fbpx

অক্টোবর ২১, ২০২৪

আম্রকানন

রাজশাহী অঞ্চলের একজন লোক আম, আমগাছ, আমবাগান এসব নিয়ে লিখবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই নিশ্চয়? লেখাটির নাম আম বা আমবাগান দিলেও কোনো ক্ষতি ছিল না বৈকি। সাহিত্যের ভাষা মানুষের মুখের ভাষা হলে তাতে ক্ষতি কিছু নেই নিশ্চয়। সেটা মানুষ বেশ আগেই ধরতে পেরেছে। তবুও বেশ একটা অন্য ধরণের, স্বল্প ব্যবহৃত একটি শব্দ প্রয়োগে কেমন একটা প্রশান্তি আসে মনে। আমের কিন্তু আরেকটা নামও রয়েছে- চূত। কিন্তু এই নামে লেখার সাহস পেলুম না। প্রথমে ভাবলুম, আমের নাম দিয়ে শুরু করব। ওমা, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি ৩৫ প্রজাতির প্রায় ৩৫১ টি আমের উল্লেখ আছে এক উইকিপিডিয়াতেই! তাই সেই আশায় গুড়ে বালি।

আম পছন্দ করেন না এমন বাঙালি বোধহয় মেলা ভার। অবশ্য জোর দিয়ে কিছু বলাও যায় না এই ধরিত্রীতে। শেক্সপিয়রের ভাষায়, “There are more things in heaven and earth.” তবে আম যে স্বাদে অতুলনীয় সেকথা আমি একা বলছিনে; আমার বিশ্বাস, এটি সংখ্যাগরিষ্ঠেরই মত। শুনলাম, ১৯৮৩ সালে গাজীপুরের বৈরাগিরচালায় আম খেয়ে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ প্রশংসা করেছিলেন বিস্তর। হিউয়েন সাং, আলেকজেন্ডার- কাকে মুগ্ধ করেনি এই আম! সম্রাট আকবরের তো এটি এতটাই ভালো লেগেছিল যে তিনি রীতিমতো এক লক্ষ আম গাছ লাগিয়ে একটি আমবাগান তৈরি করেছিলেন ভারতের শাহবাগের দাঁড়ভাঙ্গায়।

আম, আমগাছ, আমবাগান এসব নিয়ে গান, গল্প, কবিতারও শেষ নেই। পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের,

“ঝড়ের দিনে মামার দেশে
আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের শাখায় উঠে
রঙিন করি মুখ।”

এই ছড়াটি কখনও মুখে আনে নি এরকম কেউ কি আছে এ দেশে?

সকলের কথা বাদ দিলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের কথা বাদ দিই কী করে বলুন তো? গুরুদেব কী লিখেছেন একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক, আসুন-

“ঝড় এলো এলো ঝড়
আম পড় আম পড়
কাঁচা আম ডাঁসা আম
টক টক মিষ্টি
এই যা…
এলো বুঝি বৃষ্টি।”

আবার কাঁচা আম নিয়ে তিনি লিখছেন এভাবে-

“তিনটে কাঁচা আম পড়ে ছিল গাছতলায়
                       চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্‌দুরে।
               যখন-দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়
                           হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে।
                   তখন চা খেতে খেতে মনে ভাবলুম,
                          বদল হয়েছে পালের হাওয়া
                   পুব দিকের খেয়ার ঘাট ঝাপসা হয়ে এলে।
           সেদিন গেছে যেদিন দৈবে-পাওয়া দুটি-একটি কাঁচা আম
                           ছিল আমার সোনার চাবি,
                       খুলে দিত সমস্ত দিনের খুশির গোপন কুঠুরি;
                          আজ সে তালা নেই, চাবিও লাগে না।”

আবার শেষের কবিতায় উনি লিখছেন-

“ফজলি আম ফুরোলে বলব না, আনো ফজলিতর আম; বলব, নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে। ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি, সে শাঁসের মেয়াদ।”

