এপ্রিল ২৭, ২০২৫

সাহিত্য পর্যালোচনাঃ ওয়ার এন্ড পিস

সাহিত্য পর্যালোচনাঃ ওয়ার এন্ড পিস

লেখকঃ কাউন্ট লিও তলস্তয়

To study the laws of history we must completely change the subject of our observation, must leave aside kings, ministers, and generals, and study the common, infinitesimally small elements by which the masses are moved.”

ইতিহাস এর সত্যিকারের গতিপ্রকৃতি জানতে আমাদের রাজা বাদশাহ, তাদের জীবন, স্ত্রী-সন্তান এর ব্যাপারেই কেবল খুঁটিনাটি না খুঁজে বরং সেই সময়ের ক্ষুদ্র মানুষদের অবস্থা জানা উচিৎ। তাহলেই সত্যিকারের অতীতে দৃষ্টি নিবন্ধ করা যায়। আর সেকারণেই হয়তো লিও তলস্তয় তার উপন্যাস ( ? নাকি মহাকাব্য? নাকি ইতিহাসের বই? না সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু?) ওয়ার এন্ড পীস এ সেই সাধারণ মানুষের কথা, তাদের জীবন আর নেপোলিয়নের যুদ্ধ তাদের জীবনধারায় কেমন পরিবর্তন আনে, এই ঘটনাগুলোর মধ্যেই তৎকালীন রাশিয়ান সমাজের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ ই ধারণের চেষ্টা করেন , আর নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকতে এতবড় বৃহৎ ও বিস্তৃত উপন্যাসেও দুই রাজা নেপোলিয়ন ও জার আলেক্সান্ডার এর ব্যক্তিগত উপস্থিতি খুবই নগণ্য।

শুরুটা হয় ১৮০৫ এ। আন্না পাভলভনার এক অভিজাত পার্টিতে। নিজে সম্ভ্রান্ত পরিবারের হওয়ায় তলস্তয় বেছে নেন তার সবচেয়ে কাছের এই রাশিয়ান এরিস্ট্রোক্রেট শ্রেণিকেই গল্পের প্রধান চরিত্ররূপে। একে একে আমাদের অনেক অনেক চরিত্রের সাথে পরিচিত হতে হয়। তাই ১৫ পর্বে ও ২ পরিশিষ্টে বিভক্ত  ১৩০০ পৃষ্ঠার এই বই এর প্রথম পর্বে খুব বেগ পেতে হয় এত এত চরিত্রের সমাগমে। তবে এরপরের পর্ব থেকেই যেন চরিত্রগুলো অতিপরিচিত ও অতি আপন হয়ে উঠে। শুরু হয় যুদ্ধ।


২য় পর্ব মূলত সেই বর্ণনাই যেখানে রাশিয়া জড়িয়ে পরে ভিনদেশের মাটিতে আরেক ভিনদেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে। কি সেই উদ্দেশ্য? কিসের স্বার্থ এতে অন্তর্নিহিত? কিসের টানে মানুষ এভাবে অবলীলায় এত মানুষ হত্যা করতে পারে? দুইজন মানুষের এত ক্ষমতা যে তাদের দম্ভের জোরে লাখ লাখ মানুষ একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই? এই প্রশ্নই তলস্তয় করে গেছেন তার সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে অজানা পরিবেশে অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দেয় আর নীতিনির্ধারকেরা তাদের নিরাপদ স্থানে, গোলাবারুদের গন্ধ থেকে অনেক দূরে বেশ আয়েশেই দিন কাটায় আর নতুন যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। আর তাদের অদূরদর্শীতার এক ফল ভোগ করতে হয় রাশিয়া কে ১৮০৫ এ অস্ট্রিয়ায় “ব্যাটল অফ অস্টারলিজ” এ। নেপোলিয়নের অসাধারণ যুদ্ধ পরিকল্পনা আর রাশিয়ানদের দূরদর্শীতার অভাবে ভয়াবহ মার খেয়ে যায় রাশিয়া। সম্মুখীন হয় বিশাল ক্ষয়ক্ষতির। এরপর হিটলার-স্ট্যালিন এর মত  এক সাময়িক শান্তিচুক্তি করে নিজেদের আপাতত রক্ষা করে রাশিয়া যেই চুক্তি বহাল থাকে ১৮১২ পর্যন্ত। ১৮১২ তে নেপোলিয়ন বিভিন্ন ব্যাপারে ক্ষুদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন রাশিয়া আক্রমণের। 

একটা কৌতুক প্রচলিত আছে, Every fall of an empire starts from invading Russia .

বাংলাতেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখে গিয়েছিলেন‍: “রাশিয়ার আছে জেনারেল উইন্টার আর আমাদের আছে জেনারেল মনসুন(monsoon) ”। ‘৭১ পাকিস্তানি আর্মি যারা সর্বোচ্চ হাঁটুজল দেখে আসছে নিজেদের দেশে, তারা প্রথম ধাক্কা খায় এই বিশাল বিশাল নদী দেখে এবং ২য় ধরা খায় বর্ষার সিজনে। হিটলার সফলভাবে একের পর এক ইউরোপ এর দেশ জয় করতে থাকলেও তার প্রথম পরাজয়ই শুরু হয় রাশিয়ার শীতে। বাধ্য হয় পিছু হটতে। এই সব ঘটনার পূর্বসুরী হল এই নেপোলিয়নের রাশিয়া তে পরাজয়। শুরুটা হয় সীমান্তে প্রবেশ এর মাধ্যমে। ধীরে ধীরে শেভার্দিনো যুদ্ধ জয়, বরদিনোর যুদ্ধ, স্মোলেন্সক জয়, সর্বোপরী তৎকালীন এশিয়ার রাজধানী “মস্কো” জয়। কিন্তু নেপোলিয়ন মস্কো জয় করতে করতে ততদিনে মস্কো পরিত্যক্ত। তার সৈন্যরা ব্যস্ত লুট এ। সে সেইখানে তার বিপ্লবী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চাইলেও বা তথাকথিত মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও না সে সাড়া পায় রাশিয়ার জার (সম্রাট) এর কাছ থেকে, না রাশিয়ার সাধারণ লোকের থেকে, না নিজের সৈন্যদের থেকেও। তারা তখন পরিত্যক্ত মস্কোতে হরিলুট এ ব্যস্ত। ৫ সপ্তাহ অপেক্ষা করেও কোনো জবাব না পেয়ে ততদিনে যখন নিজেদের ভান্ডার ফুরোনোর পথে, তখন নেপোলিয়ন বুঝতে পারল, রাশিয়া ছেড়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প তার হাতে নেই।  রাশিয়ার মানুষ কোনো এক অদ্ভুত সূতায় ঐক্যবদ্ধ। তারা স্মোলেন্সক ছাড়ার আগে নিজেরাই নিজেদের গ্রাম জালিয়ে দেয়, তবুও বিদেশী দস্যুদের হাতে নিজেদের সমর্পন করতে রাজি নয়। এই দৃঢ় জাতিকে নেপোলিয়ন কীভাবে শাসন করবে? কিন্তু কোনো দীর্ঘ পরিকল্পনা ছাড়া রাশিয়ার এত ভিতরে এসে এখন পলায়ন কি এত সহজ? পিছু হটে তো রাশিয়ান বাহিনী নিজেদের আঘাত সারিয়ে ফেলেছে। এবার নেপোলিয়ন বাহিনী খেলো রাশিয়ানদের তাড়া। -৩৭ ডিগ্রি থেকে -৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় হয় তারা পথেই জমে মরে গেলো, নাহলে শত্রুর তাড়ায় মরলো। রাশিয়ান রা যেন চাবুক হাতে তাড়া করে গেল কিন্তু চাবুক দিয়ে সেই জন্তুকে মারলো না। কাজ এতেই হলো। নিজেদের সৈন্য বাঁচল সেই সাথে, ৬ লক্ষ সেনা নিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করা নেপোলিয়ন ফিরে গেলেন মাত্র ১ লক্ষ সৈন্য নিয়ে! 

কিন্তু যুদ্ধের কেনো এত ভয়াবহতা? পরস্পরের বিরুদ্ধে কেন এত অপরাধ, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, লুটতরাজ, নরহত্যা? কেবল নেপোলিয়ন আর আলেক্সান্ডার এর ইচ্ছায়? নেপোলিয়ন বা আলেক্সান্ডার ও বরোদিনোর যুদ্ধে একজন মানুষ হত্যা করেন নি। এমনকি মস্কো জয়ের পর নেপোলিয়ন অনেক চেষ্টা করেন নমনীয় হতে তার অধিবাসীদের প্রতি।  তাহলে কি কারণ থাকতে পারে যার কারো লক্ষ লক্ষ মানুষ একে অপরকে হত্যা করে? নির্যাতন করে? বা নেপোলিয়নের পক্ষেও কি সম্ভব ছিল, হত্যা বা লুট না করতে বাধ্য করার? তা করতে চাইলে হয়তো নেপোলিয়নকেও একই পরিণতি বরণ করতে হতো। যুদ্ধ মূলত, ক্ষতি, হতাশা, ধ্বংস, লাশ আর কান্না ছাড়া কিছুই বয়ে আনে না।  বই এর বিভিন্ন বর্ণনাতেই এগুলো প্রমাণ করতে চেয়েছেন লেখক তলস্তয়।

