১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
বিগত বছরের শেষ মাসের এই রাতে শীতকালীন ছুটির হোমওয়ার্কে কীভাবে সাইন নিবো সেই চিন্তা করছিলাম, এখনো খাতাটা টেবিলেই আছে, হয়তো সাইনের প্রহর গুনছে, খাতা তো জানে না যে মহামূল্যবান সাইন দেবার মানুষটা চলে গেছে জীবন নদের ওপারে; কিন্তু আমি জানি আমিসহ আমার ক্লাসওয়ার্কের খাতা ভাগ্যবান কিন্তু টেবিলে পড়ে থাকা হোমওয়ার্কের খাতাটা অভাগা, সাইনটা পেলো না সে, আর পাবে না কখনো। সিগনেচার জমানোর এক্সাইটমেন্ট এখানেই শেষ!
আসলে এখন বুঝতে পারছি যে, ফার্স্ট ইয়ারে সাধারণত ক্লাস পাওয়া না গেলেও এত সুন্দর ক্লাসনোট এবং এত চমৎকার উপস্থাপন বিধাতা আমাদের দেখাতে চেয়েছিলেন বিধায়ই মাসখানেকের জন্য হলেও লুৎফর স্যারের স্থানান্তরে তাঁর ক্লাস করার সুযোগ হয়েছিল।
একদা সেন্ট্রাল ওরিয়েন্টেশনের পরের দিন বিভাগের জনৈক কিছু নারী শিক্ষার্থীর সহিত তাঁর কথোপকথন –
ম্যাডাম: তোমাদের কয়েকজনকে আমি দেখেছি শাড়ি পড়ে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে যাচ্ছো টিএসসি এর দিকে! আমি তোমাদের দেখলেও তোমরা আমাকে দেখনি, আমি তোমাদের সামনে যাইনি।
আমাকে দেখলে আবার সালাম দিবা, একটু ফরমাল হয়ে যাবা, উচ্ছ্বাসটা একটু দমে যাবে, এজন্য আমি সামনে যাইনি।
বাসায় গিয়ে আমাদের সময়ের ছবিগুলো বের করে দেখলাম।
নারী শিক্ষার্থীরা: ম্যাডাম, আসতেন আপনি। আপনার সাথে ছবি তুলতাম আমরা।
ম্যাডাম: আরে, সময়তো আরও আছে! সামনে চার বছরে কত ছবি তোলা হবে।
আমরা চাইলে তো এখানেই ছবি তুলতে পারি।
ম্যাডামের কিছু কথা আজও কানে বাজে –
১. এই ক্লাসে ছেলেরা বেশি কথা বলে।
২. পেছনে কথা বন্ধ করো প্লিজ।
৩. পেছনে কথা হচ্ছে কিন্তু।
৪. গতক্লাস থেকে তোমাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি? তোমাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে তোমরা আমাকে যে কোনো সময় প্রশ্ন করতে পারো। ক্লাসের সময়েই প্রশ্ন করতে হবে এমন না।
৫. তোমরা ভার্সিটির বিভিন্ন প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করার ট্রাই করবে। পড়াশোনার পাশাপাশি এগুলোরও দরকার আছে।
৬. এই ছেলে, উঠে দাঁড়াও, তুমি হাসছিলে কেনো? খুব হাসি পাচ্ছে তোমার, কারণ কী?
৭. আগামীদিন থেকে ক্লাসে এরকম সাফোকেশন হলে ক্লাস নিবো না কিন্তু!
৮. প্রশ্ন করার আগে ভেবে আসবে প্রশ্নটা রেলেভেন্ট কিনা, ইররেলেভেন্ট প্রশ্ন করবে না।
একবার আমাদের হতাশ দেখে ম্যাডাম বলেছিলেন-
“তোমরা এত হতাশ কেন বাবারা? আমাকে দেখো, ভুল চিকিৎসার কারণে আমি এখন ঠিকমতো হাঁটতে পারিনা, তোমরা হয়তো খেয়াল করবে আমি একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটি, তাই ক্লাসে আসতে আমার একটু দেরি হয়।
তাই বলে কি আমার কোনো অভিযোগ আছে জীবনের প্রতি? না। সৃষ্টিকর্তা আমাকে অনেক ভালো কিছুও দিয়েছেন।
যখন ভালো কিছু পেয়েছি তখন তো বলিনি ‘why me?’, তবে যখন খারাপ কিছু হবে তখন কেনো বলবো ‘why me?’
শীতকালীন ভ্যাকেশনের আগে লাস্ট ক্লাসে তাঁর মুখনিঃসৃত কিছু কথা- “তোমরা ভালো থেকো, নিজেদের যত্ন নিও, খুব কম মানুষই নিজের যত্ন নেয়!
তোমাদের সাথে হয়তো আবার দেখা হতে পারে, আবার হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে, বেঁচে থাকলে অবশ্যই হবে ।
তোমরা উইন্টার ভ্যাকেশন ভালোভাবে কাটাও, পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নাও, জানোই তো, ১ম পরীক্ষাটা(১ম ইনকোর্স তথা STAT H-101 কোর্স) কিন্তু আমার!
ঠিক আছে যাও, ক্লাস শেষ।”
চিরদিনের জন্য যে শেষ তা কখনোই ভাবিনি।
জীবন একটু বেশিই অনিশ্চিত!
হয়তো কেউই কখনো ভাবেনি যে ২০২৪ ই তাঁর জীবনের শেষ বছর হয়ে যাবে।
৫ নভেম্বর, ২০২৪ এ ক্লাসওয়ার্কে পাওয়া তাঁর একখানা সিগনেচার আজও আগলে রেখেছি।
তসলিম স্যারের পর ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে ঢাবির পরিসংখ্যানে আরও একখানা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মৃত্যু; অধ্যাপক মুরশীদা খানম ম্যাডাম, যাঁর ছড়িয়ে যাওয়া দ্যুতি হয়তো ছড়াতে থাকবে কিন্তু এই শূন্যতা হয়তো কখনোই পূরণ হবে না।
- শাহ মোঃ মোফাজ্জল হোসেনhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9-%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%83-%e0%a6%ae%e0%a7%8b%e0%a6%ab%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%b2-%e0%a6%b9%e0%a7%8b%e0%a6%b8%e0%a7%87%e0%a6%a8/বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ১৪, ২০২৪