কাজী নজরুল ইসলামের লেখায় আমরা আমের উল্লেখ পাই এভাবে-

“বন্ধু আজও মনে যে পড়ে আম-কুড়ানো খেলা।
আম কুড়াইবারে যাইতাম দুইজন নিশি ভোরের বেলা।
জোষ্ঠিমাসের গুমোট রে বন্ধু আসত নাকো নিঁদ,
রাত্রে আসত নাকো নিঁদ,
আম-তলার এক চোর আইস্যা কাটত প্রাণের সিঁদ;
(আর) নিদ্রা গেলে ফেলত সে চোর আঙিনাতে ঢেলা।”

আবার আরেক যায়গায় তিনি লিখছেন,

“আগের মতো আমের ডালে
বোল ধরেছে বউ।
তুমিই শুধু বদলে গেছ
আগের মানুষ নও।”

এই যা! আমারও তো একটা কবিতায় আমি আমের উল্লেখ করেছি। সেটি এখানে উল্লেখ না করতে পারলে তো পেটের আম হজম হবে না। শুনুন তাহলে,

“বধূ ছোটে খলা পানে                 ধান খড় তুলে আনে

গরুসব বাটীপানে ধায়।

আম পড়ে ধড়ধড়         ভাঙে ডাল কড়মড়

বাহির যে হয়া হলো দায়।”

এতক্ষণে তাহলে এটুকু মোটামুটি স্পষ্ট যে, আম বাঙালির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আর আম জড়িত মানে আম গাছ জড়িত। আম গাছ জড়িত মানে আমবাগান জড়িত। খুবই সোজাসাপ্টা হিসেব।

        কিন্তু আম্রকানন তথা আমবাগানের এক আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে বাঙালির জীবনে। দু’টি খুব- খুব খুব আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম এই আমবাগানে, জানেন নিশ্চয়? আমার জীবনেরও একটা ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী এই আমবাগান। সেটি এখানে উল্লেখ যোগ্য নয়। নিজের কোনো এক আত্মজীবনীতে সেটা উল্লেখ করা যাবে ক্ষণ! এই বাক্যটার পর একটি হাহা ইমোজি ব্যবহার করতে পারলে বেশ হতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশি ঘোরাফেরার কারণে ইদানীং এই সমস্যাটা প্রকট হচ্ছে। সেখানে তো হারহামেশাই ইমোজি ব্যবহার করে যাই। কোনো কিছু লিখতে বসলে এখন ইমোজি ব্যবহার করতে মন চায়- এমনকি মাঝে মধ্যে পরীক্ষার খাতায়ও। কী বিপদ! কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। নাকি সাহিত্যেও ইমোজির ব্যবহার শুরু হবে কোনো এক সুদূর ভবিষ্যতে?

যাকগে, বাড়তি কথায় কাজ নেই। জানা দুটো ঘটনাকেই আবার মনে করিয়ে দিয়ে লেখাটির ইতি টানি। ঘটনা দু’টি ঘটলো দু’শো চৌদ্দ বছরের ব্যবধানে, পরস্পরের থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার দূরত্বে। একটা ঘটনাকে যদি আমরা বাঙালির স্বাধীনতার সূর্যাস্ত বলে অভিহিত করি, তাহলে আরেকটাকে বলা চলে বাঙালির স্বাধীনতার সূর্যোদয়। নদীয়া জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত পলাশী গ্রামের এক আমবাগানে, ১৭৫৭ সনের ২৩ জুন যে সূর্য অস্তমিত হলো- ঠিক সেই সূর্যই যেন আবার উদিত হলো মেহেরপুর জেলার বাগোয়ন ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আরেকটি আমবাগানে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল।

কী, বুঝলেন কিছু? আপনি আম পছন্দ করুন বা না করুন, আম যে আপনার সাথে বেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেটা কি বুঝতে পারলেন, মহাশয়? অনেক লিখেছি; আর লিখতে পারব না। আরও যার জানার ইচ্ছা, ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখে নিন না, মশাই!

0504 হরিপদ শীল অব্যক্ত Poem 2nd 1
শিক্ষার্থী | পরিসংখ্যান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনঃ ২০১৬-১৭