জুন ১৬, ২০২৫

মুরশীদা ম্যাডাম

“মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে  অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।”

– সমরেশ মজুমদার

মুরশীদা খানম ম্যাডামকে আমার ভিজিটিং কার্ডটা আর কোনোদিন দেওয়া হয়ে উঠবে না।

কারো সঙ্গে কবে-কখন আমাদের শেষ দেখা হয়ে যায় আমরা টেরই পাই না। কালচক্রের এই জটিল আবর্তনে শেষ দেখা নিরূপণ করা সম্ভবপর নয়। সেটি সম্ভব হলে কী রকম হতো ব্যাপারটা? হয়তো খুব ঘটা করে জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা হতো কোথাও; স্মৃতিময় আর সুখকর করে তোলার সবরকম প্রয়াস করা হতো। কোথাও হয়তো আবার কান্নার রোল পড়ে যেত; আবেগঘন আলিঙ্গন আর সম্ভাষণের মধ্য দিয়ে শেষ হতো সেই শেষ দেখা।

জীবনই যেখানে এত অনিশ্চিত আর সংক্ষিপ্ত সেখানে ভূমিকা আর দীর্ঘায়িত করছি না।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে না আমি সেই পর্যায়ের ছাত্র ছিলাম বা না এমন কোনো এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজের সাথে যুক্ত ছিলাম যে কারণে শিক্ষকরা আমাকে চিনবে। সে আশাও করিনি কোনোদিন। মেধাবীদের এই ম্যারাথনে বছরের পর বছর টিকে আছি এই আমার আত্মতুষ্টি। এর পরেও পথে-ঘাটে পাশ কাটাতে গিয়ে যে দু-একজন শিক্ষক আমাকে আমার নামে চিনতেন তাঁদের মধ্যে মুরশীদা খানম ম্যাডাম একজন। মুরশীদা খানম ম্যাডাম আমাকে চেনেন মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ডিপার্টমেন্টে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার দরুন। সেবার বুঝলাম ম্যাডাম কতটা কাজপাগল মানুষ আর নিজের কাজটি কত গুরুত্ব আর যত্ন সহকারে সম্পাদন করেন। কে কে লেখা দিতে চায় তার একটা তালিকা তিনি আহ্বান করেছিলেন আগেই।

ভরপুর করোনা মহামারী। একদিন হঠাৎ ম্যাডামের কল। পরে বুঝলাম, ম্যাডাম আবার সেই তালিকা ধরে ধরে খোঁজ নিচ্ছেন কার লেখা কদ্দূর। বলা বাহুল্য, তখন আমার সংগ্রহে লেখার কোনো উপাদান নেই। বইপত্র সব হলে। একমাত্র সম্বল ল্যাপটপটিতে ছোট বোন একদিন মহানন্দে পা উঠিয়ে দিয়ে ডিসপ্লের বারোটা বাজিয়েছে। সেটি আর ব্যবহার উপযোগী নেই আর সারাবার জন্য বাইরে যাবারও কোনো উপায় নেই- চারদিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনীর কড়া পাহারা। কিন্তু আমার সে সাহস নেই যে উনাকে বলব লেখায় এখনও হাত দিয়ে উঠতে পারিনি। বলেছিলাম, “ম্যাডাম, অনেকটাই শেষ। ডেডলাইনের আগে দিতে পারব আশা করি। সেই এক কলের পর লেখাটা নিয়ে আমাকে বসতে হয়েছে। কেননা, সেই লেখা আর জমা না দিয়ে ম্যাডামের ক্লাসে বসবার সাহস আমার ছিল না।

মহামারী কেটে গেল। সশরীরে ক্লাস শুরু হলো মাস্টার্সের। পুরস্কার যেদিন দেওয়া হবে তার আগের ক্লাসগুলোতে কয়েকবার করে আমাকে বলেছিলেন, “হরিপদ, তুমি কিন্তু অনুষ্ঠানে অবশ্যই থাকবা।” এরপর আবার সি.আর. কে দিয়ে বলিয়েছিলেন; এক ইমিডিয়েট ভাইকে দিয়েও বলিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একবারও পুরস্কার পাবার কোনো উল্লেখ করেননি। ঘটনাটি খুবই সামান্য এবং সাদামাটা। কিন্তু এটি আমাকে ম্যাডামের চরিত্রের দুটি দিক উন্মোচনে সহায়তা করেছে।

এক. কাজের প্রতি তার একনিষ্ঠতা; কোনো কাজকে সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য তার একাগ্রতা এবং

দুই. কাজে শতভাগ স্বচ্ছতা এবং সততা অটুট রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।

সে বার পুরস্কার হিসেবে বই পেলাম; পেলাম একটি ক্রেস্ট এবং নগদ দশ হাজার টাকা। লেখালেখি করে সেটি আমার প্রথম অর্থ উপার্জন। ছাত্রাবস্থায় সে টাকা অনেক টাকা। আমার আনন্দের সীমা রইল না। ক্লাসের কারও মনে আছে কিনা জানি না, সেই টাকা থেকে ক্লাসের সবাইকে নিমকি আর মিষ্টি খাইয়েছিলাম ক’দিন পর। কাজের খরচ বলতে সেই একটাই হয়েছিল। বাকি টাকা উড়িয়ে দিলাম। বেশ কিছুদিন পর একদিন ম্যাডামের রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, ডেকে বললেন, “এতগুলো টাকা দিয়ে কী করেছ, হরিপদ? রেখে দিয়েছ না ব্যাংক একাউন্ট বা কোথাও?” ভয়মিশ্রিত হাসিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। সেইদিন বুঝলাম, ম্যাডাম শুধু ক্লাসেই নয়, নিজের মস্তিষ্ক আর হৃদয়েও তাঁর শিক্ষার্থীদের জন্য সময় ব্যয় করেন।

