fbpx

পদক্ষেপ – প্রথম পর্ব

” স্যার?” দরজায় দুইটা টোকা দিয়ে ওসির রুমে প্রবেশ করলো ইন্সপেক্টর শরাফত উল্লাহ।

“হ্যা,বলো শরাফ।” এক চোখ খুলে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো ওসি সোহরাব।

“স্যার, একজন ভদ্রলোক এসেছেন। আমাদের ফোর্স চাচ্ছেন।” হালকা স্বরে বলে উঠলো শরাফত উল্লাহ।

কথাটি যেনো ওসির কর্নকূহরে টং করে বেজে উঠলো।হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসলেন। কপালে সূক্ষ্ম একটা ভাজ তুলে বললেন,” ফোর্স চাচ্ছে মানে। কাহিনি কি?”

“স্যার…..” শরাফতকে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলেন ওসি। মুখে একটা আঙ্গুর দিয়ে আবার চেয়ারে হেলান দিলেন। একটু সময় নিয়ে বললেন,” ওনাকে ভিতরে নিয়ে আসো।”

“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার ওয়াইফ হঠাৎ করেই উধাও? ঝগড়া ফাসাদ কিছুই নাই,কিন্তু একটা মানুষ নিজের ইচ্ছায় উধাও। ভিত্তিহীন কথা বলার জন্য রাত দুইটায় থানায় আসছেন আপনি?” শেষের কথাটি একটু রাগ মিশ্রিত কন্ঠে জোরেশোরেই বললো ওসি সোহরাব।

“স্যার,আমি তো বললামই যে আমরা রাতে খাবার খেয়ে একসাথেই বেডে গেছি। এক থেকে দেড় ঘন্টা পর জেগে দেখি সে বেডে নাই। ওর ফোনটা বালিশের পাশেই ছিলো। প্রথমে ভাবছিলাম ওয়াশরুমে গেছে।পড়ে তো দেখি ফ্লাটের মেইন দরজা খোলা। আর সেও….।” ওসির দিকে চেয়ে এক নিশ্বাসে বলে ফেললো আনুমানিক পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ পাভেল হাসান।

“কি? সেও টা কি?” বিরক্তিস্বরে জানতে চাইলো ওসি।

” ও নাই স্যার। বাসায় ও নাই! বাসার আশেপাশেও নেই। এখানে আমাদের কোনো আত্মীয়ও নাই যে সেখানে যাবে। স্যার প্লিজ আমার সাথে আপনার ফোর্স দিন। একটু খুজতে সাহায্য করুন স্যার। ওর কিছু হয়ে গেলে…”

“এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাকে আগে একটা কথা বলুন।ওনার মাথার কি কোনো প্রবলেম আছে?মানে উনি কি অসুস্থ ছিলেন?”

“স্যার,ও একটা এনজিওতে জব করে। অসুস্থ হলে জব কেমনে করতো?” শক্তস্বরে জবাব দিলো পাভেল।

“কোনো এফেয়ার?” জানতে চাইলো ওসি।

ওসির কথায় বেজায় চটে গেলেন পাভেল হাসান। কিন্তু মোবাইল ফোনের কথা মনে পড়তেই শরীরটা অসার হয়ে আসলো তার। তাহলে কি এটাই কারন হতে পারে?পাভেল তার স্ত্রী আফসানা হকের ফোনটা ওসির দিকে বাড়িয়ে দিলো।

“কি আছে এতে?”

“স্যার, প্রথম ইনকামিংটা দেখুন।”

সোহরাব ইনকামিংটা দেখলো। সামনে দাড়িয়ে থাকা শরাফতের দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে পাভেল কে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কল দিয়ে চেক করেছেন?”

“জ্বি স্যার। রিং হয় কিন্তু রিসিভড হয় না। তবে আমার মনে হয় না এটাই কারন হতে পারে।”

“কেনো হতে পারে না। কেউ ধোয়া তুলসি পাতা না,বুঝলেন? আপনার স্ত্রী আপনায় অনেক ভালোবাসে।তার মানে এটাই না যে সে পরকীয়া না করার সার্টিফিকেট আপনাকে দিছে।”

“স্যার, আপনি ইনকামিং এর টাইমটা দেখেন।আমি যখন সব জায়গা খুজে ওকে না পেয়ে এখানে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন কলটা আসে।কিন্তু ফোনটা ভাইব্রেট করা ছিলো তাই রিসিভড করতে পারি নাই। পরে কল দেওয়াতে আর রিসিভড হয় নাই স্যার।”

“আপনি এই বিষয়ে আগে থেকে কিছু জানতেন?” জানতে চাইলো ওসি।

“না স্যার। আর কোনোদিন সন্দেহ ও করি নাই।”

“স্যার,এখনো কল রিসিভড হচ্ছে না। আমার নাম্বার থেকে দিলাম তবুও নট রিসিভডএবল।”পাশে থেকে বলে উঠলো ইন্সপেক্টর শরাফত।

সোহরাব এবং পাভেল দুইজনই শরাফতের দিকে তাকায়। একটু ভেবে ওসি পাভেলকে উদ্দেশ্য করে বলে,” আপনি কি ওনার বাসার ঠিকানা জানেন?”

