মে ১৩, ২০২৫

মুখোশ

পরিসংখ্যান বিভাগের সাহিত্য পত্রিকা প্যাপাইরাস নিয়ে লিখতে বলা হল। তাই লিখলাম। না হলে পোলাপান জোর করে ট্রিট চাইবে লেখা না দেয়ার জন্য।

প্যাপাইরাস পত্রিকার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ হওয়ার কারণে আমার হাতে এক বান্ডেল প্যাপাইরাস পত্রিকা ধরিয়ে দেয়া হয়। মূল্য ১০ টাকা। বলা হয় বিক্রি করে ফেলতে হবে। সিআর হলে কি কি করতে হবে তার কিছুই বুঝি না, তার মাঝে আবার পত্রিকা বিক্রি। (বিভাগের কোন এক বড় ভাই ধরায় দিছিলো, এখন মনে নাই, তারে না করার সাহসও পাই নাই)

সপ্তাহ শেষে আমি মনে হয় দুইটা কি তিনটা বিক্রি করতে পেরেছিলাম। এমনিতেই ক্লাসের কিচ্ছু বুঝি না; ব্রেকের মাঝে সুবীরদার ক্যান্টিনের সিঙ্গারা খেতে খেতে চিন্তা করতাম কিভাবে কি করা যায়। সিঙ্গারা শেষ হয়ে যেত, আমার বান্ডেল শেষ হয় না। হবে কিভাবে, পোলাপান প্যাপাইরাস কি বোঝার আগেই নোট নিতে নিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে সাহিত্যের সময় কোথায়, যার মূল্য আবার ১০ টাকা (২০০৩ এর ঘটনা, তখন ১০ টাকায় দুই জনের চা-সিঙ্গারা-সমুচা-চপ হয়ে যেত) ।

পত্রিকা কেনার জন্য সবাইকেই কম বেশি বলে ফেলেছিলাম, কিন্তু সর্বসাকুল্যে মনে হয় দশটার মত বিক্রি করতে পেরেছিলাম। সেটা নিয়ে মন মেজাজ দুইটাই খারাপ; মন খারাপ বিক্রি করতে পারলাম না, মেজাজ খারাপ পোলাপান বুঝে নাই এটার মর্ম! এরপরে প্যাপাইরাস ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এরপরে প্যাপাইরাস আর প্রকাশিত হয় নি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় প্যাপাইরাস নিয়ে আর কোনো কথাও শুনিনি।

এর মাঝে ২০১৫ সালে দুটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে আমার জানা হয়নি। ফার্স্ট ফরওয়ার্ড টু ২০১৯। একদিন সকাল বেলা রোকন ভাই (ব্যাচ ৪৯) আমাকে ফোন দিয়ে বললেন যে জাফর স্যারের সাথে তার কথা হয়েছে, উনি একটা ওয়েবসাইট বানাতে চান, ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন স্টুডেন্ট প্যাপাইরাস পত্রিকাটা আবার নতুন করে শুরু করতে চাচ্ছে, কিন্তু এবার অনলাইন ভিত্তিক হবে। তাই উনি স্যারকে আমার নাম বলেছেন। আমি বললাম আচ্ছা ভাইয়া, আমি আছি। খালি আওয়াজ দিয়েন হাজির হয়ে যাব। উনি বললেন একটা মিটিং করবেন সামনেই, সেখানে আমি যেন উপস্থিত থাকি।

WhatsApp Image 2025 04 18 at 01.35.47 456dbbe4
প্যাপাইরাসের প্রথম মিটিং শেষে ছবি

২৬ জানুয়ারি, ২০১৯। নতুন প্যাপাইরাসের জন্য মিটিং ডাকা হল। ডিপার্টমেন্টের প্রথম যেই ক্লাসরুমে ক্লাস শুরু করেছিলাম, সেখানে। মিটিং এ অনেককেই দেখলাম। তখন দেখা হল সাকিব ইবনে সালাম, আসিফ আব্দুল্লাহ, স্মৃতি তাইয়্যেবা মুক্তার সাথে। তো মিটিং হলো (ইটিংও হয়েছিল)। প্যাপাইরাসের আগের সংখ্যা যেগুলি আনাচে কানাচে ধুলায় ধূসরিত হচ্ছিল, সেইগুলি বের করে বিতরণ করে দেয়া হল। ঠিক হল একটা ডেমো বানানো হবে, তারপরে সেটার উপর ভিত্তি করে মতামত নিয়ে পরবর্তী কার্যকলাপ ঠিক করা হবে। সেদিনের মত মিটিং শেষ করে কাজ শুরু করলাম। টিম হিসাবে ভাগ করে দেয়া হলো কার কি কাজ এবং সবার মাঝে সেতু হিসাবে কাজ করবে সাকিব।

সাকিব এরপরে শুরু করলো এক এক করে কাজ ভাগ করা, জুনিয়রদেরকে দেওয়া হলো পুরাতন পত্রিকার টাইপিং এর কাজ, আর আমার সাথে ও কাজ শুরু করলো ওয়েবসাইট নিয়ে। আমরা বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা দেখে দেখে ডিজাইন ঠিক করলাম কয়েকটা। সেটা নিয়ে একটা ডেমো ওয়েবসাইট নিয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। কয়েকদিন পরে ডিপার্টমেন্ট গেলাম প্রেজেন্টেশন দিতে। কিসের প্রেজেন্টেশন, মনে হচ্ছিল ভাইভা দিতে যাচ্ছি। জাফর স্যার, সাথে বাকি সবাই ছাড়াও আরো কয়েকজন এর সামনে কম্পিউটার ল্যাবে প্রজেক্টরে ডেমো দেখালাম। আর বললাম কি কি করা যাবে তার প্ল্যানিং। এরপরে সবার থেকে এক এক করে মতামত নিলাম; সেসব নিয়ে আলোচনাও করা হল।