আমি অস্বীকার করছি না যে ম্যাডাম রাগী মানুষ ছিলেন না বা সবাই তাঁকে খুব পছন্দ করত। কিন্তু সেইসাথে এটিও স্বীকার করে নিচ্ছি যে, ম্যাডাম একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। ক্লাসে বেশি পড়ানো শিক্ষককে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পছন্দ করে না। এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ম্যাডাম পড়াতে পছন্দ করতেন। তাঁর পড়ানোর ধরণই ছিল এমন যে, ইকোনোমেট্রিক্স এর মতো কোর্সকেও কঠিন মনে হয়নি আমার কাছে। প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসগুলো এমনভাবে নিতেন যে পরীক্ষার আগের রাতে একবার চোখ বুলালেই দিব্যি পুরো উত্তর দেওয়া যেত পরীক্ষায়।

মাস্টার্সে দুইটা যে ঐচ্ছিক কোর্স ছিল তার মধ্যে একটা এই এডভান্সড্‌ ইকোনোমেট্রিক্স। দেখা গেল, আমাদের ক্লাসের নব্বই শতাংশ শিক্ষার্থী এই কোর্সটাই নিল। আর যে একটা কোর্স ছিল সেটা নিল বাকিরা যাদের আবার বেশিরভাগই ক্লাস না করার ভয়ে। কারণ, ম্যাডামের ক্লাস নিয়মিত করতে হতো আর তারা ইতোমধ্যে চাকরির পড়াশোনায় মগ্ন – কোনোক্রমে মাস্টার্সের একটা সার্টিফিকেট তাদের চাই, এই যা।

ম্যাডামের সাথে শেষ দেখা হলো গত বছরের (২০২৪) সাতাশ অক্টোবর। প্যাপাইরাসের রজতজয়ন্তী উপলক্ষ্যে মুদ্রিত বিশেষ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে উনার অফিসকক্ষে গেলাম। বরাবরের ন্যায় কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত। বাইরে কয়েকজন দাঁড়িয়েও আছে তাঁর সাথে দেখা করবে বলে। ভেতরে ঢুকে নমস্কার দিলাম। আর কিছু বলার আগেই সেই চেনা হাসিমুখে বললেন, “ভালো আছ, হরিপদ? তোমার একটা ভিজিটিং কার্ড দাও তো।” আমি বললাম, “ম্যাডাম, কার্ড তো এখনও বানানো হয়নি। সবে জয়েন করলাম তো।” উনি বললেন, “ও আচ্ছা, ঠিক আছে। হলে দিও। আমার একটা কার্ড নিয়ে যাও ধর।” ম্যাডামের সেই ভিজিটিং কার্ড এখনও আমার ওয়ালেটে। এই ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক পরে অফিস থেকে আমাকে আমার ভিজিটিং কার্ড দেওয়া হলো। কিন্তু আমার সেই ভিজিটিং কার্ডটা আর কোনোদিন দেওয়া হয়ে উঠবে না তাঁকে। চৌদ্দই ডিসেম্বর ম্যাডাম অসীমে পাড়ি জমালেন; যেন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আরেক বুদ্ধিজীবীর প্রয়াণ!

এই বা মন্দ কী! কর্মব্যস্ততার মধ্য থেকে এমন মৃত্য ক’জনই বা পায়। হয়তো উনি পরের দিনের ক্লাস নেবার জন্য নোট গোছাচ্ছিলেন, জমে যাওয়া পরীক্ষার খাতাগুলো তাড়াহুড়ো করে দেখছিলেন দ্রুত সেগুলো ফেরত দেবেন বলে। এমন সময় মৃত্যুদূত এসে উপস্থিত। বৃদ্ধ বয়সে একাকীত্বে ভুগে, রোগ-শোক আর জরা ব্যাধিতে ভারাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের চেয়ে এমন মৃত্যই কী কাম্য নয় মানুষের? আমার তো কাম্য। আধ-পড়া একটি বই টেবিলে উল্টানো; পরদিন কোনো জরুরী কাজ কিংবা প্রিয় কোনো মানুষের সাথে দেখা করবার তাড়া। এমনি এক সময়ে যমদূতেরা এসে হাজির হোক আমার সামনে– না কিনা তখন, যখন বয়সের ভারে শরীর নেতিয়ে পড়েছে, বিছানা থেকে উঠবার জো নেই, ছেলে-মেয়েরা আপদ ভাবতে শুরু করেছে।

“এই যে বেঁচে ছিলাম
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয় সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে উঠি
জীবন ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে।”
– রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

কাজপাগল ভালো এ মানুষটি ভালো থাক তাঁর অনন্ত বিশ্রাম যাত্রায়। তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম…

Last

0504 হরিপদ শীল অব্যক্ত Poem 2nd 1
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬-১৭

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