জুলাই ১০, ২০২৫

উপসম্পাদকীয় – জুন ২০২৫

লাগামহীন হওয়া যায় দু’ভাবে: লাগাম ছিঁড়ে গেলে অথবা লাগাম খুলে গেলে (দিলে)। তবে সেজন্য প্রথমত ‘লাগাম’ থাকা চাই। কিন্তু কখনও যদি সেই লাগামই না থাকে, তাহলেও সেটাকে লাগামহীনতার আরেক রূপ বলে অস্বীকার করার উপায় নেই। কুরবানির ঈদের সময় ঢাকার অলিগলিতে একটি দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে; বিশাল হাতিস্বরূপ গরু জবাইয়ের মুহূর্তে হঠাৎ দড়ি খুলে উদ্দেশ্যহীন দৌড়ে বেড়ায়, পেছনে একঝাঁক মানুষ, কেউ দড়ি ধরে টানছে, কেউ স্প্রিন্টারদের মতো ছুটছে। অনেকের আহত হবার ঘটনাও বিরল নয়। বছরের অন্য সময়ে এমন দৃশ্য সাধারণত দেখা যায় না, শুধু কখনও-সখনও পাবলিক বাস ধরার জন্য ব্যস্ত মানুষের ছোটাছুটি তার কাছাকাছি হয়।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেকটা এই দৃশ্যের সঙ্গেই মিলে যায়। বহু বছর ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রে কার্যকর কোনো লাগাম বা চেক-এন্ড-ব্যালান্সের (checks and balances) ব্যবস্থা ছিল না, কিংবা থাকলেও তা ছিল কাগজে-কলমে। বাস্তবে কোনো নিয়ন্ত্রণ কাজ করেনি বা তা কার্যকর করতে যে নিয়মনীতির সংস্কার দরকার, তার অনুপস্থিতি প্রকট। ঠিক এক বছর আগের ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী জুলাই আন্দোলন যেন সে সংস্কারের সম্ভাবনাই নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সংস্কারের জন্য যে ‘দড়ি’- দায়িত্ব, স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা তা এখনও যেন মজবুত হয়নি।

আমরা যেন বুঝতেই পারছি না আদতে সংস্কার জিনিসটা কী, কিংবা সেটা কীভাবে বাস্তবায়িত হয়। ফলে দেশটা দৌড়াচ্ছে একটা বাঁধনহারা উদ্দেশ্যহীন কুরবানির গরুর মতো; রাজনীতিবিদেরা পেছন পেছন ছুটছেন, কোনোভাবে ধরে ফেলতে পারলেই মনে হচ্ছে আপাতত দায়িত্ব শেষ, তারপর কী হবে তা নিয়ে ভাবনা কম। অথচ প্রয়োজন ছিল নিষ্ঠা, সততা ও সুপরিকল্পিত কর্মপন্থা- যা আমাদের রাজনীতিতে বিরল।

এমন পরিস্থিতিতে সংস্কার যে কতটা জরুরি, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা আজ সবচেয়ে বড় সংস্কারের দাবি। যেখানে যারা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হবে, তারা ভোটের মাধ্যমেই বিদায় নেবে। সেটা জাতীয় থেকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত। এতে রাজনীতিতে সৃষ্টি হবে গঠনমূলক প্রতিযোগিতা- কে কেমনভাবে দেশের জন্য ভালো কাজ করতে পারে, সে প্রতিযোগিতা।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, সংস্কারের কালক্ষেপণ। এটা যতো দেরিতে হবে, সমস্যার গভীরতাও তত বাড়বে। কারণ, গরু আর মানুষ দুই পক্ষই যদি অনেকক্ষণ ধরে দৌড়াতে থাকে, তবে দু’পক্ষই ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে। গরু হয়তো ধরা হয় কিন্তু উদ্দিষ্ট কার্যসম্পাদন সফল হয় না। তখন আর বাঁধনহারা দৌড়ের কোনো ইতিবাচক ফল থাকে না বরং চারদিকে হতাশা ও বিভীষিকার পরিবেশ তৈরি হয়।

এই সংস্কারের স্বপ্ন দ্রুত পূরণ হোক- এটাই জাতির প্রত্যাশা। সবাইকে কুরবানির ঈদের শুভেচ্ছা!

Facebook
Threads
LinkedIn
Telegram
X
Reddit
Email
WhatsApp