fbpx

ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫

প্রত্যাশা

প্রথম বর্ষের সাইন্স ফ্যাকাল্টির নবীনবরণ। ভার্সিটির প্রথম উৎসব নিয়ে নতুন মুখগুলোর মধ্যে রাজ্যের কৌতূহল। স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজর বাহার স্যার ক্লাসে আসলেন, নবীনদের মধ্যে একজনকে অনুভূতি প্রকাশের জন্য নেওয়া হবে; আগামীকাল আগ্রহীরা যেন স্ক্রিপ্ট নিয়ে আসে। তখনও হলে সিট পাইনি। সারাদিন ক্যাম্পাসের হৈ-হুল্লোড়ের পরে শেষ বাসটা ধরে গাজীপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যেত।

একরাজ্যের ক্লান্তি ভর করা কাঁপা কাঁপা হাতে একটা লিখে ফেললাম ভাঙ্গাচূড়া একটা স্ক্রিপ্ট। ইচ্ছা ছিলো ক্লাসের ফাঁকে সুন্দর করে রি-রাইট করে ফেলব, কিন্তু পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হওয়া গিনিপিগদের যে দম ফেলার অনুপাতে ক্লাস করতে হয়, সেই বাস্তবতা এই বেচারার তখনও বোধগম্য হয় নি। কী আর করা! রীতিমতো বাহার স্যার ক্লাসে এসে বললেন, কে কে লেখা আনসো, ভয়ে ভয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু কাটাছেঁড়ায় মাখা স্ক্রিপ্টটা দেখাতে চাচ্ছিলাম না। স্যার বুঝলেন; সহজ একটা হাসি দিয়ে বুঝালেন যে, প্রথম লিখলে এরকম হওয়া খুব স্বাভাবিক। তিনি নিজে স্ক্রিপ্টটা পড়লেন এবং আমাকে নিয়ে গেলেন মুরশীদা ম্যাডামের রুমে। ম্যাডাম স্ক্রিপ্ট দেখে পড়ে শোনাতে বললেন। দুপুরের রোদে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসা হাতে ধরে কোনোমতে স্ক্রিপ্টটা পড়লাম। আল্লাহর রহমতে উনার পছন্দও হলো! তারপরের কয়েকদিন উনি নিজে আমার স্ক্রিপ্ট এডিট করে দিলেন, বাচনভঙ্গি ঠিক করে দিলেন, উনার সাথে একতালে প্র্যাকটিস করালেন। অবশেষে নবীনবরণের দিনে প্রথমবার টিএসসিতে শ্রদ্ধেয় লুৎফর স্যার, ভিসি স্যারের বসে থাকা স্টেজে দাঁড়িয়ে আমি কিছু বললাম।

সেই যে শুরু হলো! এরপরে গত ছয়টি বছরে একের পর এক স্ক্রিপ্ট নিয়ে মুরশীদা ম্যাডামের কাছে যাওয়া হয়েছে বারংবার! উনি কখনো বিরক্ত তো হতেনই না, বরং খুশি হয়ে আমাকে গাইড করে গেছেন। সেই সূত্রেই হয়তো অনেক আদর করতেন ম্যাডাম আমাকে, আলহামদুলিল্লাহ।

চতুর্থ বর্ষে প্রথমবার উনার ক্লাস করার সুযোগ হয়। কী যে সুন্দর করে লেকচার গুছিয়ে ক্লাসে বুঝিয়ে এবং সংখ্যাগুরু শিক্ষার্থীর মনোযোগ ধরে রেখে পড়াতেন, মা শা আল্লাহ! রোজার ছুটিতে শুনলাম ম্যাডাম হঠাৎ অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অবস্থা এতটাই গুরুতর হলো যে আমাদের কোর্সটা আর কন্টিনিউ করতে পারলেন না। কিন্তু তাও প্রশ্ন উনিই করেছিলেন আর খাতাও তিনিই দেখলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে সে যাত্রায় ম্যাডাম সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে এলেন।

মাস্টার্স আবারও ম্যাডামের ক্লাস পাওয়ার সৌভাগ্য হলো। শুরুর দিকে অন্যান্য কোর্সগুলো যখন স্বাভাবিক তালে চলছিলো, ম্যাডাম ক্লাসে এসে বারবার বলতেন,  “তোমাদের ফোর্থ ইয়ারের কোর্সটা শেষ করাতে পারিনি, সেজন্য খারাপ লাগে। এবার একটু বেশি বেশি ক্লাস নিব, আগে আগে শেষ করার চেষ্টা করব, যদি আবার পরে অসুস্থ হয়ে যাই!” এবং করলেনও তাই। এই দূর্বল শরীরটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের উপর জুলুম করেই শেষ করলেন আমাদের “এডভান্স ইকোনোমেট্রিক্স”।

৭০ ব্যাচের ওরিয়েন্টেশনের পর উনার সাথে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম, উনি উনার চেয়ারটায়  বসেছিলেন, আমি পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। উনি নিজে থেকে আমাকে বললেন, “রুহী, তুমি কিন্তু চাইলে আমাকে ধরে ছবি তুলতে পারো।” আমি সাহস পাচ্ছিলাম না। উনি আবারও একই কথা বললেন। তারপরে  আমি উনার কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুললাম। এই ছবিটা দেখে যে একসময় দীর্ঘশ্বাস আসবে, তা কি আর তখন জানতাম!

কোরিডোরে দেখা হলে বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, “তোমার থিসিসের কোনো হেল্প লাগলে অবশ্যই আমার কাছে এসো।” উনার রুম ক্রস করে যাওয়ার সময় রুমে ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, “সবাই ক্লাস বুঝতেসে তো? আমার পড়ানো ধরতে পারছে তো?” না বুঝলে অথবা কোনো সমস্যা থাকলে এসে বুঝে যেও।

এই মানুষটা আর আমাদের মাঝে নেই! গত ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, উনার বিদায়-সংবাদ শুনার পর থেকেই এই মুহূর্তগুলো চোখের সামনে একটু পর পর ভেসে উঠছিল। ডিপার্টমেন্টের কত যে কার্যক্রমে উনার ছোঁয়া মিশে আছে, হিসেব করা কঠিন। উনার রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এখনও যেন থমকে যাই। ৪১২ নম্বর রুমটার ঝোলানো তালাটা হয়তে একদিন খোলা হবে, শুধু থাকবেনা তার ভিতরের স্নিগ্ধ হাসিমাখা মুরশীদা ম্যাডামের মুখ। এরকম হাসিমুখের উষ্ণ আহ্বান জানানো মানুষটা এত জলদি ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন সেটা মেনে নেওয়া সত্যিই খুব কষ্টকর। তাই উপসংহারে এই প্রত্যাশা- আল্লাহ উনাকে অনেক ভালো রাখুন- আমিন।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৮-১৯