fbpx

শহীদ সামাদঃ পরিসংখ্যান পরিবারের গর্ব

শহীদ সামাদ, বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা,তাদের মধ্যে শহীদ সামাদ অন্যতম। অথচ পরিসংখ্যান বিভাগের একজন ছাত্র না হলে হয়তো বা তাঁর পরিচয়-কর্ম জানা হতো না।

বীরউত্তম শহীদ সামাদের নাম শোনার পর যখন তাঁকে নিয়ে জানবার চেষ্টা করি সেসময় তার আদ্যোপান্ত জেনে তাঁর প্রতি ভালবাসা অনেকাংশে বেড়ে গেল, তাঁকে যেন আপনজন হিসেবে ভাবতে শুরু করলাম। কেননা তিনি যে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিভাগে পড়াশুনা করেছেন আমিও অনুরূপ প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এমনকি তিনি মুক্তিযুদ্ধে যে এলাকা শত্রমুক্ত করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, আমি সে এলাকারই সন্তান। আর তাই তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর পরিচয় তুলে ধরা আমার নৈতিক দায়িত্বের মাঝেই পড়ে।

শহীদ সামাদের পুরো নাম আবু মইন আশফাকুস সামাদ। ডাকনামের তালিকা ঢের ভারি। মূলত ছিল নিশরাত, তবে বাসায় সবাই ডাকতো তানি নামে। আবার কাছের বন্ধুদের কাছে সেই নিশরাতই পরিচিত ছিল আশফি নামে।

১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। তবে পৈত্রিক নিবাস কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার সতেরো দরিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা আজিজুস সামাদ ছিলেন সরকারের আবগারী বিভাগের কর্মকর্তা এবং মাতা সাদেকা সামাদ ছিলেন অনরারি ম্যাজিস্ট্রেট। আশফাকুস সামাদ ঢাকার সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন।

আবু মঈন আশফাকুস সামাদ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন এবং ২৯ মার্চ কয়েকজন বন্ধুর সাথে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কিশোরগঞ্জ যান। সেখানে অবস্থানরত ২ ইস্টবেঙ্গল ও ৪ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সহযোগিতায় অস্ত্র সংগ্রহ করে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। পরে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ভারতে যান। প্রথমে তিনি আগরতলায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ২নং সেক্টরের সালদানদী সাব-সেক্টরের অধীনে কয়েকটি রেইড ও অ্যাম্বুশে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের অফিসার নির্বাচিত হন। তিনি ৯ অক্টোবর কমিশন লাভ করেন এবং ৬নং সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের একটি কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব পান। কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে তিনি জয়মনিরহাট, ভুরুঙ্গামারী, রায়গঞ্জ যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ভুরুঙ্গামারী এবং আশেপাশের এলাকা শত্রুমুক্ত করে মুক্তাঞ্চল গঠন করেন।

মুক্তিযোদ্ধারা ২০ নভেম্বর রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ আক্রমণ করেন। কিন্তু শত্রুর প্রতি-আক্রমণে বিপর্যস্ত কোম্পানির সৈনিকদের নিরাপদ অবস্থানে সরে যাবার জন্য আশফাকুস সামাদ নিজে মেশিনগান চালনা করতে থাকেন। তাঁর সৈনিকরা কাভারিং ফায়ারের সাহায্যে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ সময়ে তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদত বরণ করেন।

সেদিন ছিল ঈদের দিন। আগের রাতেই সকালের নাস্তা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মৃতদেহ উদ্ধারের সময় তার পকেটে পাওয়া যায় দুটো পুরি এবং এক টুকরা হালুয়া। ঈদের দিনের সকালের নাস্তা ছিল সেগুলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান খুব কাছাকাছি থাকায় ওইদিন তার মৃতদেহ উদ্ধার করা যায় নি। পরদিন তার মৃতদেহ উদ্ধার করে জয়মনিরহাট মসজিদের সামনে যথাযোগ্য মর্যাদায় একই যুদ্ধে শহীদ সহযোদ্ধা সহোদর আলী হোসেন, আবুল হোসেন এবং আব্দুল আজিজকে সমাহিত করা হয়। সৌভাগ্যবশত, তাঁর কবর জিয়ারতের সুযোগ হয়েছে আমার। পরবর্তী সময়ে ভূরুঙ্গামারীর জয়মনিরহাট ইউনিয়নের নাম রাখা হয় সামাদনগর।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ আশফাকুস সামাদকে ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বসূচক নম্বর ২৮। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দৈনিক বাংলা মোড় থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত মতিঝিলের প্রধান সড়কের নামকরণ করেছে বীরউত্তম আশফাকুস সামাদ সড়ক। তাঁর আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর স্মরণে রংপুর সেনানিবাসে ‘বীর উত্তম শহীদ সামাদ উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। স্রেফ এটুকুই! এরপর গত ৪৮ বছরেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর নামে হয়নি কোন আয়োজন। তাঁকে স্মরণ করবার ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিসংখ্যান বিভাগ এ মহান আত্নত্যাগী ব্যক্তিকে ভুলে যায় নি। তাঁর সম্মানে বিভাগ থেকে প্রতি বছর “সামাদ স্মৃতি টুর্নামেন্ট” আয়োজন করার পাশাপাশি তাঁর মহৎ জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।

শহীদ সামাদের মত দেশপ্রেমিকদের কর্মজীবন বাঙ্গালি জাতির জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম এই মার্তৃভূমিকে সকল ধরনের অন্যায় নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা করে এগিয়ে নিবে উন্নতির শীর্ষে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র, দশম খণ্ড
২. তথ্যসূত্র: ফতেহ আলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকার http://egiye-cholo.com/fateh-khaled-hayder/
৩. "২৩ গণকবর ও বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে"( সমকাল)। 
৪. উইকিপিডিয়া।

শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ

ব্যাচ: ৬৭
সেশন: ২০১৭-১৮
পরিসংখ্যান বিভাগ

আসিফ আব্দুল্লাহ

ব্যাচ: ৬৭ সেশন: ২০১৭-১৮ পরিসংখ্যান বিভাগ

মন্তব্য করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.