত ধরণের কমিটি তে থাকতেন, কিন্তু কোন কাগজ কোথায় কিভাবে আছে, ফাইল ধরে বলে দিতে পারতেন। রেজিস্ট্রার বিল্ডিঙের কাজ কতোটা হেনস্তার ব্যাপার সে তো সবার জানা। উনি বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রত্যেকটা কাজ তুলে ফেলতেন। প্রতিটি কাজের সময় নিয়ম মেনে হচ্ছে কিনা তা বারবার পরখ করে নিতেন।শুধু তাই নয়, কোন সহকর্মী উনার কাছে সাহায্য চাইলে উনি উপদেশ দিয়ে ব্যাপারটা চাইলে শেষ করে দিতে পারতেন।উনি তা না করে বরং নিজে দৌড়ে কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেন। আমি শিক্ষক হওয়ার পর ও তিনি কতবার যে বলেছেন, “সুতপা কিছু দরকারে অবশ্যই কল দিবে”- তার ইয়ত্তা নেই। যে কোন পরীক্ষা, তা সে ইনকোর্স পরীক্ষা হোক আর ফাইনাল পরীক্ষা হোক, ম্যাডাম অন্তত আধা ঘণ্টা আগে সবকিছু নিয়ে পরীক্ষা হলে প্রস্তুত থাকতেন।  ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে Research and Publication Fair অনুষ্ঠিত হয় যার দায়িত্বে অগ্রভাগে আমাদের বিভাগের পক্ষ থেকে ছিলেন মুরশীদা ম্যাডাম।ম্যাডাম তখন প্রচণ্ড অসুস্থ। এই তপ্ত রোদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে উনি সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত এক ঠায়ে বসে থাকতেন। একদিন তিনি এত অসুস্থ শুধু স্যালাইন খাচ্ছেন একটু পর পর। আমি ব্যাপারটা খেয়াল করে উনাকে বাসায় চলে যেতে বলি। উনি কিছুতেই রাজি না। আমি অনুরোধ করলাম ম্যাডাম অন্তত আপনি একটু ঘুরে আসুন। ম্যাডাম হালকা হেসে বললেন, “সুতপা, মাস শেষে যখন বেতনটা ব্যাংকে ঢুকে, আমি নিজেকে প্রশ্ন করি আমি কি আমার সবটুকু দায়িত্ব পালন করেছি কিনা। আমি আজ পর্যন্ত কখনো আমার কাজের সাথে আপোষ করিনি।“ তিনি ঐদিন ঐ স্যালাইন খেয়েই ছিলেন শেষ পর্যন্ত বাসায় যান নাই।  একটা বিভাগের জুনিয়র ফ্যাকাল্টি যখন দেখবেন যে তার সিনিয়র এত নিষ্ঠা দিয়ে বিভাগের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত, চক্ষুলজ্জা থাকলে তিনি কখনই বিভাগকে বঞ্চিত করবেন না। ম্যাডাম তার এই স্বভাব দিয়ে আমাদের ভেতরেই কর্মনিষ্ঠার স্পৃহা তৈরি করে দিয়েছেন নিজের অজান্তেই।এই বিভাগ অনেক শিক্ষক হয়তো পাবে, কিন্তু মুরশীদা খানম যে একজন ই পেয়েছে তাতে আমি নিঃসন্দেহ।

Last 2
২০২৩ সালে DUSDAA রিউনিওন এ আমি ও মুরশীদা ম্যাডাম

পি এইচ ডি এর জন্য অস্ট্রেলিয়া আসার আগে যেদিন শেষ বিভাগ থেকে আসি, ম্যাডামকে সালাম দিয়ে বললাম “ম্যাডাম দুয়া রাখবেন, আমি আসি।“ ম্যাডাম বললেন “আসো বস কিছুক্ষণ।“ অনেক কিছু উপদেশ দিলেন। উনি আমার জন্য কত খুশি ছিলেন সেটা উনার চোখে মুখে ফুটে উঠছিল। কথার মাঝেই দেখি উনি ঐদিন ও ফল খাচ্ছেন। আমি বললাম “ম্যাডাম নিজের খেয়াল রাখবেন। শরীর খারাপ লাগলে বাসায় চলে যান। শুধু ফলমূল খেয়ে কত ভালো লাগে?” উনি হেসে দিলেন। বললেন-“ এইযে ডিপার্টমেন্টের জন্য এত করলাম, আমি মারা গেলে তুমি কিন্তু লিখবে এইগুলো। মানুষ যেন জানে আমি কত কষ্ট করেছি।“ আমি ম্যাডামকে মৃদু ভর্ৎসনা করলাম “ম্যাডাম এইসব অলক্ষুনে কথা কেন যে বলেন!” ম্যাডাম হেসে দিলেন। ওইটাই আমাদের শেষ দেখা। যেদিন সকালবেলা শুনলাম ম্যাডাম আর নেই, আমার ঐ কথাগুলো আমার কানে বাজছিল।

আজ যখন আমি উনাকে নিয়ে লিখছি, উনার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার চোখের সামনে ভাসছে।প্রচণ্ড আবেগী ছিলেন আমাদের ম্যাডাম। বিভাগের প্রোগ্রামে ম্যাডাম আর বলবেন না “সুতপা আমার সাথে কিন্তু ছবি তুলবে।“ নবীন বরণের স্টেজে উনার গলায় কোন নজরুল সঙ্গীত আর শোনা হবে না। যে কোন সমস্যায় কল দিতে বলা মানুষটা আর নেই এটা কিভাবে আমি মেনে নিই! না বলতেই চেহারা পড়ে ফেলা মানুষটিকে আর দেখব না কিভাবে স্বীকার করি? আমি তো শেষ দেখায় উনাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছি। উনাকে আর দেখব না এটা তো বলে আসিনি।  উনার গলা তো এখনো আমার কানে বাজছে।মনে হচ্ছে বিভাগে গেলেই দেখব উনি করিডোরে হাঁটছেন, কিংবা উনার রুমে আনমনে কাজ করছেন, কিংবা জাফর স্যার বারি স্যারের সাথে কথা বলছেন। পাশ কাটিয়ে যেতেই এইতো হেসে মিষ্টি গলায় বলে উঠলেন “ভালো আছো সুতপা?”। বড্ড অসময়ে চলে গেলেন ম্যাডাম। আমি আপনাকে ঠিকমতো বিদায় পর্যন্ত দিতে পারিনি।  আমার এই অভিমান আপনার প্রতি থাকবে, কেন আপনি আমাকে এই সুযোগটুকু দিলেন না? তবে আমি আপনার অনুরোধ রেখেছি, আমি লিখেছি আপনাকে নিয়ে স্মরণিকা। কিন্তু মুরশীদা ম্যাডাম, আমি যদি জানতাম ঐদিন ই আমাদের শেষ দেখা হচ্ছে তবে আমি আপনাকে অবশ্যই বলতাম- আপনার অবদান বিভাগের প্রতিটি ধূলিকণা জানে, আপনি আমাদের মনের কোণে থাকবেন আজীবন।  আপনার উপস্থিতি আমাদের জীবনে সেই গানটি ছিল যা হাজার ঝামেলার মাঝেও সমাধান দিয়ে মনকে স্থির করে তুলত।   আপনিও আপনার জীবনের গানটি অসম্পূর্ণই রেখে গেলেন।  আপনার চলে যাওয়ায় কেটে যাওয়া তাল খুঁজে আমরা হয়তো আর কোনদিনই পাবো না।

02 copy
প্রভাষক | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ৬১ তম ব্যাচ