এর মাঝে আমরা অনেক কিছু নিয়ে কাজ করলাম; সবথেকে বড় সমস্যায় পরলাম বাংলা নিয়ে। তখন যদিও অভ্র অনেক প্রচলিত, কিন্তু সবাই যেন সেটাই ব্যবহার করে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য পত্রিকার নিয়মাবলী ঠিক করা হল। সেই সাথে নতুন পত্রিকায় যেন নতুন লেখা থাকে সেইজন্য  আশেপাশে সবার কাছে লেখা চাওয়া হলো। সেসব লেখা নিয়ে সাকিব, স্যার আর রোকন ভাই এডিটর হিসাবে কাজ করতে থাকলেন।

আমরা ঠিক করেছিলাম পহেলা বৈশাখে পত্রিকার প্রকাশ করা হবে। ২১ ফেব্রুয়ারী প্রথম ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তখন শেষ করে উঠা সম্ভব হয়নি। তাই এই নতুন তারিখ ঠিক করে নেয়া হয়েছিল। সাকিবের সাথে নিয়মিত বসা হতো ও লেখালেখির কাজ করত আর আমি ওয়েবসাইটের। এমন দিন গিয়েছে রাত ১১টা পর্যন্ত আমরা দুইজন কাজ করেছি। ওর কাজ ঠিক আগায়, কিন্তু আমি একটু আগাই, আবার শুরু থেকে করি অথবা কোন কারণে নতুন করে শুরু করতে হয়। এর মাঝে লোগো ঠিক করে ফেলা হলো। লোগোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে আইডিয়া চাওয়া হয়েছিল।

সবকিছুই হচ্ছিল, কিন্তু ওয়েবসাইট আর ঠিক হচ্ছিল না। প্রকাশনার ৪ দিন আগেও একটা ঝামেলার কারণে সম্পূর্ণ ওয়েবসাইট নতুন করে করতে হয়েছিল। তখন আমার মাথা পুরা নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত। সাকিব ছিল পাশেই, বলে “বড় বাই, মাতা তান্ডা কর, তানাই কেচ করো”। না সে এটা বলে নাই, ওর চেহারাতেও দুর্দশার ছাপ। তখন বললাম, শেষ করেই যেতে হবে। পরের দিন আবার নতুন করে শুরু করলাম, সাকিব সকাল থেকেই আমার সাথে, কোন সাহায্য লাগবে কিনা, সেইসাথে আগের সব সংখ্যা স্ক্যান করে ফেলা হয়েছে, সেগুলি পিডিএফ করে রেডি ওয়েবসাইটে আপলোড করার জন্য। কিন্তু ওয়েবসাইট রেডি না।

কাজ শুরু করলাম আবার, একটার পরে একটা ধাপ পার হচ্ছি আর চেক করে দেখছি সব ঠিক আছে কিনা। সবশেষে যখন ওয়েবসাইট ঠিক করে ফেলা হল, তখন সাকিব আর নিজের আনন্দ ধরে রাখতে পারে নাই। ছবি দেখলে বুঝবেন।

যেহেতু ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, তাই আমরা ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে ৪০১ নং রুমে সবাই বসলাম, স্যাররা সবাই এসেছেন, রুমে সবাই এসেছে, শেষে পেছনের দিকে সবাই দাঁড়িয়ে ছিল। সবার চোখে মুখে উত্তেজনা, সাকিবের চেহারা ছিল দেখার মত, একসাথে আনন্দ আর উৎকণ্ঠা। অনুষ্ঠান নিয়ে আর লেখার কিছু নাই, সেটা পড়তে এখানে ক্লিক করতে পারেন।

লিঙ্ক – নতুন আঙ্গিকে প্যাপাইরাসের যাত্রা

সেই শুরু প্যাপাইরাসের অনলাইন যাত্রা, এর মাঝে নানারকম চড়াই উৎরাই পার হয়ে আজকে ৬ বছর ধরে অনলাইনে প্রতি মাসে নিয়মিত প্রকাশ হয়ে আসছে। আমি নিজেও ধন্য আজকে প্যাপাইরাসের এই দীর্ঘ পথ চলায় সঙ্গী হতে পেরে। প্যাপাইরাসের কল্যাণেই অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে, আরো হবে আশা করি। কিন্তু শুরুর সেই সুযোগটা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, নতুন করে ভাবিয়েছে, সেই জন্য আমি প্যাপাইরাসের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। প্যাপাইরাসের অনলাইনে আসার আগের কাহিনী জানতে রোকন ভাইয়ের – পুনশ্চ লেখাটিতে ক্লিক করে জেনে নিতে পারেন।

একটা মানুষের অনেকগুলি মুখোশ থাকে, তার মাঝে প্যাপাইরাস হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক মুখোশ উন্মোচনের প্ল্যাটফর্ম। একটা মুখোশ তো বের হল?

IMG 9612
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা | 

সেশন : ২০০২ - ২০০৩