এবার একটু পিস (শান্তি) পার্ট এ আসা যাক। কেন্দ্রীয় চরিত্র অনেক থাকলেও মূলত ৩-৪ জন কে আলাদা করা যায়। পিয়ের, একজন আনাড়ি তরুন, যিনি প্রথমে নাস্তিক ও আজ্ঞেয়বাদী থাকলেও ঘটনাক্রমে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস খুঁজে পান এবং বিভিন্ন পালাবদলে জীবনের নতুন মানে দেখতে পান। প্রিন্স আন্দ্রু শুরু থেকেই চমকপ্রদ ও দৃঢ়ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্র হলেও যুদ্ধের নানা দৃশ্য তাকে জীবনকে নানা ভাবে ভাবতে শেখায়। নাতাশা হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল মেয়ে। একটা বড়সড় ভুল (বা অপরাধ) করলেও বঙ্কিম এর মত তলস্তয় তাকে মৃত্যুর মত শাস্তি দেন নি বরং Redemption এর সুযোগ দিয়ে উন্নত মানসিকতার এক পরিচয় দেন। এই তিন চরিত্রের তিন প্রধান পরিবার নিয়েই গল্পের এই “শান্তি” অধ্যায় আগায় যেখানেও আসলে অশান্তি বিদ্যমান। প্রতিক্ষেত্রে তলস্তয় জীবনের মানে খুঁজতে চেয়েছেন। বেঁচে থাকার অণুপ্রেরণা দিয়েছেন। এমনকি মৃত্যু ও যে নতুন করে ভালোবাসতে শেখায় সেই কথা বলেছেন। যতক্ষণ শ্বাস আছে বাঁচার মত বাঁচতে বলেছেন। “All unhappiness arises not from privition but from superfluity”   অপ্রাপ্তি নয় বরং অধিক প্রাপ্তিই যেন জীবনে অশান্তির মূল কারণ, এটা ছিল তলস্তয় এর বক্তব্য । এই পার্ট গুলোতেও তলস্তয় প্রেম, ভালোবাসা, পরিবার, মৃত্যু, দূর্ভোগ, মুক্তির এক সুন্দর গল্প তুলে ধরেছেন।  যুদ্ধ কীভাবে তাদের প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রভাব ফেলে সেটার ও নিখুঁত চিত্রাঙ্কন আমরা দেখতে পাই। আরও একটি দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, তলস্তয় এর এই বই এ কোনো চরিত্রই ফেরেশতা বা শয়তান না। বরং সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের মত দোষগুণ মিলিয়েই একেকজন বাস্তবসম্মত মুখ।

বই এর অনেকগুলো অধ্যায় এ কেবল ই তলস্তয় নিজের দর্শনতত্ত্ব নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করেছেন। কেনো আসলে এত ভয়াবহতারপর ও এই যুদ্ধ? নেপোলিয়নের এতই ক্ষমতা? এই ক্ষমতার উৎস কি? তার জেনারেল রা কি মানুষ হত্যায় অস্বীকৃতি জানাতে পারতো না? এতজন মানুষের উপর ও একজনের ক্ষমতা এত সুপেরিয়র? তলস্তয় জীবনবোধ, এবং ইশ্বরবিশ্বাস খুঁজতে চেয়েছেন। এবং শেষমেষ সেই প্রাচীন প্রশ্নের ই জবাব খুঁজতে চেয়েছেন যে মানুষের আদৌ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি (Freewill) বলে কিছু আছে নাকি সবই পূর্ব-নির্ধারিত? (pre determined) . এক্ষেত্রে তলস্তয় মূলত এই ব্যখ্যাই দিয়েছিলেন যে একটা গাড়ি যখন চলে তখন কেবল ইঞ্জিন, কেবল ড্রাইভার, কেবল জ্বালানি, বা কেবল রাস্তা অথবা কেবল চাকা, এমনকি কেবল অন্য গাড়ির গতি ও তাকে চালায় না, বরং এটি সবধরণের ঘটনার এক সামগ্রিক ফলাফল। তেমনটাই এই নেপোলিয়নের যুদ্ধ কেও কারো একার উপর দায় দেওয়া যায় না।

এই উপন্যাস (বা মহাকাব্য) কে Greatest novel of all time  বলা হয়। এটা যে একদম সর্বকালের সেরা লিখা এই শর্তেই গ্রেট ব্যাপার টা তেমন নয়। বা পৃষ্ঠা সংখ্যাও যে সবচেয়ে বড় এমন ও নয়। বরং এটির বৃহৎ কারণ এটি একটি দশকের একদম সম্পূর্ণটাই ধারণ করে। প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি পরিবর্তন, প্রতিটি চিন্তাধারা। আর তাই তো এত বছর পরে এসেও মানুষ এই উপন্যাসকে স্বীকৃতি দিতে ভুল করে না। 

1304 আদনান করিম চৌধুরী new writer
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশন : ২০১৯ - ২০২০