জুলাই 12, 2025

রুম নং-৪১২

স্কুল-কলেজে পড়াকালীন আমি কোনো কো-কারিকুলার কাজকর্মে ছিলাম না কখনোই।  ইচ্ছা হতো না- তা না; পারতাম না কিছুই, তাই থাকতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তির পর আমার ডিপার্টমেন্টভিত্তিক কো-কারিকুলার কাজকর্ম শুরু হলো। প্রথম স্টেজে উঠেছিলাম প্যাপাইরাসের ৪র্থ বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনার জন্য।  ওখানেই শুরু; এরপর এক এক করে অনেকগুলো অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করলাম। অন্য সব উপস্থাপনার থেকে কিউএমএইচ স্ট্যাটিসটিকস ক্লাবের ওয়েবসাইট উদ্বোধন অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা ছিল অন্যরকম।

ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে রাগী ম্যাডাম হিসেবে যাকে আমি এতো ভয় পেতাম, যাকে দেখে আমি লুকিয়ে যেতাম মানুষের ভিড়ে; সেই মুরশীদা ম্যাডামের ৪১২নং রুমে প্রথম যেতে হয়েছিল ঐ অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট ঠিক আছে কিনা দেখাতে। উপস্থাপনার জন্য ছিলাম আমি আর মুহেব্বুল। আমি এতোই ভয় পাই ম্যাডামকে যে  এক পা আগাই, আবার পিছাই। এমন করে ৫মিনিটের করিডোর আমরা ১০মিনিটে গিয়েছিলাম। এরপর রুমে ঢুকে আমি চুপ; নম্র, ভদ্র, ভালো মেয়ে। কোনোদিকে তাকাই না। তখন ম্যাডাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আম্মু, তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো?”

এতো সুন্দর করে বললেন! আমি অপলক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর তিনি হেসে বললেন, “আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই, আর তোমাদের স্ক্রিপ্ট সুন্দর হয়েছে।” এও বললেন, “তোমরা যেখানে বসবে তোমাদের পাশেই আমার জন্য চেয়ার রেখো, বক্তব্যের পর যে তাৎক্ষনিক কিছু শব্দ বললে উপস্থাপনা সাবলিল লাগে ওগুলো আমি লিখে দিব, যেন তোমরা সুন্দর করে বলতে পারো।” ম্যাডামের নির্দেশ মোতাবেক ওমনভাবেই সব করা হলো। দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠান আমাদের চালিয়ে নিতে হবে, আবার ম্যাডামও বসবেন আমাদের সাথে; সব মিলিয়ে খুব ভয়ে ছিলাম। তখন বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল “পড়ল এবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা।”

কিন্তু হলো পুরো উল্টো; অনুষ্ঠানের দিন এসেই ম্যাডাম বললেন, “এখানে বসেছ তোমরা, তাহলে আমাকে ভিতরে দাও। এরপর তুমি বসো।” এই বলে আমার হাত ধরে উনার পাশে বসালেন। বসলাম, অনুষ্ঠান পরিচালনা করলাম। অনুষ্ঠানের পর ম্যাডামের সার্বিক দিকনির্দেশনার জন্য ধন্যবাদ জানাতে উনার সেই ৪১২নং রুমে গেলাম। আমাদের কথা শুনে ম্যাডাম বললেন, “বাবা তোমরা অনেক ভালো করেছ। আমার তোমাদের অনেক ভালো লেগেছে। আমার নাম্বার আছে তোমাদের কাছে? এই নাও আমার কার্ড। আর তোমাদের নাম্বার আমার কাছে আছে। প্রয়োজন হলে কল দিও। আর প্রয়োজন না হলেও এই রুমে এসে মাঝেমাঝে ম্যাডামকে দেখে যেও তোমরা।”

এরপর প্যাপাইরাসের পঁচিশ বছরে পদার্পণের এক অনুষ্ঠান হলো; সেখানেও স্ক্রিপ্ট নিয়ে হাজির ম্যাডামের রুমে। ম্যাডাম হাসিমুখে ভুল ঠিক করে সব বুঝিয়ে দিলেন, সাথে ঐ অনুষ্ঠানের সবচেয়ে জটিল অংশ, কুইজ পরিচালনা, তার দায়িত্ব দিয়ে দিলেন আমাদের। আবার আমাদের যায় যায় অবস্থা! কারণ আগে কখনো পরিচালনা করি নাই কুইজ। আল্লাহর রহমতে এবারও পাশ মার্ক নিয়ে উতরে গেলাম, ম্যাডাম খুব খুশি হয়েছিলেন। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ম্যাডামের সাথে করিডোরে দেখা; আমাকে শাড়িতে দেখে বললেন, “তোমাকে শাড়িতে সুন্দর লাগছে।”  বললাম, “ম্যাডাম আপনিও পরতেন!” বললেন,”না, মা কাজ থাকে তো, তাই পরা হয় নাই।  কিন্তু পরের অনুষ্ঠানে শাড়ি পরে তোমাদের সাথে ছবি তুলব।” খুশি হয়ে বললাম, “ইনশাআল্লাহ ম্যাডাম।”