“না স্যার।” ছোটোখাটো জবাব পাভেলের।

“আমরাও জানি না।”হালকা হাসির স্বরে বলে উঠলো ওসি সোহরাব।” এখন অপেক্ষা ছাড়া বুদ্ধি নেই পাভেল সাহেব। সকাল হোক,দেখি কি করা যায়। আর এর মধ্যে ফিরেও তো আসতে পারে?” আবারো বললো সে।

“তার মানে এখন আপনারা আমায় খুজতে সাহায্য করবেন না? স্যার আমি আগেই বলেছি এখানে আমাদের কোনো আত্মীয় নেই যাকে নিয়ে আমি খুজতে পারি। যে দুয়েকজন আছে তারা তাদের মতো করে একটু খুজে বাসায় গিয়ে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।এখন আমি কি করবো স্যার কিছুই বুঝতে পারছি না।” উদগ্রীব হয়ে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে ওসিকে উদ্দেশ্য করে বললো পাভেল।

“আপনারা আমাদের কি ভাবেন বলুনতো? রোবোট? না এলিয়েন? একটু ভাবার সময় দিবেন না? এখন কুকুরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো নাকি তাকে খোঁজার জন্য?”

“পাভেল সাহেব আপনি বাসায় যান। আর স্যার আমি অলরেডি ওনার ওয়াইফের ফটো আশেপাশের সব থানায় মেইল করে দিয়েছি। যারা রাউন্ডে আছে তারা তো খুজবেই। সাথে আরও কয়েকজনকে এলার্ট করে দিয়েছি।” ওসির কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলে উঠলো শরাফত।

ওসি আবারো চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চোখ দুটো আস্তে করে বন্ধ করলো।অস্ফুটস্বরে জবাব দিলো,”গুড জব শরাফ।”

পাভেল চলে গেলো। ইন্সপেক্টর তাকে তাদের কাছের সকল আত্মীয়কে খবরটা জানানোর জন্য বললো। আর খুব শীঘ্রই আপডেট জানাবে বলে আশ্বস্ত করলো।ওসি সোহরাবের শরীরটা একটু খারাপ তাই তিনি রেস্ট নেওয়ার জন্য পুলিশ কোয়ার্টারে চলে গেলো।শরাফতকে বলে গেলো কোনো আপডেট পেলে যেনো তাকে সরাসরি জানানো হয়। ওসি সোহরাবের ডেডিকেশন লেভেলটা ওনেক হাই।চাইলেই ছুটি নিতে পারতেন কিন্তু নেবেন না। এছাড়াও অনেক কারনেই তিনি এই থানার একজন সম্মানের বস্তু।

রাত আনুমানিক তিনটা। গগনবিদারী চিল্লাপাল্লা করে বাড়িসুদ্ধ সকল মানুষকে এক ঘরে জড়ো করেছেন আহমেদ মালিক। তার সাফ কথা ঔ অক্ষম পাভেলটাই বোনকে কিছু একটা করেছে। বারবার অক্ষম কথাটা উচ্চারণ করায় বেজায় চটেছেন মালিক আফসানার বাবা বাবুল মুন্সি।একজন সুস্থ-সবল মানুষকে এভাবে অপমান তিনি বরদাস্ত করবেন না। তিনি পাভেল কে ভালো করেই চেনেন। মেয়ের জন্য পাভেলের চোখে যে ভালোবাসা দেখেছেন সেটা কয়েক জনমেও ফুরোবে না। সেই পাভেল তার মেয়ের কোনো ক্ষতিই করতে পারেন না। তিনি আর কিছু না ভেবে ছেলেকে হুকুম দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাভেলের ভরসা হয়ে তার কাছে যাওয়ার জন্য। বয়সের ভাড়ে কুজে যাওয়া বৃদ্ধ বাবুল মুন্সি তাহাজ্জুদে গেলেন মেয়ে জামাইয়ের মঙ্গল কামনায়।

মাত্র চোখটা লেগে এসেছে ওসি সোহরাবের। এর মধ্যেই ইন্সপেক্টর শরাফতের ডাক। এক্ষুণি হসপিটাল যেতে হবে। কিছুক্ষণ আগেই রেলওয়ে ফাঁড়ি পুলিশ একটা মহিলার বিভৎস লাশ পেয়েছে। মুখটা চেনা যাচ্ছে না।পুরোপুরিভাবে থেতলে গেছে। পাভেলকেও হসপিটালে ডাকা হয়েছে আইডেন্টিফিকেশনের জন্য। জামাকাপড় দেখে যদি চিনতে পাড়ে।

