জনাব শামীম সাহেব ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই কিন্তু চালচলন এমন যে মনে হয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের টগবগে তরুণ গবেষক। অবশ্য তিনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর সিনিয়র গবেষক, অথচ প্রেম ও রোম্যান্স সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য। এ কারণে হয়তো এখনো বিয়ের পীড়িতেও বসেন নি তিনি। প্রায়ই তার সহকর্মীরা বলেন, “স্যার শুধু সংখ্যার প্রেম বোঝেন, মানুষের প্রেম বোঝেন না!”
কিন্তু কপালের লিখন তো কেউ খণ্ডাতে পারে না। একদিন অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে এক দুর্ঘটনা ঘটলো। স্বভাবগতভাবেই কিছু গবেষণা ও নতুন কিছু ফাইন্ডিংস এর খোঁজে শামীম সাহেব ইচ্ছে করেই আজ লোকাল বাসে উঠে পড়লেন। সিট না পাওয়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ হিসেব কষছিলেন, ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে কতগুলো বাস দুর্ঘটনা ঘটে, তার কত শতাংশ বেঁচে যায়, গড়ে কতজন যাত্রী আহত হয়, মারা যায় ইত্যাদি। এমন সময় বাসের ড্রাইভার হঠাৎ ব্রেক কষলো, আর তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সামনে দাঁড়ানো এক তরুণীর ওপর।
তরুণী বিরক্ত হয়ে বললেন, “এক্সকিউজ মি, একটু সাবধানে দাঁড়াতে পারেন না?”
শামীম সাহেব ইতস্ততঃবোধ করলেন এবং ঘাবড়ে গেলেন। “আমি দুঃখিত, আসলে আমি একটু… মানে…”
“আপনি হাতের আঙ্গুলে কি গুণতেছিলেন? আপনি কি অঙ্ক কষছিলেন?” মেয়েটি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।
শামীম সাহেব হতবাক। “আপনি কী করে জানলেন?”
“আপনার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, আপনি সংখ্যার প্রেমিক, শুধু সংখ্যার প্রেমেই পড়তে জানেন, মানুষের প্রেমে পড়তে জানেন না!”
এই বলে মেয়েটি হাসতে লাগল।
শামীম সাহেব বাস থেকে নেমে মেয়েটির কথা ভাবতে লাগলো। মেয়েটি পরিসংখ্যানের কোন থিউরি কাজে লাগিয়ে তার মনের কথা বুঝে গেলো সেটা নিয়ে মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন তিনি। তার তো সব থিউরি সম্পর্কে জানা আছে। মার্কভ থিউরি, বেইজ থিউরি, মন্টেকার্লো, টেইলর, ই এম, এম এইচ এলগোরিদম এবং জিবস সব কিছুই এক মূহুর্তে চিন্তা করে নিলেন। নাহ, কোনোটা দিয়েই তো এইটা চিন্তা করা যায় না। তাহলে কি মাহালানোবিশ ডিসট্যান্স দিয়ে আমার মনের দূরত্ব বুঝে গেলো মেয়েটা! এসব ভাবতে ভাবতে তিনি বাসায় পৌঁছে গেলেন।
পরদিন আবার মেয়েটার সাথে দেখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো মেয়েটি। কাছে এসে সালাম দিলো, আমাকে চিনতে পেরেছেন? গতকাল বাসে… বলতেই শামীম সাহেব চিনে ফেললেন। মেয়েটি নিজের পরিচয় দিল, তার নাম তামান্না। সে একটি মার্কেট রিসার্চ ফার্মে কাজ করে। এখানেই মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট থেকে পড়াশুনা করেছে।
শামীম সাহেব কোনো এক অজানা কারণে তামান্নাকে চা খাওয়ার দাওয়াত করাতে তামান্না রাজি হয়ে গেলো।
চায়ের কাপ হাতে দুজনে বসে আছেন। গল্পে গল্পে দুজনের মাঝে সখ্যতা গড়ে উঠলো। এমন সময় তামান্না মুচকি হেসে বলল, “আপনার মতো মানুষদের জন্য আমাদের বিশেষ গবেষণা আছে, পারসোনালি আমি নিজেই করতে চাই। কীভাবে সংখ্যার প্রেমিককেও মানুষের প্রেমে পড়ানো যায়!”
শামীম সাহেব কাশি দিয়ে বললেন, ” কি বলো? এটা কি সত্যিই সম্ভব?”
“অবশ্যই! প্রথমত, আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে প্রেমের সব কিছু পরিসংখ্যান এর সব থিউরি দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়।”
এভাবেই শুরু হলো শামীম সাহেবের জীবনের নতুন অধ্যায়। প্রথমে তিনি প্রেমকে গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করতে চাইলেন। তিনি প্রেমের সাফল্যের হার, ব্রেকআপের সম্ভাবনা, ভালোবাসার স্থায়িত্বের গড় এবং প্রেম থেকে বিয়েতে রূপান্তর(ট্রান্সফর্ম) এসব হিসাব বের করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি গবেষণা করে একটা সিদ্ধান্তই পেলেন, “প্রেম আসলে কোনো সংখ্যা নয়, এটা অনুভূতির ব্যাপার!”
একদিন তামান্না বললো, “স্যার, আপনি কি জানেন, ভালোবাসার একটা সাধারণ সূত্র আছে?”
“কি সেটা?”
“যে ভালোবাসে, সে হিসাব কষে না!”
এই কথা শুনে শামীম সাহেব প্রথমবারের মতো তার গবেষণার পেপারগুলো বন্ধ করলেন। এক গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন, “তাহলে কি পরিসংখ্যানকে কিছুদিনের জন্য ছুটি দেওয়া যায়?”
তামান্না হাসলো, আর সে হাসিতে ছিল এক পরিসংখ্যানহীন খাঁটি ভালোবাসার ছোঁয়া।
- মো: আসাদুজ্জামান সোহানhttps://www.thepapyrus.org/author/%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%86%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%a6%e0%a7%81%e0%a6%9c%e0%a7%8d%e0%a6%9c%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8-%e0%a6%b8%e0%a7%8b%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a8/রবিবার, জানুয়ারি ১৯, ২০২৫