সেদিনের সেই পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে উনি খুব খুশি ছিলেন; কি স্নিগ্ধ ছিল সেই হাসি!

হঠাৎই একদিন ক্লাসের পর ম্যাডাম কল দিলেন। আমি তখন বাসে। কল ধরার পর জিজ্ঞেস করলেন, “আম্মু, তুমি কি ডিপার্টমেন্টে আছ? বললাম না ম্যাডাম আমি বাসায় যাচ্ছি, বাসে আছি।” বললেন, “ওহ, আচ্ছা। সাবধানে যেও।” জিজ্ঞেস করলাম, ” ম্যাডাম কিছু কি প্রয়োজন ছিল? আসব আমি?” বললেন,”না, না। ভেবেছিলাম ডিপার্টমেন্টে আছ। থাকলে কথা বলতাম আর একটা লিখা ছিল ওটা তোমাকে দিতাম।” বললাম, “আচ্ছা ম্যাডাম, কাল এসেই আমি নিব আপনার থেকে।” হেসে বললেন, “তুমি তো আমার লক্ষ্মী আম্মু, তাই তো তোমাকে কল দেই। এতো সুন্দর করে কথা বলো। কাল এসো তবে।”

250114

পরদিনই গিয়েছিলাম উনার কাছে। এরপর ইনকোর্স পরীক্ষা শুরু হলো। ব্যস্ত হয়ে গেলাম বইয়ের পাতায়। হঠাৎ একদিন এক ক্লাসরুম থেকে অন্য ক্লাসে যাবার সময় করিডোরে ম্যাডামের সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলেন, “আম্মু এখন আর আসো না তো আমার রুমে!” পরীক্ষার জন্য যেতে পারছি না জানালাম ম্যাডামকে। এরপর বললেন সময় পেলে যেন যাই।  ওটাই শেষ দেখা আমার ম্যাডামের সাথে। ছুটির আগে ম্যাডামের সাথে দেখা করব ভাবলাম, কিন্তু ক্লাস দেরিতে ছুটি হওয়ায় ম্যাডামকে উনার রুমে পেলাম না। ভাবলাম ছুটি শেষ হলে দেখা করব!

ছুটি শেষ তো হয়েছিল; কিন্তু আমার ম্যাডামের সাথে সাক্ষাৎ করা হয় নাই। এর আগেই চলে আসলো ১৪ই ডিসেম্বর; ম্যাডাম পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। যখন খবরটা পেলাম, আমি কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। না পারছিলাম কিছু করতে, না পারছিলাম কিছু বলতে। শুধু মনে হচ্ছিল, চলে গেলেন! দেখা করতে পারলাম না!

খসে পড়ল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

বাস্তবতা হলো অনেক অনুষ্ঠানই হবে ডিপার্টমেন্টে, কিন্তু ম্যাডামের সাথে শাড়ি পরে ছবি তোলা আর হবে না আমার।

ম্যাডামকে আমার বলা হয়ে উঠবে না কখনো; উনাকে আমারও খুব ভালো লাগতো।

এখন আর ভিজিটিং কার্ডের সেই নাম্বারে কল করলে ওপাশ থেকে শোনা যাবে না, “হ্যাঁ আম্মু বলো।…”

আবার কল করেও কেউ ডাকবেন না, “লক্ষ্মী আম্মু।…”

কেউ স্ক্রিপ্ট নিয়ে ৪১২নং রুমে ডেকে পাঠাবেন না;

কেউ বা এখন এও আবদার করবেন না মাঝেমাঝে এসে দেখা করে যেও।

প্রিয় মানুষটা এভাবে আল্লাহর কাছে চলে গেলেন! উনাকে আমার রব হয়তো আরও বেশি পছন্দ করেন; তাই তো উনার কাছে নিয়ে নিলেন। আল্লাহর কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা উনি যেন আমার ম্যাডামকে জান্নাতবাসী করেন।- আমিন।

20241217 085849
নুঝাত নাজিয়া
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১ম বর্ষ

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp

আরও লেখা সমূহ