পাভেল চিনতে পাড়েনি। এটা তার আফসানা হতেই পারে না।তার আফসানা সালোয়ার কামিজ পড়তেন না। কিন্তু এই মহিলা সালোয়ার কামিজ পড়ে আছে।হাইট যদিও কাছাকাছি মিলে গেছে। কিন্তু সে তো সালোয়ার-কামিজ পড়ে আছে। না, না এটা আফসানা নয়।

“শুধু সালোয়ার কামিজ দেখেই উনি বলে দিলেন এটা ওনার ওয়াইফ না। ভালোভাবে দেখলেন ও না। কারন হিসেবে কি বললেন? তার ওয়াইফ তাকে এতোই ভালোবাসতো যে শুধু তার পছন্দ জন্য বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনোদিন শাড়ি ছাড়া সালোয়ার কামিজ পড়েনই নাই। কিছু বুজতে পারছো শরাফ?” ইন্সপেক্টর শরাফতকে উদ্দেশ্য করে বললেন ওসি সোহরাব।

“জি স্যার। কিছুতো একটা আন্দাজ করছি।”

“আফসানা হকের ভাই কতদূর?” মাথা চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞেস করলো ওসি।

“স্যার,সকালের মধ্যে পৌছে যাবে।”

“আচ্ছা শরাফ তোমার কি মনে হচ্ছে?”

“আমি কনফিউজড স্যার। দুইটা সাসপেক্টই আমার কাছে প্রাইম মনে হচ্ছে। আগে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট টা হাতে আসুক স্যার। সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”

আফসানার ভাই মালিকও পাভেলের সাথে একমত তার বোন বিয়ের পর থেকে সালোয়ার কামিজ পড়েন না।তবে এই লাশের সালোয়ার কামিজটা একটা ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে বলে আন্দাজ করছেন তিনি। তার ভাষ্যমতে এই খুনটা পাভেলই করেছে। তার ধারনা অনেকদিন হলো বোন আর পাভেলের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। তাই সুযোগবুঝে পাভেল আফসানাকে মেরে দিছে। এই নিয়ে ওসির সামনেই পাভেল আর মালিকের কয়েকদফা তর্কও হয়ে গেলো। মালিক পাভেলের সামনেই তার নামে বোন হত্যার মামলা করার তোরজোর শুরু করে দিছিলো। কিন্তু এখনো কোনো শক্ত প্রমান হাতে আসেনাই জন্য তাকে ধৈর্য্য ধরতে বলা হয়েছে।

পরদিন সকালবেলা। পুলিশের হাতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে।মেয়েটিকে প্রথমে শ্বাসরোধ করা হয়েছে। পড়ে আইডেন্টিটি মুছে দেওয়ার জন্য রেললাইনে শোয়ানো হয়েছে। তবে একটা জিনিসে খটকা আছে। মেয়েটি প্রেগন্যান্ট। কিন্তু আফসানা হক প্রেগন্যান্ট ছিলেন না।এটা পাভেল আস্বস্ত করেছেন। কারন দশ বছর হলো বিয়ে হলেও পাভেলের কিছু সমস্যার কারনে তারা সন্তানের মুখ দেখতে পারেন নাই। আর না দেখার সম্ভাবনাও নাই বললেই চলে। তার মানে কি পরকীয়া এঙ্গেল? সোহরাব আর শরাফত প্রায় বিশ মিনিট হলো এটাই ভাবছে। তবে এখানে আরেকটি খটকা আছে।তারা এখনো শিওর নয়। এটাই আফসানা কি না। তাই লাশের ডিএনএ টেস্টের জন্য বলা হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া এই কেস এখনো অন্ধকার। তাই বলে ওসি সোহরাব চুপ করে থাকবে না। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী এটা যদি আফসানা হয় তাহলে তাদের মেইন সাসপেক্ট হবে পাভেল। বউয়ের পরকীয়া কেনো হাসবেন্ড ই সহ্য করবে না। সে যতো অক্ষম ই হোক। তার এখন একটাই কাজ হবে পরকীয়া এঙ্গেলটা খতিয়ে দেখা। একবার এটাকে প্রমান করতে পারলেই আরো একটা জটিল কেস সলভড।

আজকে অফিসে যায়নাই পাভেল। সকাল থেকে বাথট্যাবে শুয়ে শুয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছে সে। সন্তানধারনের তীব্র ইচ্ছা একটা মেয়েকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে ভাবতেই শরীরটা বারবার অসার হয়ে আসছে তার। যদিও তার কাছে এটার সম্ভাবনা জিরো পার্সেন্ট। সে পুরোপুরি সিওর এটা কখনোই আফসানা নয়। একজন মেয়েকে তার মায়ের থেকেও ভালো চেনে তার হাসবেন্ড। কয়েকশো মিটার দূরে থেকেও শুধু বাতাসে গন্ধ শুকে বলে দিতে পারবে এখানে তার অর্ধাঙ্গিনী আছে কিনা। কিন্তু কাল রাতের ফোনকলটাই বারবার ভাবাচ্ছে তাকে।
চলবে….